রপ্তানি আয়ে টানা পতন, অক্টোবরে কমেছে ৭.৪৩%; সামনে আরও কমার আশঙ্কা রপ্তানিকারকদের
অক্টোবরে টানা তৃতীয় মাসের মতো কমেছে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয়। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আয় হ্রাস পেয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক এবং ব্যাংক খাতের চলমান সংকটের কারণে আগামীতেও রপ্তানি কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও সেপ্টেম্বারের তুলনায় অক্টোবরে রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি শুল্কের কারণে সেখানকার অর্ডারও কমছে। এর সঙ্গে ইউরোপের প্রধান বাজারে চীনা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্ডারও কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব কারণেই রপ্তানি আয় কমছে বলে মনে করছেন তারা। আবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকিং খাতের সমস্যাও।
রপ্তানিকারকদের মতে, সামনে কয়েক মাসেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ, যাদের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার, তারাও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্ডার কমে যাওয়ার প্রভাব অনুভব করছে।
ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের অর্ডার আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বড় কিছু ক্রেতাও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এর ফলে আমাদের নিটিং ও ডাইং ইউনিটের কাজও কমে গেছে। আগামী নির্বাচনের আগে অর্ডারের প্রবাহ বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।"
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর প্রায় অর্ধেক পণ্য যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। একক দেশ হিসেবে সর্বাধিক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যা মোট রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ।
ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি ও অ্যামিটি ডিজাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী পোশাক রপ্তানি কমার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছেন—নির্বাচনকালীন অস্থিরতার আশঙ্কায় ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে চীনা রপ্তানিকারকদের ইউরোপমুখী হওয়ায় বাংলাদেশের অর্ডার কমে যাওয়া, এবং সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সংকটে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে না পারা।
তিনি বলেন, "আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য অস্থিরতার আশঙ্কায় অনেক ক্রেতা অর্ডারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তারা সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিতে চাইছে না। অন্যদিকে, চীনের রপ্তানিকারকরা যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে এখন ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে, এতে আমাদের বাজার কিছুটা সঙ্কুচিত হচ্ছে।"
একই ধরনের সমস্যার কথা জানিয়েছেন আরও দুইজন রপ্তানিকারক।
তারা বলেন, সরকার সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলো একীভূত করার ঘোষণা দেওয়ার পর অনেক আমানতকারী এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। ফলে গার্মেন্টস মালিকরা সেখানে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলতে পারছেন না, কারণ সরবরাহকারীরা এসব ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নন। কিন্তু রপ্তানিকারকদের পক্ষে সহজে ব্যাংক পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়।
ইপিবির তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসের মধ্যে কেবল জুলাইয়েই রপ্তানি বেড়েছিল, পরের তিন মাসে টানা হ্রাস পেয়েছে।
তবে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে মোট রপ্তানি আয় আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৬ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবরে কেবল তৈরি পোশাক নয়, রপ্তানি কমেছে হিমায়িত ও জীবিত মাছের ১৩ শতাংশ, প্লাস্টিক পণ্যের ১২ শতাংশ এবং কৃষিপণ্যের ১০ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি বেড়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ১৩ শতাংশ, পাট ও পাটজাত পণ্যের ৭ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইলের ১৪ শতাংশ।
 
