বেনাপোলে সন্ধ্যা ৬টার পর আমদানি-রপ্তানি বন্ধ: কাস্টমসের একতরফা সিদ্ধান্তে বিপাকে ব্যবসায়ীরা
কাগজপত্রবিহীন ও চোরাই পণ্য অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পূর্ব ঘোষণা বা প্রস্ততি ছাড়াই বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সন্ধ্যা ৬টার পর সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে বেনাপোল কাস্টমস। এ সিদ্ধান্তে বন্দরে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তজুড়ে পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ জট সৃষ্টি হয়েছে। বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকেরা।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে ঠিকই, তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেনাপোল-পেট্রাপোল ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) ২৪ ঘণ্টাই চালু রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়াও গত বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের সব কাস্টমস হাউস ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বেনাপোলে সেই নির্দেশনা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- বন্দর ও কাস্টমস কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাবে প্রায়ই প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০০-২৫০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি হয় এ বন্দর দিয়ে। সময়সীমা কমে যাওয়ায় বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
বন্দর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তে প্রতিদিন আটকে থাকছে দেড় হাজারেরও বেশি পণ্যবাহী ট্রাক। এসব ট্রাকে রয়েছে ফল, সবজি, মাছ, কসমেটিক্স, রাসায়নিক কাঁচামালসহ দ্রুত পচনশীল পণ্য, যেগুলোর অনেক কিছুই নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
সূত্র আরো জানায়, আগে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ ট্রাক পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করলেও এ সিদ্ধান্তের পর তা কমে ১৮০-২০০টিতে নেমেছে।
আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার পণ্য খালাস আটকে থাকায় ব্যবসায়ীরা যেমন বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি সরকারও প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সমিতির নেতারা বলছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ অবৈধ মালামাল আমদানি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে সবার ওপর দোষারোপ করে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করতে পারে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী আনারুল ইসলাম বলেন, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া সন্ধ্যার পর বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করায় ব্যবসায়ীরা হতবাক। দুই পাশে শত শত ট্রাক আটকে আছে, কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প হিসেবে ভোমরা, হিলি বা সোনা মসজিদমুখী হতে বাধ্য হবে। এতে সরকারের রাজস্বও কমবে।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশের এই একতরফা সিদ্ধান্তে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দুই দেশের বাণিজ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। পেট্রাপোল বন্দরে প্রতিদিন ট্রাক জটে পড়ছে। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি ট্রাক পণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে পেট্রাপোল বন্দরে। বিগত সময়ে রাত ১২টা পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি চালু ছিল।
বেনাপোলে বন্দর ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তা না করে একতরফাভাবে সময়সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা, এমনকি সরকারও।
তিনি বলেন, 'আমরা কাস্টমস কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রতিদিন অন্তত ৪০০-৫০০ আমদানিমুখী ট্রাক প্রবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।'
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা বলেন, 'কয়েকদিন আগে আমাদের সাথে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছিল। তারা প্রস্তাব করেছিল সন্ধ্যা ৬টার পর আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকার। আমরা বলেছি বন্দর ব্যবহারকারী সবার সাথে কথা বলে বিষয়টি জানানো হবে।'
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, 'আমরা বন্দর পরিচালনা করি। তবে কাস্টমস অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য ক্লিয়ার করা সম্ভব নয়। আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত রাজস্ব এবং বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।'
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তা না করে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। সরকারেরও রাজস্ব আয় কমে যাবে।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার খালিদ মো. আবু হোসেন ও অতিরিক্ত কমিশনার মুশফিকুর রহমানের ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি।
তবে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক সমন্বয়ের কারণে সাময়িকভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দ্রুত সমাধান হতে পারে।
