দুঃস্বপ্ন দেখা কি স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক?

ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেনি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। পুরনো দিনে লোকে বিশ্বাস করত, ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখার সময়ে অশুভ আত্মারা এসে মানুষের জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে যায়। বর্তমানে বিজ্ঞানের যুগেও দুঃস্বপ্নকে নিয়ে ভয় পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তবে এবার শুধু কুসংস্কারে নয়, বিজ্ঞানীরাও খারাপ স্বপ্ন দেখার ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরছেন।
জনসংখ্যার প্রায় ২ থেকে ৬ শতাংশ মানুষ প্রতি সপ্তাহে দুঃস্বপ্নের শিকার হন। আর এই ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখার সঙ্গেই বেরিয়ে আসছে অসুস্থতার নানা যোগসূত্র।
কিছু কিছু সম্পর্ক অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল। যেমন বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়া এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার -এর মতো মানসিক রোগের একটি সাধারণ উপসর্গ হলো দুঃস্বপ্ন। দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক যন্ত্রণার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি।
তবে কিছু যোগসূত্র বেশ রহস্যময়। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষক আবিদেমি ওতাইকুর গবেষণা বলছে, দুঃস্বপ্ন পার্কিনসনস এবং ডিমেনশিয়ার মতো গুরুতর স্নায়ুরোগের পূর্বাভাস হতে পারে। অন্যান্য গবেষক দল দেখিয়েছে, হৃদরোগ এবং লুপাসের মতো অটোইমিউন রোগ, যা সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেগুলোর সঙ্গেও দুঃস্বপ্নের সম্পর্ক থাকতে পারে।
অকাল মৃত্যুর কারণও হতে পারে দুঃস্বপ্ন!
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, দুঃস্বপ্ন মানুষের জীবন কেড়েও নিতে পারে। গত মাসে হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ডক্টর ওতাইকু তার সর্বশেষ গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা ধূমপান, স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা অলস জীবনযাত্রার চেয়েও অকাল মৃত্যুর জোরালো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য ডক্টর ওতাইকু যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ছয়টি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করেন, যেখানে ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রায় ২,৫০০ শিশু অংশ নিয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, যারা মাসে একবারের কম দুঃস্বপ্ন দেখেন, তাদের তুলনায় যারা প্রতি সপ্তাহে বা তার চেয়েও বেশিবার দুঃস্বপ্ন দেখেন, তাদের ৭০ বছর বয়সের আগে মারা যাওয়ার আশঙ্কা তিনগুণ বেশি। সমীক্ষায় অকালে মারা যাওয়া ১৭৪ জনের মধ্যে ৩১ জনই প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
এর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ডক্টর ওতাইকু। তিনি খুঁজে পেয়েছেন, যারা ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখার সমস্যায় ভোগেন, তাদের ক্রোমোজোমে দ্রুত বার্ধক্যের ছাপ পড়ে। দুঃস্বপ্নের কারণে শরীরে স্ট্রেস হরমোন (দুশ্চিন্তার হরমোন) নিঃসৃত হয়, যা এই ধরনের বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে। তিনি মনে করেন, দুঃস্বপ্নজনিত অকাল মৃত্যুর ঝুঁকির প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য এই ক্রোমোজোমীয় পরিবর্তনই দায়ী। বাকি ৬০ শতাংশ ঝুঁকির কারণ এখনো অজানা।
এইসব তথ্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, দুঃস্বপ্নকে গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। যখন এটি রোগের উপসর্গ হিসেবে আসে, তখন তা ভবিষ্যতের কোনো বড় রোগের সতর্কবার্তা দেয়। আবার যখন এটি নিজেই রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন দুঃস্বপ্ন কমানোর চিকিৎসা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা উচিত।
তবে এই দুটি বিষয়কে সবসময় আলাদা করা সহজ নয়। যেমন, বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন একই সঙ্গে রোগের উপসর্গ এবং কারণ। মানসিক অস্থিরতার কারণে দেখা দুঃস্বপ্ন শরীরে স্ট্রেস তৈরি করে, যা মূল মানসিক রোগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অন্যদিকে, পার্কিনসনস বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে, যা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির কারণে হয়, দুঃস্বপ্ন মূলত রোগের উপসর্গ হিসেবেই কাজ করে। একই কথা লুপাসের ক্ষেত্রেও সত্য হতে পারে। এই রোগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে মস্তিষ্কসহ সুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে, যা প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহের ফলেই দুঃস্বপ্ন দেখা দিতে পারে।
তবে হৃদরোগের ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন সম্ভবত রোগের কারণ, উপসর্গ নয়। দুঃস্বপ্নের কারণে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ রক্তনালীর ক্ষতি করে এমন প্রদাহকে উৎসাহিত করে।
দুঃস্বপ্নকে শনাক্ত করা এক জিনিস, আর তার চিকিৎসা করা আরেক। সাইকোথেরাপি এক্ষেত্রে অনেকের জন্য সহায়ক হতে পারে। প্রাজোসিনের (সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহৃত) মতো কিছু ওষুধও সাহায্য করতে পারে। কিন্তু দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অবহেলিত ক্ষেত্র রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।