ডার্ক চকলেট কি সত্যিই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

চকলেট যে একটি বিশেষ মুহূর্তে খাওয়ার মজার খাবার, তা ছোট শিশুরাও জানে। কিন্তু যখনই 'ডার্ক' চকলেটের কথা আসে, যেখানে কোকোয়ার পরিমাণ বেশি, তখনই একে স্বাস্থ্যকর, এমনকি স্বাস্থ্যের জন্য ঊপকারী হিসেবে প্রচার করা হয়। বলা হয়, ডার্ক চকলেট নাকি উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে বিষণ্ণতা—সবই সারিয়ে তোলে, এমনকি মস্তিষ্কের শক্তিও বাড়িয়ে দেয়! অনেক গবেষণায় এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, যদিও সেগুলোর পেছনে প্রায়ই কলকাঠি নাড়ে বড় বড় চকলেট কোম্পানিগুলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণাগুলো এই ধারণাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে।
ডার্ক চকলেটের এই কথিত জাদুকরী ক্ষমতার পেছনের নায়ক হিসেবে ফ্ল্যাভানল (flavanols) নামক একটি যৌগকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যা কোকোতে প্রচুর পরিমাণে থাকে। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোতে গবেষকরা ফ্ল্যাভানল-সমৃদ্ধ ক্যাপসুল, এমনকি কোকো, কফি, চা, বেরি, আঙ্গুর ও আপেলের মতো খাবার মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিছু ক্ষেত্রে রক্তচাপের ওপর সামান্য ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেলেও, সামগ্রিক ফলাফল ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তার ওপর, এই পরীক্ষাগুলো ছিল স্বল্পমেয়াদী, তাই নিয়মিত ডার্ক চকলেট খেলে কী হবে, তার কোনো স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়নি।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ডার্ক চকলেট বা ফ্ল্যাভানল-যুক্ত খাবার খান, তারা তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যবান হন এবং তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে। কিন্তু এর পেছনের কারণ হতে পারে অন্যকিছু। যেমন, যাদের আয় বেশি, তারাই ডার্ক চকলেটের মতো দামী খাবার কেনার সামর্থ্য রাখেন এবং তাদের জীবনযাত্রাও উন্নত। এমনকি ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি ডার্ক চকলেট খান, তাদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতাও কম।

এই ধোঁয়াশা দূর করতে ২০১৫ সালে আমেরিকায় 'কসমস' (COSMOS) নামে একটি বড় গবেষণা চালানো হয়। এতে অংশগ্রহণকারীদের টানা প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম ফ্ল্যাভানলযুক্ত ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। এই পরিমাণ ফ্ল্যাভানল পেতে আপনাকে প্রায় অর্ধেক বার থেকে শুরু করে প্রায় তিনটি ডার্ক চকলেট বার খেতে হতে পারে। ফলাফল? ফ্ল্যাভানল গ্রহণে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার বা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোনো প্রভাবই পড়েনি! তবে একটি ইতিবাচক দিক হলো, হৃদরোগে মৃত্যুর হার প্রায় ২৭% কমে গিয়েছিল।
কিন্তু এই সামান্য সাফল্যই ডার্ক চকলেটকে স্বাস্থ্যকর প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, ডার্ক চকলেট থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপকারী ফ্ল্যাভানল পেতে হলে আপনাকে একইসাথে খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে চিনি আর স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা হৃদপিণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং ধমনীতে কোলেস্টেরল জমিয়ে দেয়। তাই ফ্ল্যাভানল পেতে চাইলে কোকো পাউডার বা গুঁড়ো করা কোকো বিনস্ খাওয়া ভালো বিকল্প হতে পারে।
আসলে, ফ্ল্যাভানল খাবার সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায় হলো ফল, শাকসবজি, বাদাম ও মটরশুঁটি জাতীয় খাবার খাওয়া। মাত্র দুটি আপেল, একমুঠো বাদাম আর এক বাটি স্ট্রবেরি থেকেই আপনি প্রয়োজনীয় ৫০০ মিলিগ্রাম ফ্ল্যাভানল পেয়ে যাবেন। অথবা পান করতে পারেন দুই থেকে তিন কাপ গ্রিন টি।
তাই, যদি নিতান্তই চকলেট খেতে ইচ্ছে করে, তবে সবচেয়ে তেতো বা ডার্ক চকলেটটিই খুঁজতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। কারণ কিছু ডার্ক চকলেটে ফ্ল্যাভানল কম থাকে, আবার কিছু মিল্ক চকলেটেও বেশি থাকতে পারে। চকলেটপ্রেমীদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, ডার্ক চকলেটের স্বাস্থ্যকর ভাবমূর্তিটি মূলত আমাদের মনের ইচ্ছা এবং কোম্পানিগুলোর চতুর বিপণনের ফসল, এর পেছনে শক্ত কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।