বিদায় তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা লেখক রকিব হাসান আর নেই। আজ বুধবার বিকেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রকিব হাসানের (৭৫) মৃত্যুর খবরটি জানিয়েছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মূর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মূর হোসেনের স্ত্রী।
রকিব হাসান ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গিয়েছিল। আজ ডায়ালাইসিস চলাকালীন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
পড়ুয়াদের কৈশোরের সঙ্গী তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে বাবার চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কাটে ফেনীতে।
'এই বয়সে অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হয়। আমার সে দুর্গতি হয়নি। একটা ঠিকানা আগে করে নিয়েছি, তাতে ভালো আছি। লিখেছি অনেক, এত জনপ্রিয় হবো, ভাবিনি।'
পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে মন টেকেনি এই লেখকের। অবশেষে তিনি লেখালেখিকেই বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে। নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম।
'এখন পর্যন্ত কতগুলো বই প্রকাশ হয়েছে আমার জানা নেই, মনে হয় ৪০০ হবে। ছেলেরা বইয়ের হিসাব রাখে। আমি এসব রাখতে পারি না এখন।'
রকিব হাসানের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে, ১৯৭৭ সালে। স্বনামে প্রথম প্রকাশ অনুবাদগ্রন্থ 'ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা' দিয়ে। তিনি আরও অনুবাদ করেছেন এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেলের মতো বিখ্যাত লেখকদের ক্লাসিক বই। অনুবাদ করেছেন অ্যারাবিয়ান নাইটস ও এডগার রাইস বারোজের টারজান সিরিজ।
রকিব হাসান নামটা যেভাবে এল
রকিব হাসানের ছদ্মনাম জাফর চৌধুরী, আবু সাঈদ। আবুল কাসেম আবদুর রকিব। এই নামকেই কাটছাট করে রাখা হয় 'রকিব হাসান'।
আবু সাঈদ ছদ্মনামে বের হয় গোয়েন্দা রাজু সিরিজ। আর জাফর চৌধুরী নামে লেখেন রোমহর্ষক সিরিজ। ১৬টা বই বের হয়েছিল গোয়েন্দা রাজু সিরিজের। উল্লেখযোগ্য বই- মামার মন খারাপ, চকলেট রহস্য, দামি কুকুর...ইত্যাদি। রোমহর্ষক সিরিজের উল্লেখযোগ্য বই- যাও এখান থেকে, নরবলি, পাগলা ঘন্টি, অভিশপ্ত ছুরি ইত্যাদি। এই সিরিজের মোট বই বেরিয়েছিল ১১টা।
রকিব হাসান নামের পেছনে একটি মজার ঘটনা আছে বলে জানিয়েছিলেন তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা। বলেছিলেন, তার সার্টিফিকেট নামটা বিশাল। আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব—পাঁচটা নামের সমাহার।
'হাই পাওয়ারের লেন্স ব্যবহার করে পড়া যায়। কিন্তু লেখা যায় না। লিখতে গেলে হাত কাঁপে, শব্দ-বাক্য ঠিকমতো লেখা যায় না। চোখে ভালো করে দেখে অক্ষর বসাতে পারি না। কীভাবে যে অসুস্থ হয়ে গেলাম, ভাবতেই খারাপ লাগে এখন।'
রকিব হাসান ছদ্মনামের বাইরে সেবায় শামসুদ্দীন নওয়াব এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে বই লিখেছেন। রকিব হাসানের নামে বের হওয়া বইটি ছিল একটা অনুবাদ: জঙ্গল, ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকার কাহিনি। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি জমা দিয়েছিলেন আবদুর রকিব নামে। তখন বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী সেবা প্রকাশনীর বেশির ভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন। প্রচ্ছদ করতে গিয়ে তিনি আবদুর রকিব নাম নিয়ে আপত্তি তোলেন। নামটা পছন্দ হয়নি তার।

দিন তিনেক পর কাজী আনোয়ার হোসেন ডেকে পাঠালেন। শাহাদত চৌধুরীও ছিলেন। তিরি রকিব হাসানকে চমৎকার একটি যে প্রচ্ছদ দেখালেন। সেখানেই কাজী আনোয়ার হোসেনের সম্মতিতে জন্ম হলো 'রকিব হাসান' নামের। আবদুর রকিবের সঙ্গে তার ডাকনাম হাসান জুড়ে করা হলো রকিব হাসান। রকিব হাসান নামেই বই হিট হয়ে গেল। দ্বিতীয় বইও বের হয়ে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা—সুপারহিট!
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রকিব হাসান বলেছিলেন-
'আমি মনে হয় লেখকই হতে চেয়েছি। এর বাইরে কোনো কিছুতে আমার কোনো আকর্ষণ নেই। অনেক কাজেরই সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু যাইনি। যে চাকরিগুলোর কথা বলছি, ওগুলোর কোনোটাই কিন্তু ফেলনা ছিল না। তবু ঘরে বসে বেকুবের মতো লিখে যাওয়াতেই মন সায় দিচ্ছিল আমার।'
ছোটদের জন্য লিখেই রকিব হাসান অধিক খ্যাতি পেয়েছে। তিন গোয়েন্দা ছাড়াও তার অন্য দুটি সিরিজ তিন বন্ধু ও গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন। তার তিন গোয়েন্দা সিরিজের মোট বইয়ের সংখ্যা ১৬০। অনুবাদ করেছেন ৩০টি বই। বড়দের উপযোগী তার লেখা কিছু রহস্য উপন্যাসও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
রকিব হাসানের রোমহর্ষক সিরিজে রেজা ও সুজা দুই ভাইয়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই সিরিজটি থেকে তিন গোয়েন্দায় অনেকগুলো গল্প ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কিশোরদের জন্য বেশ কিছু সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন তিনি।
রকিব হাসান কেবল তিন গোয়েন্দারই ১৬০টি বই লিখেছেন। এছাড়া কমপক্ষে ৩০টি বই অনুবাদ করেছেন।
অন্য যেসব পেশায় ছিলেন রকিব হাসান
রকিব হাসান ১২-১৩টা চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সেগুলোর কোনোটির মেয়াদ ৮ ঘণ্টা, কোনোটির ২০ ঘণ্টা, কোনোটি ১০ দিন। থ্রিলার এবং গোয়েন্দা গল্প লেখার পূর্বে তিনি অন্যান্য কাজেও যুক্ত ছিলেন। রহস্যপত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এই লেখক। চাকরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে রকিব হাসান বলেছিলেন-
'১২-১৩টা চাকরিতে ঢুকেছি, কোনোটার মেয়াদ ৮ ঘণ্টা, কোনোটা ২০ ঘণ্টা, কোনটা ১২ ঘণ্টা, কোনোটা ১০ দিন! (হাসি) ওইসব করে-টরে আমি বুঝলাম বসের ঝাড়ি আমার সহ্য হবে না, নিয়মিত অফিসে যাওয়া আমাকে দিয়ে হবে না, স্যার বলতে আমি পারব না, সালাম দিতে পারব না। আমি স্বাধীন টাইপের মানুষ, স্বাধীনভাবে থাকাই ভালো। তাতে টাকা কামাই হলে হোক, না হলে নাই।'
সেবা প্রকাশনীতে যেভাবে আসা
পল্টনের পুরনো বইয়ের দোকানে হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় মাসুদ রানার আরেক লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে। তিনি রকিব হাসানের বিদেশি থ্রিলার গোয়েন্দা কাহিনি পড়ার অভিজ্ঞতা শুনে মুগ্ধ হন। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। সপ্তাহখানেক পরে মাসুদ রানার প্লট নিয়ে হাজির হন সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনীতে। শুরু হলো সেবায় পথচলা।
উল্লেখ্য, রকিব হাসানের এই উদ্বৃতিগুলো বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে তার দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত।