নকলকারীদের কায়দাতেই নকল ঘড়ির দাপট কমাতে চাইছে রোলেক্স!
নিজেদের পুরোনো বা 'সেকেন্ড হ্যান্ড' ঘড়ি বিক্রির কর্মসূচিতে খুব একটা লাভের মুখ দেখছে না রোলেক্স। তবে বিষয়টি নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় এই ঘড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। কারণ, তাদের কাছে মুনাফার চেয়ে প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। মূলত ঘড়ি কেনাবেচায় নকলকারীদের দৌরাত্ম্য ও নকল ঘড়ির দাপট কমাতেই এই পথে হাঁটছে তারা।
রোলেক্স দেখেছে, বিশ্বজুড়ে তাদের পুরোনো ঘড়ির বাজার শত কোটি ডলারের। কিন্তু সেখানে নকল ঘড়ির ছড়াছড়ি। এসব বন্ধ করতেই তিন বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে 'সার্টিফায়েড প্রি-ওনড' বা পুরোনো ঘড়ি বিক্রির কর্মসূচি চালু করে কোম্পানিটি।
ডেটা অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান 'ওয়াচচার্টস'-এর তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে রোলেক্সের এই কর্মসূচি থেকে ৫০ কোটি ডলারের বেশি আয়ের আশা করা হচ্ছে। রোলেক্সের অন্যতম অনুমোদিত ডিলার 'ওয়াচেস অব সুইজারল্যান্ড' বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে, তাদের বিক্রির তালিকায় এখন দ্বিতীয় অবস্থানেই রয়েছে এই 'সার্টিফায়েড' পুরোনো রোলেক্স ঘড়ি।
মজার বিষয় হলো, রোলেক্সের কিছু নির্দিষ্ট মডেলের পুরোনো ঘড়ির দাম এখন একদম নতুন ঘড়ির চেয়েও বেশি। এর কারণ, চাহিদার তুলনায় নতুন ঘড়ির জোগান খুবই কম।
মরগ্যান স্ট্যানলির হিসাবে, রোলেক্স বছরে প্রায় ১২ লাখ নতুন ঘড়ি বিক্রি করে। কিন্তু এসব ঘড়ি কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হয়। তাই অপেক্ষার পালা শেষ করে এখনই ঘড়ি হাতে পেতে পুরোনো বাজারেই বাড়তি দাম গুনছেন শৌখিন সংগ্রাহকেরা।
উদাহরণ হিসেবে 'পেপসি' নামে পরিচিত 'রোলেক্স জিএমটি-মাস্টার ২' মডেলটির কথা বলা যায়। নীল-লাল রঙের বেজেলযুক্ত একদম নতুন একটি ঘড়ির দাম দোকানভেদে করসহ প্রায় ১২ হাজার ১৫০ ডলার।
অথচ সাধারণ রি-সেল ওয়েবসাইটে এই ঘড়িটিরই দাম চাওয়া হচ্ছে ২২ হাজার ৭৫০ ডলার। আর যখন এই ঘড়ি রোলেক্সের 'সার্টিফায়েড' ট্যাগ বা সনদ নিয়ে বিক্রি হয়, তখন এর গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৭৫০ ডলারে। অর্থাৎ, নতুনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পুরোনো এই ঘড়ি।
মরগ্যান স্ট্যানলির তথ্য বলছে, সাধারণ একটি পুরোনো রোলেক্সের তুলনায় কোম্পানির সনদ করা ঘড়ির জন্য ক্রেতারা গড়ে ২৮ শতাংশ বেশি দাম দিতেও রাজি। মূলত নকল ঘড়ি কেনার ভয় থেকেই ক্রেতারা এই বাড়তি টাকা খরচ করেন। এ ছাড়া মেকানিক্যাল ঘড়িটি ঠিকঠাক চলছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। আর এ নিশ্চয়তাটুকু দেয় খোদ রোলেক্স।
পুরোনো ঘড়ির বাজারে রোলেক্সের দাম আকাশছোঁয়া হলেও কোম্পানিটি এই খাতকে আয়ের উৎস হিসেবে দেখছে না। বরং ব্র্যান্ডের সুনাম রক্ষাই তাদের কাছে মুখ্য। তাই পুরোনো ঘড়ি বিক্রির পুরো প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে মূল লাভটা পায় 'ওয়াচেস অব সুইজারল্যান্ড' বা '১৯১৬ কোম্পানি'র মতো অনুমোদিত খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোই।
এই প্রক্রিয়ায় পুরোনো ঘড়ি সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও মেরামতের পুরো দায়িত্ব থাকে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপর। রোলেক্স শুধু সেগুলোর সার্টিফিকেশন এবং দুই বছরের ওয়ারেন্টি দেয়। এমনকি পুরোনো এসব ঘড়ির দাম কত হবে, তা-ও নির্ধারণ করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটিই; রোলেক্স নয়।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোলেক্সের এই কৌশলটি বেশ কার্যকর। এর আগে আরেক বিলাসবহুল ঘড়ি নির্মাতা 'অডেমার্স পিগুয়েট' পুরোনো ঘড়ির দাম নিজেরা নির্ধারণ করতে গিয়ে ক্রেতাদের তোপের মুখে পড়েছিল। তাই শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ব্র্যান্ডগুলোর উচিত শুধু কঠোর নীতিমালা তৈরি করে দেওয়া, আর ব্যবসার বাকিটা অন্যদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
রোলেক্সের ৯০ শতাংশ বিক্রিই হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। তাই পুরোনো ঘড়ির ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি না জড়ানো তাদের জন্য সহজ হয়েছে। এতে রোলেক্সকে অবিক্রীত পুরোনো ঘড়ি নিজেদের কাছে মজুত করার ঝুঁকিও নিতে হয় না। সেকেন্ড হ্যান্ড বাজারে দামের অস্থিরতার কারণে এটি কোম্পানির জন্য বড় একটি সুবিধা।
মূলত নিজেদের মূল বাজার ও ভাবমূর্তি রক্ষার্থেই রোলেক্সকে এই পদক্ষেপে আসতে হয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নকল হয় রোলেক্স ঘড়ি। কোনো ক্রেতা নকল ঘড়ি কিনে প্রতারিত হলে কোম্পানির সুনাম নষ্ট হয়। মরগ্যান স্ট্যানলির মতে, বিলাসবহুল ঘড়ির বাজারের ৩২ শতাংশই রোলেক্সের দখলে। এই কর্মসূচির ফলে ক্রেতারা যেমন নিশ্চিন্তে আসল ঘড়ি কিনতে পারেন, তেমনি বাজারে রোলেক্সের দামও চড়া থাকে—যা শেষ পর্যন্ত রোলেক্সের ব্র্যান্ড ভ্যালুই বাড়ায়।
