নাতি-নাতনি হওয়ার পর যেভাবে প্রবীণরা আগের চেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন

একটি শিশু জন্মের পর পরিবারের অনেক কিছু বদলে যায়। শুধু বাবা-মা নয়, দাদা-দাদি বা নানা-নানির জীবনেও আসে নতুন পরিবর্তন। হঠাৎ করেই তাদের অলস জীবন-যাপনের বদলে শুরু হয় নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা, মেঝেতে গড়াগড়ি, হাসি-আনন্দ আর খুনসুটি।
তাহলে কি নাতি-নাতনির আগমন একজন প্রবীণ ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে আসলেই কোনো পরিবর্তন আনে?
চিকিৎসাবিদরা এক্ষেত্রে ইতিবাচক তথ্যই দিয়েছেন।
নর্থওয়েল হেলথের গেরিয়াট্রিক ও প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের প্রধান এবং দ্য এজিং রেভলিউশন: দ্য হিস্ট্রি অব গেরিয়াট্রিক হেলথ কেয়ার অ্যান্ড হোয়াট রিয়েলি ম্যাটারস টু ওল্ডার অ্যাডাল্টস বইটির সহ-লেখক ডা. মারিয়া কার্নি বলেন, 'যেসব প্রবীণ নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সময় কাটান, তাদের সাহায্য করেন কিংবা গল্প বলেন, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকেন। এটি বৃদ্ধ বয়সে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।'
প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রবীণদের চিকিৎসা করা এই বিশেষজ্ঞের মতে, চিকিৎসা সাহিত্যে এই বিশ্বাসের সমর্থন রয়েছে এবং তার অভিজ্ঞতাতেও এমন অনেক উদাহরণ আছে।
তিনি বলেন, প্রবীণদের সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো—জীবনের উদ্দেশ্য অনুভব করা, সক্রিয় থাকা এবং কৃতজ্ঞ থাকা। অর্থাৎ, যারা বৃদ্ধ বয়সেও জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়, নিয়মিত সক্রিয় থাকে এবং সন্তুষ্ট থাকে; তাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকে।
শিকাগোর সেন্ট বার্নার্ড হাসপাতালের সেন্টার ফর বেটার এজিংয়ের মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা. কানরামন ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মানুষ প্রায়ই বলে থাকে যে দাদা-দাদি বা নানা-নানি হওয়া মানুষকে 'তরুণ রাখে'। নাতি-নাতনিরা প্রবীণদের জীবনে যে আনন্দ, শক্তি এবং নতুন করে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়ার মানে নিয়ে আসে, এটা মূলত তারই প্রতিফলন।
তিনি আরও বলেন, প্রবীণরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একাকীত্ব ও বিষণ্নতায় ভোগেন। নাতি-নাতনি সেই একাকীত্বের প্রাচীর ভেঙে দেয়।
তিনি আরও বলেন, 'অনেক দাদা-দাদি বা নানা-নানি বলেন যে নাতি-নাতনি হওয়ার পর তারা আরও বেশি সক্রিয়, সুখী ও জীবনমুখী হয়েছেন।'
এ ধরনের সম্পর্ক থেকে যে সংযোগ ও উদ্দেশ্য তৈরি হয়, তা বার্ধক্যের কিছু প্রভাবকে ধীর করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করে।
প্রবীণরা আগের চেয়ে সুখী হয়ে ওঠে
আইকান স্কুল অব মেডিসিন অ্যাট মাউন্ট সিনাইয়ের জেরিয়াট্রিকস ও প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. উইলিয়াম হাং বলেন, 'দাদা-দাদি বা নানা-নানি হিসেবে আপনি হয়তো নিজেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ ও সুখী মনে করবেন।'
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের নাতি-নাতনি আছে তারা সাধারণত নিজেদের স্বাস্থ্য ভালো বলে মনে করেন, বেশি সুখী থাকেন এবং অন্যদের তুলনায় কম একাকীত্ব অনুভব করেন।
হাং বলেন, তিনি এতে অবাক হন না, কারণ তার অনেক রোগীর নাতি-নাতনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে একা নাতি-নাতনির দেখাশোনা করতে হয়, তখন এই স্বাস্থ্য-সুবিধাগুলো কমে যেতে পারে।
ডা. ওয়াত্তানাসুন্তর্ন ব্যাখ্যা করেন, 'জৈবিক দিক থেকে নাতি-নাতনির সঙ্গে আবেগীয় মেলবন্ধন প্রবীণদের শরীরে অক্সিটোসিন ও এন্ডোরফিনের মতো সুখ-হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়, যা চাপ কমাতে ও আনন্দ বাড়াতে সাহায্য করে।'
তিনি বলেন, জীবনে নিজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করাও সন্তুষ্টির বড় উৎস। তাই নতুন করে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া মানুষকে নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
প্রবীণদের আগের চেয়ে সক্রিয় রাখে
শুধু আনন্দই বাড়ায় না, নাতি-নাতনিরা প্রবীণদের শারিরীক চলাফেরার পরিমাণও বাড়ায়।
ডা. কানরামন ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, 'এটা হতে পারে তদের নিয়ে পার্কে হাঁটতে যাওয়া, খেলাধূলা করা, কিংবা যে কোনোভাবে।'
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নাতি-নাতনির দেখাশোনায় যুক্ত থাকেন, তারা সমবয়সীদের তুলনায় বেশি শারীরিকভাবে সক্রিয় এবং কম অলস থাকেন।
ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, বেশি সক্রিয় থাকা দীর্ঘায়ু এবং উন্নত স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই শারীরিক সক্রিয়তা অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, হাড় ও সন্ধি মজবুত রাখে; পাশাপাশি মনও ভালো রাখে।
ডা. মারিয়া কার্নির মতে, এর কারণ বিষণ্নতার অন্যতম সেরা চিকিৎসা হলো শারীরিক সক্রিয়তা।
প্রবীণদের মস্তিষ্ককে ভালো রাখে
ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, 'নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটানো মানে নতুন কিছু শেখা, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং কল্পনাপ্রসূত খেলা বা সমস্যা সমাধানে যুক্ত হওয়া।'
তিনি বলেন, শিশুদের হোমওয়ার্কে সাহায্য করা, গল্প পড়ে শোনানো, খেলাধুলা করা কিংবা ডিজিটাল যন্ত্র চালানো—সবকিছুই মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করে এবং মানসিক কার্যকারিতা বাড়ায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটানো দাদা-দাদি বা নানা-নানিদের, বিশেষ করে নারীদের, স্মরণশক্তি ও মানসিক কার্যক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
তবে শুধু দাদা-দাদি বা নানা-নানি হওয়াই নয়, বরং সক্রিয়ভাবে নতুন কিছু শেখা, সময় মেনে চলা, খেলাধূলায় যুক্ত থাকা এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের জন্য উপকারী বলে জানান ডা. কার্নি।
প্রবীণদের সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়
প্রবীণদের জীবনে নাতি-নাতনি থাকা মানে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হওয়া এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হওয়া।
ডা. কার্নি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক যত্ন মূলত পারিবারিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই সামাজিক নেটওয়ার্ক দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।'
নাতি-নাতনির সঙ্গে নতুন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে মানুষ নতুন সংগঠন, প্রতিবেশী ও কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত হয়, যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে। এমন সম্পর্ক মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, 'পরিবার ও নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটালে সামাজিকভাবে একাকী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। নইলে দীর্ঘ সময় মস্তিষ্ক কম সক্রিয় থাকায় স্নায়বিক অবনতি ঘটতে পারে।'
গবেষণায় দেখা গেছে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আবেগীয় ও সামাজিক সম্পৃক্ততা দীর্ঘায়ু বাড়াতে সহায়ক।
যদি নাতি-নাতনি না থাকে?
যাদের নাতি-নাতনি নেই তারাও একই ধরনের উপকার পেতে পারেন। অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা নাতি-নাতনি থাকা নির্ভর নয়, বরং শারীরিক সক্রিয়তা ও সামাজিক সম্পৃক্ততার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলে এমন কিছু করা যেতে পারে, যা পরস্পরের মধ্যে সামাজিক বন্ধন তৈরি করে, একাকীত্ব কমায় এবং উদ্দেশ্যবোধ জাগায়। যেমন: স্কুল-পরবর্তী ক্লাবে মেন্টর হিসেবে স্বেচ্ছাসেবা করা, শিশুদের দাবা শেখানো, বা লাইব্রেরিতে সাহায্য করা। এমনকি হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটে স্বেচ্ছাসেবা করে নবজাতককে স্নেহ করা এবং নতুন বাবা-মাকে পরামর্শ দেওয়াও সম্ভব।
এছাড়া পরিবারের অন্যান্যদের সাহায্য করার সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
ওয়াত্তানাসুন্তর্ন বলেন, ''যদি আপনার ভাই-বোনের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের নাতি-নাতনি থাকে তবে নিজেই 'অস্থায়ী দাদা-দাদি বা নানা-নানি' হিসেবে তাদের দেখাশোনা করুন এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিন।''
তিনি বলেন, 'গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে, যারা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে নিয়মিত অর্থপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন তারা কম একাকীত্বে ভোগেন এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে; এমনকি যদি তারা নিজের নাতি-নাতনি নাও হয়।'
মূল কথা হলো, নিয়মিত মানসম্পন্ন যোগাযোগ, নিজের মূল্য উপলব্ধি করা এবং সন্তুষ্ট থাকা।
ভালোবাসা ও উত্তরাধিকার
কার্নি বলেন, দাদা-দাদি বা নানা-নানি হওয়া পরবর্তী প্রজন্মের সামনে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন দেখানোর সুযোগ। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, আলোচনা করা, প্রকৃতিতে হাঁটা, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখা, খেলা শেখানো এবং ছোটদের পছন্দের বই পড়া—এসবই শিশু ও প্রবীণ উভয়ের জন্যই উপকারী।
তিনি বলেন, 'শিশুদের সঙ্গে পরিবারের স্মৃতি, রান্নার রেসিপি ও গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক কর্মকাণ্ড শেয়ার করুন। এটি পারিবারিক ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ।'