আকাশযুদ্ধ শেষ, এবার পানির লড়াইয়ে ভারত-পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আপাতত বন্ধ হয়েছে। তবে এবার শুরু হয়েছে আরেক নতুন উত্তেজনা—সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ নিয়ে দুই দেশের পুরোনো এক লড়াই।
এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তের এপাড়ে সন্ত্রাসবাদে মদদ দিচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে ভারত সরকার জানায়, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু (ইন্দাস) পানি চুক্তি কার্যত স্থগিত রাখবে।
এই চুক্তি দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সিন্ধু নদীর পানির ওপর কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল।
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেয়ার অভিযোগে চুক্তি বাতিলের হুমকি দিলেও, পাকিস্তান তা অস্বীকার করে ভারতের পদক্ষেপকে 'যুদ্ধের ঘোষণা' বলে মন্তব্য করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য নয়। বরং দেশটির বহুদিনের ক্ষোভ—চুক্তিটি পাকিস্তানের পক্ষে পক্ষপাতিত্বপূর্ণ এবং এর ফলে ভারতের পানি চাহিদা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ভারত আশা করছে, চুক্তি পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে দেশের বিশাল জনসংখ্যার জন্য পানি ব্যবহারে সুবিধা অর্জন করা যাবে।
চুক্তি 'স্থগিত' রাখার ভারতের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তানের জন্য যে অনির্দিষ্ট শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, তা চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সম্পর্ক ভালো না হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ বন্যা বা হিমবাহ গলে যাওয়ার মতো বিপদ নিয়ে দুই দেশকেই একসঙ্গে ভাবতে হবে। নদীর পানি যদি পাকিস্তানের মানুষের জীবন বা কাজের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে, তাহলে ভারতকে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে।
'সদিচ্ছার মনোভাব'
সিন্ধু নদীর পানি ভারত ও পাকিস্তান কীভাবে ভাগাভাগি করবে, তা নিয়েই এই চুক্তি। এই নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর, পানি বণ্টনের জন্য প্রায় ৯ বছর ধরে আলোচনা চলে। বিশ্বব্যাংক মধ্যস্থতায় শেষমেশ ১৯৬০ সালে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শুরুতেই একে সদিচ্ছা ও সমঝোতার চুক্তি বলা হয়েছে।
পাকিস্তান সিন্ধু নদীর পশ্চিমের তিনটি শাখা নদীর পানি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে, ভারত একইভাবে পূর্বের তিনটি শাখা নদীর পানি ব্যবহার করতে পারে। তবে, ভারতেরও পশ্চিমের নদীগুলোর কিছু সীমিত ব্যবহার করার অধিকার আছে, যেমন সেচের জন্য পানি তোলা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা।
কৌশলগত বিশ্লেষক এবং জল ও সংঘাত বিষয়ক লেখক ব্রহ্ম চেলানির মতে, উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখার আশায় চুক্তির আওতায় সিন্ধু নদী ব্যবস্থার প্রায় ৮০ শতাংশ পানি পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি এক ধরনের 'অসাধারণ উদারতা' বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তারা বলেন, এই চুক্তি টিকে আছে কারণ এটি একটি শক্ত আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর আওতায় দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে স্থায়ী কমিশন রয়েছে, যারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। এছাড়াও, বিরোধ মেটানোর জন্য নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং সালিশি ব্যবস্থাও রয়েছে।
তবে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে এ প্রক্রিয়া সবসময় সহজ হয়নি।

১৯৯২ সালে টানা পাঁচ দিন ভারী বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়। তখন পাকিস্তান অভিযোগ তোলে যে ভারত কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বাঁধ খুলে পানি ছেড়েছে। তবে ভারত বলেছিল, প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে এটি করা জরুরি ছিল এবং তা নিয়ম মেনেই করা হয়েছে।
এখনও ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোতে ছয়টি বাঁধ রয়েছে এবং আরও নতুন বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা আছে। পাকিস্তান এ ধরনের অনেক বাঁধ প্রকল্প, যেমন কিশেনগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে।
গত এক দশকে, সিন্ধু নদ চুক্তি ক্রমশ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলার পর, ভারত পাকিস্তানের দিকে নদীর পানির প্রবাহ কমানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি।
এ চুক্তি শুধুমাত্র দুই দেশের সম্মতিতে পরিবর্তন করা যেতে পারে। তবে ভারত চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব দিলেও ভারতের সরকারি নথি এবং বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করেছে ।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের এক আলোচনায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি পারভাথানেনি হরিশ বলেছেন, পাকিস্তানের বাধাদানমূলক আচরণ ভারতকে তাদের ন্যায্য অধিকার পুরোপুরি ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।
সেই একই আলোচনায় পাকিস্তানের উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি উসমান জাদুন অভিযোগ করেছেন, ভারত নদীর পানি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ইসলামাবাদ কখনও নয়াদিল্লিকে এই পানিকে চাপে ফেলার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেবে না।
পাকিস্তানের দুশ্চিন্তা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত পাকিস্তানে পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে তেমন কোনো বড় সক্ষমতা রাখে না, আর এই ধরনের অবকাঠামো গড়ে তুলতে অনেক বছর লাগবে।
তবে, ভারতের তরফে চুক্তি থেকে কার্যত সরে যাওয়ার ঘোষণা পাকিস্তানকে কিছুটা হলেও শঙ্কায় ফেলেছে। কারণ, ভারত এখন আর নদীর পানি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে না, এমনটা জানিয়েছেন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞরা।
সিন্ধু নদীর নিচের দিকে অবস্থান করায় পাকিস্তানের কৃষিখাতের জন্য ভারতের দেওয়া তথ্য খুব জরুরি। ভারতের কাছ থেকে বরফ গলা পানি, বন্যার পানি আসার গতি, বৃষ্টিপাতের মাত্রা এবং স্লুইস গেট কখন খোলা হবে—এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা সেচের জন্য পানির চাহিদা এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করতে পারে।
সাবেক পাকিস্তানি কমিশনার শিরাজ মেমন জানিয়েছেন, বর্তমান স্থগিতাদেশের আগেও ভারত প্রয়োজনীয় নদীর পানি সংক্রান্ত তথ্যের মাত্র ৪০ শতাংশের মতোই দিচ্ছিল।
পাকিস্তানের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফজলুল্লাহ কুরেশি মনে করেন, এই তথ্য ঘাটতির কারণেই ২০২২ সালে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি, যে বন্যায় ১,৭০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয় এবং ২৪ দশমিক ৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আসন্ন বর্ষাকালে পাকিস্তানের পানি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের আরও অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কাজ করতে হবে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসান এফ. খান জানিয়েছেন, কর্মকর্তাদের আর আগের মতো ভারতের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পাওয়ার ওপর নির্ভর করা যাবে না। বরং তাদের বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করতে হবে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের জন্য পানি ব্যবস্থাপনায় আরও দ্রুত এবং সহজে অভিযোজিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
পাকিস্তানের সাবেক কর্মকর্তা ফজলুল্লাহ কুরেশি জানান, আপাতত পানির সরবরাহ নিয়ে বড় কোনো শঙ্কা নেই। তবে যদি দুই দেশের মধ্যে চুক্তি কার্যক্রম আরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে, তাহলে এর প্রভাব কৃষি এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে।
ভারত কী চায়?
চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের সামনে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের একটি নতুন সুযোগ পেয়েছেন।
সম্প্রতি এক সমাবেশে মোদি বলেন, 'আমরা শুধু এটুকু বলেছি যে আমরা চুক্তি স্থগিত রেখেছি। আর ওরা ঘামতে শুরু করেছে।'
রাজনৈতিক কথাবার্তা বাদ দিয়ে, ভারতের পানির প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ। কিন্তু দেশটির জলসম্পদ মাত্র ৪ শতাংশ।
নাসার তথ্য অনুযায়ী, আরবীয় জলাধারের পরই সিন্ধু অববাহিকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক চাপের মুখে থাকা ভূগর্ভস্থ জলাশয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, এই বছর ভারত জাপানকে পিছিয়ে রেখে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথে রয়েছে। সিন্ধু নদীর জল প্রধানত দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যবহার হলেও, এটি কাশ্মীরের বিদ্যুতায়ন, কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, নদীর পাশের গম চাষেও ব্যাপকভাবে সেচকাজে এই পানি ব্যবহৃত হয়।
সরকারি নথি অনুযায়ী, ভারত এখনও পূর্বাঞ্চলের নদীসমূহের জল সম্পূর্নরূপে ব্যবহার করতে পারেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেখানে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত জলাধার এবং খাল নির্মাণ হয়নি। যদিও কিছু বাঁধ ও গেটযুক্ত বাঁধ (ব্যারেজ) তৈরি হয়েছে, তবে অন্যান্য প্রস্তাবিত প্রকল্প এখনও অনুমোদন পায়নি। বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি পাকিস্তানে চলে যায়, যা সেখানে কৃষির কাজে লাগে।
আইআইটি গান্ধীনগরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ভিমল মিশ্রা বলেন, 'এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য জলবায়ু উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনকে বিবেচনা করে সমগ্র চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।'
ড. মিশ্রা আরও বলেন, 'একটি ব্যাপক আধুনিকায়ন দরকার, যা উন্নত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকি হ্রাস, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচের জন্য জলের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করবে।'
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ মাসের সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘর্ষের পর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আপাতত থেমেছে। তবে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বহুদিনের আরেকটি বিরোধ—নদীর পানি ভাগাভাগি—নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসে মদদ দিচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে ভারত সরকার জানায়, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দাস পানি চুক্তি কার্যত স্থগিত রাখবে।
এই চুক্তি দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইন্দাস নদীর পানিতে কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেয়ার অভিযোগে চুক্তি বাতিলের হুমকি দিলেও, পাকিস্তান তা অস্বীকার করে ভারতের পদক্ষেপকে 'যুদ্ধের ঘোষণা' বলে মন্তব্য করেছে।