কীভাবে ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল পাকিস্তান?

ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের আকালিয়া কালান গ্রামে ৭ মে রাতে হঠাৎ করেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা তখনো ঘুমিয়ে ছিলেন, তবে পরিচিত যুদ্ধবিমানের শব্দ নয়—এক অচেনা গর্জন আর বারবার বিস্ফোরণের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তাদের। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা বেরিয়ে দেখেন, আগুনে জ্বলতে থাকা একটি যুদ্ধবিমান নিচু হয়ে উড়ে গিয়ে কাছের ভুট্টা ক্ষেতে বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এটি একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান, আর দুর্ঘটনায় দুই গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। বিমানের দুই পাইলট প্যারাসুটে লাফিয়ে বেঁচে গেলেও আহত অবস্থায় মাঠে পড়ে ছিলেন।
ভারত সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও, এটিকে মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে চারদিনব্যাপী সংঘর্ষে ভারতের কয়েকটি যুদ্ধবিমান হারানোর ঘটনার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে তিনটি ছিল নতুন কেনা ফরাসি রাফাল। যদিও ভারত এই দাবি অস্বীকার করেছে, তবে বিদেশি প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তত পাঁচটি ভারতীয় বিমান ধ্বংস হয়েছে, যার মধ্যে একটি রাফালও থাকতে পারে। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারাও এখন বিমান হারানোর কথা স্বীকার করছেন, যদিও নির্দিষ্ট সংখ্যা বলেননি তারা। তাদের মতে, এসব ক্ষয়ক্ষতির পেছনে প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং কৌশলগত ভুল ছিল মূল কারণ।
এই স্বীকারোক্তি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে চীন। এটি ছিল প্রথম কোনো সংঘর্ষ, যেখানে চীনের উন্নত যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমা ও রুশ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোর ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে, কারণ চীন ভবিষ্যতে তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধে একই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়, সংঘর্ষে পাকিস্তানের চীনা তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য 'পিএল-১৫' মিসাইলের শ্রেষ্ঠত্বই মূল পার্থক্য তৈরি করেছে। ভারত চীনা এসব অস্ত্রের সক্ষমতাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি চীন পাকিস্তানকে আগাম সতর্কবার্তা এবং 'রিয়েল টাইম টার্গেটিং' তথ্য সরবরাহ করে সংঘর্ষে ভারসাম্য বদলে দিয়েছে বলেও মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
তবে সংঘর্ষের পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের সাফল্যকে বিবেচনায় নিলে বোঝা যায়, মূল সমস্যা হয়তো ছিল প্রথম রাতেই নিজেদের যুদ্ধবিমান ব্যবহারের পদ্ধতিতে। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক একটি বিতর্কিত মোড় আসে জুন মাসে, যখন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত প্রতিরক্ষা সংযুক্তি ক্যাপ্টেন শিব কুমারের বক্তব্যের একটি রেকর্ডিং প্রকাশ করে। তিনি ওই মাসের শুরুর দিকে এক সেমিনারে বলেছিলেন, প্রথম দিনে কিছু বিমান হারানোর একমাত্র কারণ ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশ—যাতে বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আঘাত না করে কেবল জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। তার ভাষায়, 'এই ক্ষয়ক্ষতির পর আমরা কৌশল বদলাই এবং তাদের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানতে শুরু করি।'
এই বক্তব্যের আগে, মে মাসের শেষ দিকে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল অনিল চৌহান স্বীকার করেন যে সংঘর্ষের প্রথম রাতেই কিছু বিমান হারানোর পেছনে ছিল 'কৌশলগত ভুল'। তবে তিনি জানান, দুই দিনের মাথায় এসব ভুল শুধরে নেয়া হয় এবং এরপর ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো আবার আকাশে উঠে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দূরপাল্লার হামলা চালাতে সক্ষম হয়। এই পর্যায়ে ভারত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে—তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে।

বিদেশি বিশ্লেষকদের মতে, প্রথম দিনে ভারত তার রাফালে যুদ্ধবিমানগুলোতে দূরপাল্লার 'মেটিওর' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেনি। সম্ভবত ভারতের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া সীমিত থাকবে বা তাদের যুদ্ধবিমানগুলো রাফালের নাগালের বাইরে থাকবে।
আরেকটি মত হলো, ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলোতে যথাযথ ইলেকট্রনিক জ্যামিং সিস্টেম, আপডেটেড সফটওয়্যার বা উপযুক্ত তথ্য ছিল না—যার ফলে সেগুলো পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্র থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। তৃতীয় ও আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ভারত 'মিশন ডেটা'-এর অভাবে ভুগছিল—যার ফলে পাকিস্তান কীভাবে ভারতীয় পরিকল্পনা শনাক্ত করছে, কীভাবে তা নিজেদের যুদ্ধবিমানগুলোকে জানাচ্ছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র গাইড করছে—সেটি ভারত ঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি।
ফাইট ক্লাব
ক্যাপ্টেন শিব কুমারের বক্তব্য অনুযায়ী, যদি ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো কেবল জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর রাজনৈতিক নির্দেশনার কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে এর দায়ভার মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের ওপরই বর্তায়। যদিও পাকিস্তানের সঙ্গে আগের সংঘর্ষগুলোতেও ভারত উত্তেজনা এড়াতে একই ধরনের কৌশল নিয়েছে, তবে এবারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতায় সাম্প্রতিক অগ্রগতিগুলো সেই সিদ্ধান্তে বিবেচনায় আনা হয়নি বলে সমালোচনা উঠছে।
এই ইঙ্গিত এখন বিরোধীদের মধ্যে 'তথ্য গোপনের' অভিযোগ উসকে দিচ্ছে। কংগ্রেস দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তুলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী কেন সর্বদলীয় বৈঠকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না? কেন বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া হচ্ছে না? কেন সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে?'
এদিকে, এই সংঘর্ষ ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা চুক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। চলতি বছরেই ১১৪টি নতুন যুদ্ধবিমান কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে ভারত। যেখানে ফ্রান্সের দাসোঁ, সুইডেনের সাব, আর আমেরিকার বোয়িং ও লকহিড মার্টিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। কিন্তু রাফালের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, দাসোঁ তাদের বিমানের সফটওয়্যারের সোর্স কোড ভারতকে দিচ্ছে না, ফলে নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী বিমানগুলো মানিয়ে নিতে পারছে না ভারত।
একই সময়ে চীনা কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা অন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের রাফাল বিমানের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালাচ্ছেন এবং চীনা যুদ্ধবিমান কেনার আহ্বান জানাচ্ছেন।
দাসোঁর কর্মকর্তারা এখন রাফাল যুদ্ধবিমান ইতোমধ্যে যারা কিনেছে—যেমন মিশর, ইন্দোনেশিয়া, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ক্রেতাদের আস্থাও ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে ভারতের মনোভাবকে নরম রাখতেই তারা প্রকাশ্যে খুব বেশি কিছু বলতেও পারছেন না। দাসোঁ কতটা এই ঘটনার ভারতীয় তদন্তে অংশ নিতে পারছে, তাও পরিষ্কার নয়।
ফ্রান্সের পার্লামেন্ট সদস্য মার্ক চাভেন্ত ফরাসি সরকারের কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছেন, কেন ভারতের রাফালে বিমানে থাকা 'স্পেক্ট্রা' ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা পাকিস্তানের 'পিএল-১৫' মিসাইল শনাক্ত কিংবা জ্যাম করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি জানতে চেয়েছেন, ভবিষ্যতের রাফালে বিমানে এই প্রযুক্তির উন্নত সংস্করণ থাকবে কি না।
রাফালের প্রস্তুতকারক দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এরিক ত্রাপিয়ে ১১ জুন এক ফরাসি সাময়িকীতে দেয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের তিনটি রাফাল ভূপাতিত করার দাবি 'সম্পূর্ণ মিথ্যা' বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, 'যখন পুরো ঘটনা সামনে আসবে, অনেকেই বিস্মিত হবে।' তিনি আরও দাবি করেন, রাফাল এখনো চীনের যেকোনো যুদ্ধবিমানের চেয়ে 'অনেক এগিয়ে'।
কিন্তু আকালিয়া কালান গ্রামে এসব উচ্চপর্যায়ের কূটনীতি ও প্রযুক্তির বিতর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নিহতদের পরিবারের জীবনের বাস্তবতা। বিস্ফোরণে মারা যাওয়া রাজ কুমার সিংহ রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই সন্তান ও ৭০ বছর বয়সী মা। এখনো তাদের কেউ দেখতে আসেনি, মেলেনি কোনো ক্ষতিপূরণ। এক গ্রামবাসী বলেন, 'সরকার শুধু এই দুর্ঘটনার খবর চাপা দিতে চায়।'