আলিয়া মাদ্রাসার গ্রন্থাগার, বকশিবাজারে লুকিয়ে থাকা এক রত্নভান্ডার!

মাস দুয়েক আগের কথা। ঢাকার মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার গ্রন্থাগারে দুজন বিদেশিকে দেখা গেল। তারা আগেই এই গ্রন্থাগারের খোঁজ পেয়েছিলেন, এবার এসেছেন বইয়ের সন্ধানে। তাদের একজন থমাস নিউবল্ড, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়ান। অন্যজন তার বন্ধু, ফারসি পণ্ডিত শাহিন পিশবিন। গ্রন্থাগারের সবকিছু ঘুরে দেখে তাদের মন্তব্য—"এ এক অমূল্য রত্নভান্ডার!"
তাদের সঙ্গে ছিলেন দু'জন বঙ্গসন্তান—জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তারিক ওমর আলী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহিদুল হাসান।
এই গবেষকদের আগ্রহের জায়গায় ছিল দারুণ মিল। তারা সবাই পুরোনো পুঁথি ও পান্ডুলিপির সমঝদার। বাংলা অঞ্চলের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করার আগ্রহ থেকেই তাদের মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার গ্রন্থাগারে যাওয়া।
আরবি-ফারসি পাণ্ডুলিপি নিয়ে আগেও বহু কাজ করেছেন ড. শহিদুল হাসান। সুলতানি আমলের মুদ্রা এবং মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাস তার গবেষণার প্রধান বিষয়। তার মতে—"আলিয়া মাদ্রাসার এই গ্রন্থাগার বঙ্গীয় মুসলমানদের ১৯ শতকের জ্ঞান-জগৎ বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ।"
গ্রন্থাগারটির আনুমানিক বয়স ২৪৫ বছর। এর মধ্যে ১৬৭ বছর ছিল কলকাতায়, আর ঢাকায় এসেছে ৭৮ বছর আগে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আজও টিকে আছে গ্রন্থাগারটি, ঢাকার বকশিবাজারে।

শুরুটা কোম্পানি আমলে
১৭৮০ সাল। বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে একদল মুসলমান আরজি জানায়—ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হোক। হেস্টিংস সেই অনুরোধ গ্রহণ করেন। ওই বছরই শুরু হয় মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার কার্যক্রম। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা সেই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানেরই অংশ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আসবাবপত্র এবং গ্রন্থাগারের প্রায় সব বই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রথমে জাহাজে করে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে ঢাকায়। শুরুতে লক্ষ্মীবাজারে বর্তমান কবি নজরুল কলেজের ভবনে চালু হয় পাঠদান। ১৯৬০ সালে মাদ্রাসা স্থায়ীভাবে উঠে আসে বকশিবাজারে। এখানেই স্থান পায় ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারের দুর্লভ সব কিতাব।
আজও মাদ্রাসার কক্ষগুলোতে চোখে পড়ে সেইসব প্রাচীন আসবাব। গ্রন্থাগারের আলমারি আর শ্রেণিকক্ষের অনেক চেয়ার-টেবিল আজও বহন করছে ব্রিটিশ আমলের স্মৃতি। এসব আলমারির প্রতিটিই ঠাসা দুর্লভ ও প্রাচীন সব গ্রন্থে।

তাকে তাকে সাজানো 'ধন-রত্ন'
মাদ্রাসা ভবনের দ্বিতীয় তলায় গ্রন্থাগার। ঢুকতেই নাকে আসে পুরোনো বইয়ের গন্ধ। সেই গন্ধ আরও তীব্র হয়, যখন গ্রন্থাগারিকের কক্ষ পেরিয়ে হাঁটতে থাকি সারি সারি আলমারির পাশ দিয়ে। বইয়ের এই সমুদ্রে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
বিশালাকার চারটি কক্ষ—প্রতিটিই ঠাসা বইয়ে। আলমারিগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয়, তারা যেন বলছে কলকাতার সেই পুরোনো দিনের গল্প। আর বইগুলো? কোন এক সাধক নিজ হাতে লিখেছেন গোটা বুখারি শরিফ, কেউবা ফিকাহ শাস্ত্রের বিশ্বকোষ। এসব বই-ই তার প্রমাণ।
গ্রন্থাগারিক মাহমুদা বেগম জানালেন, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় রচিত অসংখ্য দূর্লভ গ্রন্থের সংগ্রহশালা এই গ্রন্থাগার। এখানকার অনেক কিতাব মাদ্রাসার চেয়েও প্রাচীন। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান—সব বিষয়েই রয়েছে দুর্লভ বই। ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যের ধ্রুপদী গ্রন্থও বাদ যায়নি। মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।

"এই লাইব্রেরির বিশেষত্ব হলো—এখানকার বেশিরভাগ বইই এসেছে কলকাতা থেকে, ব্রিটিশ আমলের ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারা বহন করে। এটি একটি সমৃদ্ধ আর্কাইভ। যারা চেনেন, তারা বোঝেন, কত মূল্যবান বই এখানে আছে," বললেন মাহমুদা বেগম।
তিনি খুলে দেখালেন ফারসি মহাকাব্য শাহনামা-র একটি অতি পুরোনো সংস্করণ। বইটি সচিত্র। সঙ্গে বের করলেন মুঘল রাজদরবারের ছাপচিত্র নিয়ে একটি বড় এলবাম, যাতে স্থান পেয়েছে মুঘল আমলের বিভিন্ন ঘটনার চিত্রাবলি।
মাদ্রাসার কামিল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওমর ফারুক জানালেন, "কলকাতার পাশাপাশি চীন থেকেও বেশ কিছু গ্রন্থ এসেছে এখানে। কোনো কোনোটি প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। সব মিলিয়ে এত সমৃদ্ধ লাইব্রেরি মনে হয় না অন্য কোথাও আছে।"

বিশ্বখ্যাত সব গ্রন্থের সম্মিলন
স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তাশফিকুল ইসলাম নিয়মিত আসেন মাদ্রাসার গ্রন্থাগারে। এখানে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধান পেয়েছেন তিনি।
গ্রন্থাগারে রয়েছে আইন-ই-আকবরির একটি পুরোনো সংস্করণ। আছে যুক্তিবিদ্যা ও গণিত শাস্ত্রের ঐতিহাসিক গ্রন্থ—কিতাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা, কিতাব আল-ফখরি, কিতাব আল-মাহাজান, কিতাব আল-হিসাব। আইন শাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে কিতাব আল-মাবসুত, আল সারখাসি রুহুর মাওয়াহিব, আল মুয়াত্তা, কিতাব আল-আনসাব। এছাড়া আছে ইবনে সিনার কানুন ফিত তিব, কিতাব আল-শিফা; এবং প্রাচীন চিকিৎসাবিষয়ক অসংখ্য গ্রন্থ।
তাশফিকুলের মতে, কিছু বই আছে যেগুলো থেকে জানা যায় ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য। তিনি বলেন, "প্রথম দিকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় আইন, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দবিজ্ঞান, ব্যাকরণ ও ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হতো—যা আধুনিক শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি। এসব বিষয়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থাগারের বইগুলো অমূল্য সম্পদ।"

ছাত্রদের জন্য নিয়মিত পাঠের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে আলাদা পাঠকক্ষ, রাখা হয় সংবাদপত্র ও সাময়িকীও। তবে মাদ্রাসার বাইরের কেউ ব্যবহার করতে চাইলে দরকার বিশেষ অনুমতির।
"বাইরের কোনো গবেষক বা আগ্রহী পাঠক গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে চাইলে অধ্যক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। সব নথিপত্র দেখে তিনি ঠিক মনে করলে অনুমতি দেন," জানালেন গ্রন্থাগারিক মাহমুদা বেগম।
আসেন সমঝদার গবেষকেরা
মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার গ্রন্থাগার সম্পর্কে এখনও খুব বেশি মানুষের জানা নেই। তবে যারা জানেন, তাদের কাছে এর মূল্য অপরিসীম—বললেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ওবাইদুল হক। নিয়মিত দেশ-বিদেশ থেকে গবেষক ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা আসেন এই গ্রন্থাগারে।
গ্রন্থাগারিক মাহমুদা বেগম বললেন, "যারা জানেন কোনো বিশেষ গ্রন্থ এখানে পাওয়া যেতে পারে, তারাই আসেন। কারণ এখানে এমন সব কিতাব আছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। ফারসি বই পড়তে ইরান দূতাবাস থেকেও অনেকে আসেন। আগে আরও বেশি গবেষক আসতেন। করোনার পর কিছুটা কমেছে। তবে এখনও অনেকেই খোঁজ পেলে দেখতে আসেন।"

মাদ্রাসার আরবি সাহিত্য বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ শওকত ওসমান নিয়মিত আসেন গ্রন্থাগারে। ঘুরে ঘুরে তিনি দেখালেন আরবি ও ফারসিতে লেখা দুষ্প্রাপ্য সব বই। কিছু পড়ে শোনালেনও।
তিনি জানান, এখানে আছে হাতে লেখা বোখারি শরিফ, সাহাবি আনাস ইবনে মালিক (রাঃ)-এর হাদিস গ্রন্থ, প্রাচীন আরবি কবিতা এবং ফারসি কবি হাফিজ-এর কবিতার সংকলন। বললেন, "এমন বই একসময় এই দেশেও পড়া হতো, কিন্তু এখন আর খুব একটা হয় না। বেশিরভাগ বই-ই অবহেলায় পড়ে থাকে। তবে বইয়ের দাগানো অংশ আর পাশে লেখা নোট দেখেই বোঝা যায়, এগুলো আগে নিয়মিত পড়া হতো।"
বর্তমান শিক্ষার্থীদের মতে, এই গ্রন্থাগারের প্রাচীন বইগুলো পড়া তাদের জন্য কঠিন। মোহাম্মদ ওমর ফারুক বললেন, "আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, আমাদের জন্য এই বইগুলো বোঝা কঠিন হয়ে যায়। অনুবাদক বা দোভাষীর সাহায্য ছাড়া অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তাই অনেকে লাইব্রেরিতে আসতেই ভয় পান, অনলাইন থেকেই তথ্য খুঁজে নেন। কিন্তু এই জ্ঞানচর্চার দৈন্য থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।"

দরকার রক্ষণাবেক্ষণ
বছরের পর বছর ধুলো-ময়লা ও প্রাকৃতিক উপাদানের আঘাতে অনেক প্রাচীন বই ও পাণ্ডুলিপি আজ নষ্ট হওয়ার পথে। সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ওবাইদুল হক। মাত্র দু'মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি, তবে এরইমধ্যে গ্রন্থাগার ঘিরে বড় স্বপ্ন দেখছেন।
তিনি চান, পাণ্ডুলিপিগুলোর আধুনিক সংস্করণ তৈরি করে একটি ই-লাইব্রেরি গড়ে তুলতে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সচেতন মানুষদের সহযোগিতাও জরুরি বলে মনে করেন।
গ্রন্থাগারিক মাহমুদা বেগমের মতে, গ্রন্থ সংরক্ষণের সবচেয়ে ভালো উপায়—ই-বুক তৈরি। তিনি বলেন, "বয়স হলে বই নষ্ট হবেই। পাতা ছিঁড়বে, ধুলা জমবে, পোকায় কাটবে। তবে এসব প্রতিরোধের ব্যবস্থাও আছে।"

ড. শহিদুল হাসান মনে করেন, এই গ্রন্থাগারের বইগুলো সংরক্ষণ ইতিহাস চর্চার জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন বলেও জানান।
এখানকার শিক্ষার্থীরাও মনে করেন, গ্রন্থাগারটি আধুনিকায়ন করে সকলের জন্য জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তবেই দুই শতকের এই গ্রন্থাগারের আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে।
ছবি: জুনায়েত রাসেল/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড