চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি না হওয়ায় এতিমখানায় দান, লোকসানে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

ক্রেতা না পেয়ে কোরবানি পশুর বেশিরভাগ চামড়া বিভিন্ন মাদ্রাসা এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন কোরবানি দাতারা। অনেকেই গর্তে পুঁতে ফেলেছেন। আবার যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে আড়তে বিক্রি করেছেন চামড়া প্রতি ১ শ টাকা থেকে দুইশ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো এলাকার আড়তে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ পিস পশুর চামড়া এসেছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়েছে আরো দুই লাখ পিস চামড়া। আড়তে ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় কেনা হয়েছে গরু মহিষের চামড়া।
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ঈদুল আজহায় চট্টগ্রামে প্রায় ৯ লক্ষ কোরবানির পশু কোরবানির লক্ষ্যমাত্রা ছিলো। চামড়া ব্যবসায়ীরা প্রায় ৪ লক্ষ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ পিস গরু, মহিষ, ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ পিস গরু মহিষের চামড়া এবং অন্যগুলো ছাগল, ভেড়ার চামড়া। আরো প্রায় ২ লাখ চামড়া বিভিন্ন উপজেলায় চামড়াজাত করা হয়েছে। সেগুলো পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকার আড়তে পাঠানো হবে। এবার চট্টগ্রামের আড়তে প্রতিপিস চামড়া ৬০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় কেনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি প্রায় ৭ হাজার চামড়া কিনেছি। বিকাল থেকে সময় বাড়ার সাথে সাথে কমতে শুরু করেছে চামড়ার দাম। রাতে একটি চামড়া ৩ শ টাকার নিচে কেনা বেচা হয়। আড়তে চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি বিক্রেতার চেয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসা এতিমখানার সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন উপজেলা থেকে আজ রবিবার সকালেও চামড়া এসেছে। এগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।
আড়তদাররা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের আজ ( রবিবার) এবং আগামীকালও অনেকেই কোরবানি দেবেন। এসব চামড়াও আড়তে আসবে।
চট্টগ্রামে বর্তমানে প্রায় ২০০টি কাঁচা চামড়ার আড়ত রয়েছে এবং এই খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ কাজ করছেন। এক সময় শতাধিক ব্যবসায়ী থাকলেও লোকসানে পড়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। তবে বর্তমানে প্রায় ৩৫ জন বৃহৎ চামড়া ব্যবসায়ী এবার চামড়া কিনেছেন।
চট্টগ্রামে মাত্র একটি কার্যকর ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৩০-৪০ হাজার চামড়া কেনা হয়। যার ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ঢাকার ট্যানারির উপর নির্ভরশীল।
চামড়ার দাম সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কম প্রসঙ্গে ব্যবসায়রা বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই লবণযুক্ত চামড়ার নির্ধারিত দামের সঙ্গে কাঁচা চামড়ার দাম গুলিয়ে ফেলেন। ফলে বাজার পরিস্থিতি না বুঝেই বেশি দামে চামড়া কিনে পরে বিক্রিতে লোকসানে পড়েন।
চট্টগ্রাম নগরীর বালুচড়া এলাকার মিট বাজারের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে শেয়ারে ২২ টি গরু কোরবানি দেওয়া হয়। ঈদের দিন শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একজন ক্রেতাও আসেনি। কষাইরা পর্যন্ত চামড়া নিতে অস্বীকৃতি জানায়। রাত ১০ টা পর্যন্ত চামড়া নিতে কোন ক্রেতা না আসায় রাত দশটার দিকে খুলশী এলাকার একটি এতিম খানায় ফোন করলে তারা নিয়ে যায়।
চট্টগ্রাম নরগীর হালিশহর হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এলাকায় কোনো ক্রেতা আসেনি। কেবল দুই-একজন মাদ্রাসার প্রতিনিধি এসে চামড়া চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আমরা ইসলামী সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে দিয়ে দিই।
মোহাম্মদ কবির নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'আমি গত ১৫ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি চামড়া গড়ে ৪০০ টাকায় কিনেছি, অথচ আড়তদাররা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দিতে চাইছেন না। ভাবছিলাম এবার ভালো দাম পাব, কিন্তু বাস্তবে আড়তদারদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাইনি।
ঈদুল আযহার সময় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার প্রথমবারের মতো সারা দেশের মাদ্রাসা এবং এতিমখানাগুলিতে ৩০ হাজার টন বিনামূল্যে লবণ বিতরণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তবে, কোনও আনুষ্ঠানিক নীতি ছাড়াই এই উদ্যোগটি চূড়ান্ত বরাদ্দ কমিয়ে মাত্র ১১ হাজার ৫৭১ টনে নামিয়ে আনা হয়।
বিভিন্ন উপজেলায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে মৌসুমি চামড়া ক্রেতারা চামড়া সংগ্রহ করলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলেও মৌসুমি ক্রেতারা চামড়া কিনতে আসেনি। তাই বাধ্য হয়ে আশপাশে মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকেই মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন।
মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, ঈদের আগেরদিন চামড়া কেনার জন্য দুজন ব্যক্তি চামড়ার বুকিং দিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু সকালে তারা জানিয়ে দেয় চামড়া কিনবে না। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। পরে পার্শ্ববর্তী একটি মাদ্রাসায় দিয়ে দিয়েছি। আমাদের আশেপাশে প্রায় ১৩ টি গরু জবাই হয়েছে। কেউ কেউ মিঠাছরা বাজারে চামড়া নিয়ে গিয়ে একশ টাকায় বিক্রি করেছে। এবার চামড়া গত বছরের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হওয়ার কথা শোনা গেলেও পরিস্থিতি আগের বছর গুলোর তুলনায় নাজুক।
বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করেছেন। কেউ কেউ আবার ফেলেও দিয়েছেন।
সরকার ঢাকায় লবণ দেওয়া গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৬০–৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা নির্ধারণ করলেও চট্টগ্রামে বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ব্যবসায়ীদের দাবি, অধিকাংশ লেনদেনই হয়েছে এর চেয়ে অনেক কম দামে।
মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান জানান, তিনি ১৭০টি গরুর চামড়া কিনেছিলেন গড়ে ৩৫০ টাকা করে। পরে বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ২৫০ টাকায়।প্রতি চামড়ায় ১০০ টাকা করে লোকসান হয়েছে। আজ যদি আরও কম দামেও বিক্রি করতাম, কেউ নিত না। শেষ পর্যন্ত কিছু চামড়া ফেলে দিতে হয়েছে,' বলেন তিনি।