হতাশার ডিগ্রি: বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা কেন চাকরি পাচ্ছেন না?

গোপালগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রামের ছেলে আশিক আহমেদ। তার কৃষক বাবা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে পড়াশোনা করে দুঃখ-কষ্টের চক্র ভাঙবেন। বাবার স্বপ্ন পূরণে আশিকও চেষ্টা করেছেন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে ২০১৮ সালে স্নাতক হন। কিন্তু তার স্বপ্নযাত্রায় হঠাৎই ছেদ পড়ে। স্নাতক হওয়ার পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও বেকার।
ঢাকার সুফিয়া খাতুনের গল্পটাও প্রায় একই রকম। স্বামী-পরিত্যক্তা গৃহকর্মীর সন্তান সুফিয়া সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেন। এর পর চার বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও তার চাকরি জোটেনি; মায়ের আত্মত্যাগের কোনো প্রতিদান দিতে পারেননি।
আশিক বা সুফিয়ার চাকরি না পাওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। তারা স্নাতকদের এমন এক প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি চাকরি নয়, বরং দীর্ঘ অপেক্ষার টিকিট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশে শিক্ষিত বেকারদের এই সংকট দ্রুত গতিতে অন্যতম প্রধান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় চাকরির ওয়েবসাইট বিডিজবস ডটকমের তথ্য অনুসারে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ স্নাতক ৩০ বছর বয়সেও বেকার থাকেন। অথচ এই বয়সের পর সরকারি-বেসরকারি চাকরির দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সেই তুলনায় বেসরকারি (১৪ শতাংশ) ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (২৯ শতাংশ) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের ক্ষেত্রে এই হার একটু কম। এই চিত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর প্রতি চাকরির বাজারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন। অথচ দেশের বেশিরভাগ স্নাতক এসব কলেজ থেকেই বের হন।
একাডেমিক গবেষণাতেও চিত্রটি কম হতাশাজনক নয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গত ডিসেম্বরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৮ শতাংশ স্নাতক বেকার। বাকি ১৬ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন এবং ১৩ শতাংশ স্নাতক খণ্ডকালীন কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বেতনভুক্ত চাকরি পেয়েছেন মোট স্নাতকের অর্ধেকেরও কম—মাত্র ৪২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সপ্তাহে তাদের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা যায়—প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম (১.২৫ শতাংশ)। আর সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের মধ্যে (১৩.৫৪ শতাংশ)। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি তিনজন বেকারের একজন স্নাতক। অর্থাৎ দেশে প্রায় ৯ লাখ ডিগ্রিধারী বেকার রয়েছেন—যা মাত্র আট বছর আগের সংখ্যার দ্বিগুণ।
স্নাতক বেকারের মিছিল, কিন্তু পথ কোথায়?
পরিস্থিতির গতিপথ আরও উদ্বেগজনক। ২০১০ সালে স্নাতক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১.২ শতাংশ। এখন এই হার ১৩.৫ শতাংশ এবং ক্রমেই বাড়ছে। অন্য কথায়, যত বেশি স্নাতক শিক্ষাজীবন শেষ করে বেরোচ্ছেন, তাদের জন্য চাকরির সুযোগ তত কমছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০২২ সালে সতর্ক করেছিল, প্রতি বছর ৭ লাখেরও বেশি স্নাতক দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তাদের মধ্যে প্রতি ১০ জনের ৬ জনই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থী। এই কলেজগুলোর পাঠদান দুর্বল, পাঠ্যক্রম পুরোনো, আর শিল্প খাতের সঙ্গে সংযোগ সামান্যই। অথচ উচ্চশিক্ষার পরিধি কেবল বাড়ছেই—মাত্র তিন বছর আগেও যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫০টি, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৬টি; আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০১টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৬টি। কিন্তু এত তরুণ কোথায় যাবে, সে প্রশ্ন কেউ করছে না।
চাকরির চেয়ে স্নাতক বেশি
অন্যদিকে নিয়োগকর্তাদের বক্তব্য স্পষ্ট। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব স্বাভাবিক পরিবেশে একটি দেশে বছরে সর্বোচ্চ ৩ লাখ স্নাতকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। গত এক বছরে নতুন নিয়োগ প্রায় হয়নি বললেই চলে। কোম্পানিগুলো শুধু চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা মারা যাওয়া করা কর্মীদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে।'
অর্থনীতিবিদরাও এই উদ্বেগের সঙ্গে একমত। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'কর্মসংস্থান সৃষ্টির চালিকাশক্তি হলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু বাংলাদেশের ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে ধারণ করার জন্য যথেষ্ট বড় নয়।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, আসল বিপদ হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যা তৈরি করছে এবং নিয়োগকর্তাদের যা প্রয়োজন, তার মধ্যকার অমিল। 'বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক অসামঞ্জস্যের দিকে এগোচ্ছে: এখানকার শিক্ষার সঙ্গে চাকরির মিল নেই। প্রশ্নটা এখন আর দেশে যথেষ্ট স্নাতক আছে কি না, তা নয়। বরং মূল প্রশ্ন হলো, অর্থনীতির জন্য যে ধরনের মানবসম্পদ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা জোগান দিতে পারছে কি না।'
২০২২ সালে ৭ লাখ স্নাতক, ৬২ শতাংশ এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই
২০২২ সালে বাংলাদেশে ৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। তাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখই এসেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে। এসব কলেজের দুর্বল পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা আছে।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর স্নাতক হওয়া মোট ৭ লাখ ১ হাজার ৯৯৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এককভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ছিল ৬১.৭ শতাংশ। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১৫.৭ শতাংশ, ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২.৩ শতাংশ ও শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১০.৩ শতাংশ।
ইউজিসি এখনও ২০২৩ ও ২০২৪ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় এই সংখ্যাটি বর্তমানে সাড়ে ৭ লাখের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউজিসির একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন এখন প্রকাশের জন্য প্রেসে আছে। আর ২০২৪ সালের জন্য তথ্য চাওয়া হয়েছে, সেটি প্রকাশ করতে এক বছর সময় লাগবে।'
কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি
জনমিতিক কাঠামোই হতে পারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। সিপিডির ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশের মানুষের গড় বয়স মাত্র ২৬-২৭ বছর, যা কাজ করার জন্য আদর্শ বয়স। কিন্তু অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হলেও তা যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিনিয়োগের ধারা এই ধাঁধার একটি অংশ ব্যাখ্যা করে। জিডিপির অংশ হিসেবে মোট বিনিয়োগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩০.৭০ শতাংশ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৯.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যার মূল কারণ বেসরকারি বিনিয়োগে পতন। কৃষি খাত—জিডিপিতে যার অবদান এখন ১১ শতাংশেরও কম—এখনও দেশের ৪৫ শতাংশে কর্মীর কর্মসংস্থান করে, যা ছদ্ম বেকারত্ব ও স্বল্প কর্মসংস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭.৪৪ শতাংশ হলেও এখানে মাত্র ১৭.৩৮ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সেবা খাতের অবদান জিডিপির ৫১.৬২ শতাংশে হলেও এখানে ৩৮ শতাংশেরও কম কর্মীর কর্মসংস্থান হয়।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এখানে একটি বৈপরীত্য রয়েছে। মারাত্মক দক্ষতা-ঘাটতির কারণে আমরা চাকরির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছি না। এ কারণেই স্থানীয় নিয়োগকর্তারা বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন।'
শতকরা হারে কোন বিষয়ে বেকার বেশি, কোনটিতে কম
বিএ (পাশ কোর্স) স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩১ শতাংশে, যা সব বিষয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (২৩ শতাংশে), গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা (২০.৫৭ শতাংশে), বাংলা (১৮.৪৯ শতাংশে) এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (১৭.৪৫ শতাংশে)।
বিপরীতে কিছু বিষয়ে বেকারত্বের হার প্রায় নেই বললেই চলে: ইংরেজি স্নাতকদের মধ্যে মাত্র ০.১৭ শতাংশে, অর্থনীতি ও হিসাববিজ্ঞানে ০.৩৫ শতাংশে, সমাজবিজ্ঞানে ০.৬৯ শতাংশে এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে ০.৭২ শতাংশে।
অসংগতিপূর্ণ উন্নয়ন মডেল
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নয়, বরং দেশের উন্নয়ন মডেলেরও।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'এই বেকারত্ব অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। গত ১০-১৫ বছরের উন্নয়ন মডেল কর্মসংস্থানবান্ধব ছিল না। আর শিক্ষা ব্যবস্থাও চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।'
যতদিন না বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির কৌশল ও উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা—উভয়কেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারছে, ততদিন স্নাতকদের বেকারত্বের সমস্যা দেশের সমৃদ্ধির পথে দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হয়ে থাকার ঝুঁকি রয়েছে।