এক বছর ধরে স্থবিরতার পর আনুষ্ঠানিক চাকরির বাজারে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক চাকরির বাজার এক বছরের স্থবিরতার পর আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। জুলাই ও আগস্টে চাকরির বিজ্ঞাপন বেড়েছে দৃশ্যমানভাবে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই পুনরুদ্ধার এখনও বিপুল কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের মতো কাঠামোগত সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দেশে চাকরির বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে বড় অনলাইন পোর্টাল–বিডিজবসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে প্রায় ৮ হাজার চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। আগস্টে তা বেড়ে ৯ হাজারে পৌঁছাতে পারে। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গড়ে মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল, যার তুলনায় এটি লক্ষণীয় উন্নতি।
বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, "এই বছর জুলাই-আগস্টে চাকরির বিজ্ঞাপন বেড়েছে, তবে ইউএসএইডের অর্থায়ন কমে যাওয়ায় উন্নয়ন খাতে চাকরি কমেছে।"
তিনি জানান, এই উল্লম্ফন মূলত নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও খাদ্যপণ্য (ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস বা এফএমসিজি) ও তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোম্পানি বিডিজবসের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দিচ্ছে।
দেশের শীর্ষ পাঁচ পোশাক রপ্তানিকারকের একটি ডিবিএল গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার-ও পোশাক ও বস্ত্র খাতের স্থিতিশীলতার কথা নিশ্চিত করেছেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমরা নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এই বছরের মার্চে আমরা একটি গার্মেন্টস কারখানা অধিগ্রহণ করেছি এবং তাতে বিনিয়োগ করেছি ৪২৫ কোটি টাকা। আরও ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে আধুনিকায়নে, যা ৩ হাজার নতুন চাকরি তৈরি করবে।"
একইভাবে ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার জানিয়েছেন, টানা দুই বছরের সংকোচনের পর প্রতিষ্ঠানটি আবারও "স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি"-তে ফিরেছে, যদিও সম্প্রতি নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
তবে এসব ইতিবাচক ইঙ্গিতের মাঝেও শিল্পনেতারা সতর্ক মনোভাব ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান মনে করেন, বর্তমানে যে নিয়োগের ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো এক বছরের নিয়োগ-স্থবিরতার কারণে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করছে মাত্র। তিনি বলেন, "সম্ভবত এখন যে নিয়োগ আমরা দেখছি, তা কেবল সেই ঘাটতি মেটাতেই হচ্ছে।"
এটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশে যায়, মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও মালয়েশিয়ায়। বাকি প্রায় ১৫ লাখকে দেশেই চাকরি খুঁজতে হয়।
অদক্ষ শ্রমিকরা সাধারণত কারখানা, দোকান, রেস্তোরাঁ কিংবা অনানুষ্ঠানিক খাতে দিনমজুর হিসেবে কাজ জোগাড় করে নেয়। কিন্তু অনেক শিক্ষিত যুবক মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরও বেকার থেকে যায়।
এই সমস্যার গভীরতা তুলে ধরেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর গত সোমবার (২৫ আগস্ট) প্রকাশিত এক জরিপ। সেখানে বলা হয়েছে –
- অনানুষ্ঠানিকতার আধিপত্য: মোট শ্রমশক্তির মাত্র এক-পঞ্চমাংশের আনুষ্ঠানিক বেতনের চাকরি রয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মী অনানুষ্ঠানিক বা অকাঠামোগত খাতে নিয়োজিত। বিশেষত নারীরা দ্বিগুণ বঞ্চনার শিকার – অংশগ্রহণ কম এবং কর্মহীনতা বেশি।
- শিক্ষিত বেকারত্বের উত্থান: ২০২৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ লাখের বেশি, যা আগের বছরের ৭ লাখ ৯৯ হাজার থেকে অনেক বেশি। উচ্চ মাধ্যমিক পরবর্তী স্তরের শিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার একই সময়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৩.১১ শতাংশে পৌঁছেছে।
একচেটিয়া করপোরেট আধিপত্যের ঝুঁকি
শামীম এহসানের মতে, বড় কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথে বড় বাধা।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, বড় কারখানা সম্প্রসারিত হলে অনেক ছোট কারখানার উৎপাদন শোষণ করে নেয়, ফলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। যখন বড় প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রসারিত হয়, সেখানে সীমিতসংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বৃহৎ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে বন্ধ হওয়া ছোট কারখানাগুলো দক্ষ কর্মকর্তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, "যখন একটি কারখানা ৩০টি নতুন উৎপাদন লাইন যুক্ত করে, তখন এটি ছয়টি ছোট কারখানার উৎপাদন টেনে নেয়, যেগুলো শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। ওই ছয় কারখানায় ছয়জন জেনারেল ম্যানেজার, ছয়জন প্রোডাকশন ম্যানেজার এবং ছয়জন কমার্শিয়াল ম্যানেজার ছিলেন। কিন্তু সম্প্রসারিত কারখানায় এসব পদে একজন করে রাখা হয়।"
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের এই সভাপতি বলেন, "এটি শুধু পোশাক খাতেই নয় – প্রায় সব শিল্পেই ঘটছে।" এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, এমসিসিআই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন এবং চা, চামড়াসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিত্ব করে।
তিনি ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ব্যবসার উদাহরণ দিয়ে বলেন, "একসময় হাজারো মানুষ মুড়ি, চানাচুর বা চাল বিক্রি করতেন স্থানীয় বাজারে। এখন এসব ব্যবসা বড় করপোরেশনগুলো দখল করে নিয়েছে, যা লাখো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে।"
বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, বড় করপোরেশনগুলো কেবল পোশাক নয়, বস্ত্র থেকে শুরু করে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী বাজার পর্যন্ত নানা খাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, লাখ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে।
তিনি বলেন, "সরকারের উচিত ছোট ব্যবসাগুলোকে রক্ষা করার মতো নীতি গ্রহণ করা, যেমনটি অনেক দেশেই করা হয়।"
তিনি টিবিএস-কে বলেন, "সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে কীভাবে ছোট ব্যবসাকে রক্ষা করা যায়, যাতে একটি বহুমুখী ও সুস্থ চাকরির বাজার গড়ে ওঠে।"
