নিজস্ব রপ্তানিতে মার্কিন শুল্কের চাপ, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের নতুন গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ
চীনের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বর্ধিত শুল্ক ও উৎপাদন খরচের চাপ বাড়তে থাকায়—নতুন করে গতি পেয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বিনিয়োগ সম্পর্ক। দেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ বাড়লেও অ্যাপারেল খাতে তাদের মনোযোগ বাড়ছে।
খাত সশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন। বাংলাদেশে তুলনামূলক কম উৎপাদন ব্যয়, পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি, এবং ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার—এসব সুবিধা বাংলাদেশকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবমিলিয়ে গড়ে ৩৬ শতাংশ শুল্ক দিলেও—চীনের পণ্যের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৫০ শতাংশ, এই হার আরো বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে গত এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ক্রমাগত কমছে, আর ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ আরো কিছু দেশের বাড়ছে – যা চীনের অ্যাপারেল উদ্যোক্তাদের এ খাতের বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে উদ্বুদ্ধ করছে।
চীনা উদ্যোক্তারা এখন বাংলাদেশে নতুন কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি – বন্ধ বা ধুঁকে ধুঁকে চলা কারখানা ভাড়া বা কিনে নিয়ে উৎপাদন শুরু করছেন; যা তাদের নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে। দ্রুত উৎপাদনে যাওয়াও তার ফলে সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি একাধিক চীনা ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউজ ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, "গত এক বছরে ২০টিরও বেশি তৈরি পোশাক কারখানায় চীনের বিনিয়োগ এসেছে—এর মধ্যে নতুন উদ্যোগ যেমন আছে, তেমনি ভাড়ায় চালানো কারখানাও রয়েছে। আরও কয়েকটি কোম্পানি আলোচনায় আছে এবং বিনিয়োগ অনুসন্ধান জমা দিয়েছে।"
"নতুন করে বেশকিছু চীনা কোম্পানি বিনিয়োগের বিষয়ে কথা বলছে, বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিভিন্ন ইনকোয়ারি নিয়ে আসছে – যার মধ্যে একটি অংশ ভাড়ায় চালানোর জন্য," টিবিএসকে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে চীন থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৫৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ, যার মধ্যে টেক্সটাইল খাতেই ছিল ৩০.৩৮ মিলিয়ন ডলার।
বন্ধ কারখানায় নতুন প্রাণসঞ্চার
বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক মাহমুদ গ্রুপ। সম্প্রতি তাদের একটি কারখানা, যেটি গত কয়েক মাস ধরে বন্ধ বা আংশিক চলমান ছিল, চীনা কোম্পানি লিজ নিয়ে গত মাসেই উৎপাদন শুরু করেছে।
মাহমুদ গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানান, ওই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কার্যকরী মূলধন সরবরাহ করেছে এবং বিপণনের দায়িত্বও নিয়েছে। অবশ্য চীনের কোন প্রতিষ্ঠান কারখানাটি পরিচালনা করছে, বা প্রফিট শেয়ারিং কীভাবে হবে - তা জানাতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের আরেক শীর্ষ রপ্তানিকারক মাসকট গ্রুপের তিনটি কারখানা বিক্রির বিষয়ে এক চীনা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে। নাম না প্রকাশের শর্তে পোশাক শিল্পের ওই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, "আমরা জেনেছি, বড় একটি চীনা কোম্পানি মাসকটের কারখানা কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে, যদিও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।"
আর্থিক সমস্যার কারণে মাসকট গ্রুপ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছিল না। কারখানাটি বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করার চেষ্টা করছে মালিকপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে মাসকট গ্রুপের তিনটি কারখানার মালিকপক্ষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি খোরশেদ আলম জানান, "গত দুই মাসে চীনের অন্তত তিনটি টেক্সটাইল মিল বাংলাদেশে উলেন স্পিনিং মিল এবং ম্যান মেড ফাইবারের স্পিনিং মিল স্থাপনের আগ্রহ জানিয়ে আমার সঙ্গে যোাগাযোগ করেছে। তারা এখন সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। চীনের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ কম এবং শ্রমশক্তি সহজলভ্য, যা তাদের জন্য আকর্ষণীয়।"
গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, নতুন চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে অ্যাপারেল খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরো বাড়বে।
এদের মধ্যে চীনের ফ্যাশন জায়ান্ট সোহো ফ্যাশন গ্রুপ গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তাদের প্রতিনিধি অফিস উদ্বোধন করেছে।
সোহো গ্রুপের চেয়ারম্যান লি ইয়ানজো বলেন, "দ্রুতবর্ধনশীল বাজার হিসেবে বাংলাদেশে উপস্থিতি বাড়াতে পেরে আমরা উচ্ছ্বসিত। সহযোগিতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে একসঙ্গে এগোতে চাই।"
রপ্তানি অঞ্চলে বিনিয়োগ
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও বিসিসিসিআই সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ১৮টি চীনা গার্মেন্ট, টেক্সটাইল ও এসংক্রান্ত অ্যাক্সেসরিজ খাতের কোম্পানি বাংলাদেশে নতুন কারখানা চালু করেছে বা জমি লিজ চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪টি চীনা কোম্পানি জমি লিজের চুক্তি করেছে—এর মধ্যে ১০টি পোশাক, টেক্সটাইল বা আনুষঙ্গিক পণ্য উৎপাদন খাতের। ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টি সরাসরি তৈরি পোশাক খাতের।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে– হোম জয় সকস বাংলাদেশ কোম্পানি, জিংচেন টেক্সটাইল, চিক উইংস (বিডি) ইনটিমেটস, বাংলাদেশ বাওরুই টেক্সটাইল, আইএন বাটন, জিডালাই কোম্পানি, বাংলাদেশ বয়াং টেক্সটাইল, ডিং ইউ (বিডি) এন্টারপ্রাইজ, সেফটি গার্মেন্টস বিডি, এবং কাইসি গার্মেন্টস বাংলাদেশ।
এছাড়া হংকং-ভিত্তিক টেক্সটাইল চেইন হানদা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে দেশে এসেছে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাব, যারমধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ২০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।
এক্সপোর্ট জোনের বাইরে বিনিয়োগ
বিসিসিআই এর তথ্যমতে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডের বাইরেও সাম্প্রতিক সময়ে আটটি নতুন চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে পোশাক ও সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগ করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে চুনই (বিডি) টেক্সটাইল, লোটাস কমার্স, লিয়াইশেরুই ইন্টারন্যাশনাল (বাংলাদেশ), ট্রিসেন সোয়েটার, বিএসএন বাংলাদেশ ট্রেডিং কোম্পানি, চায়না বেস্ট হাউসহোল্ড প্রোডাক্টস, অ্যামিগো বাংলাদেশ, বিগ সানশাইন (বিডি) ওপিসি, এবং ওয়েকেমাইন্ড লিমিটেড।
বিসিসিআই -এর একজন কর্মকর্তা জানান, এর বাইরে যদি কোন চীনের বিনিয়োগকারী তাদের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠান না হয়ে বিনিয়োগ করে, কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় চালায়, সেই তথ্য সংগঠনটির কাছে থাকবে না। "আমাদের রেকর্ডের বাইরেও বিনিয়োগকারী থাকতে পারে" -বলেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে, যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) এই বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য দিতে পারেনি।
ইতিবাচক ভাবছেন অর্থনীতিবিদরা, সতর্ক স্থানীয় উদ্যোক্তারা
অর্থনীতিবিদরা চীনা বিনিয়োগের এই প্রবাহকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, তবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা কিছুটা সতর্ক।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগ আসা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক, কারণ এর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নতুন টেকনোলজিও আসে।"
তিনি বলেন, "চীন অনেকদিন ধরেই তাদের পোশাক উৎপাদন অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম তাদের ভালো বিকল্প হলেও বর্তমানে সেখানে এই খাতের বিনিয়োগের নেওয়ার সুযোগ কম। ফলে তারা বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে, এটাই স্বাভাবিক।"
"বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অ্যাপারেল পণ্যের গড় ট্যারিফ প্রায় ৩৬ শতাংশ, অন্যদিকে চীনা পণ্যের ওপর তা ৫০ শতাংশের মতো। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তারা এখানে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার মতো বিকল্প চিন্তা করবে" - যোগ করেন তিনি।
অবশ্য পোশাক শিল্প মালিকদের অনেকেই বেসিক গার্মেন্টস খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে বহু বছর থেকেই নিরুৎসাহিত করে আসছেন। তারা বরং গার্মেন্টসের ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি এবং উচ্চমূল্য সংযোজনকারী পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছেন।
বিজিএমইএ'র ইনামুল হক বাবলু বলেন, "আমরা চাই বাংলাদেশ যে খাতে পিছিয়ে রয়েছে, চীনের বিনিয়োগকারীরা ওইসব খাতে বিনিয়োগ করুক। কারণ বেসিক গার্মেন্টসে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।"
বিসিসিসিআই -এর খোরশেদ আলম আশঙ্কা করেন, বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতে নতুন বিনিয়োগ বিদ্যমান গ্যাস সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। কেননা চলমান কারখানাগুলোই গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে না।
তবে নতুন বিনিয়োগের চাইতে বিদ্যমান যেসব কারখানা বন্ধ রয়েছে, সেগুলোয় যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিনিয়োগে আসা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
