পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণে সুফল আসার সম্ভাবনা কম: বিশেষজ্ঞরা
পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে 'ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক' গঠনের উদ্যোগ ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংক খাতের গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বৈত শাসন দূর করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি অতীতের লুটপাট ও খেলাপি ঋণের জন্য দায়ীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ ও পলিসি থিংক অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ আয়োজিত 'রাউন্ডটেবিল ডিসকাশন অন ট্রানজিশন অব ব্যাংকিং সেক্টর ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড' শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এটি অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল্লাহ চৌধুরী কনফারেন্স রুমে।
'আরেকটি বিডিবিএল তৈরি হবে'
গোলটেবিল বৈঠকে নবম জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাকছুদুর রহমান সরকার বলেন, "ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক নামে যে একীভূতকরণ হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এটা ভালো সিদ্ধান্ত নয়। সময়ই বলে দেবে, তবে এই একীভূতকরণ নিঃসন্দেহে আরেকটি বিডিবিএল তৈরি করবে।"
তিনি বলেন, "আপনারা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠন করা হয়েছিল।"
"আমার আশঙ্কা, এই ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংকও কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের জন্য আরেকটি বোঝায় পরিণত হবে। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। যেমন– বেসিক ব্যাংক যখন বিউরোক্র্যাটদের (আমলা) অধীনে ছিল, তখন এটি দেশের অন্যতম সেরা ব্যাংক ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে আসার পরই তা আইসিইউতে চলে যায়," যোগ করেন তিনি।
সরকারি অর্থ ব্যবহার করে ব্যাংক উদ্ধার
সরকারি অর্থ ব্যবহার করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর 'বেইল আউট' বা উদ্ধার উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, "বিশ্বে সাধারণত ভালো ব্যাংক খারাপ ব্যাংকের সঙ্গে বা ভালো ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়। সব জায়গায় একটা নির্দিষ্ট ব্যাংকিং নীতি মেনে চলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, সরকারি অর্থ ব্যবহার করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট বা উদ্ধার করা হচ্ছে—এটা কোনোভাবেই সঠিক নীতি নয়। ব্যাংকগুলোকে নিজেদের আর্থিক অবস্থা নিজেদেরই ঠিক করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।"
ড. তৌফিক আহমেদ আরও বলেন, "সরকারি অর্থ দিয়ে বেসরকারি ব্যাংক উন্নয়ন বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখা ভুল নীতি। ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে। যেসব ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে না, তারা স্বাভাবিক নিয়মে বাজার থেকে বাদ পড়বে।"
"প্রত্যেক ব্যাংককে এক বছর বা দেড় বছরের মধ্যে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে হবে। কেউ তা না পারলে সরকারি অর্থ দিয়ে টিকিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই," যোগ করেন তিনি।
নীতিগত অসামঞ্জস্য ও সেবার ঘাটতি
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি দৌলত আকতার মালা বলেন, "আমাদের দেশের মুদ্রানীতি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় নেই। একদিকে সরকার রাজস্ব বাড়াতে বিভিন্ন পণ্যে কর বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে—ফলে নীতিগত এক বৈপরীত্য তৈরি হচ্ছে। এসব অসামঞ্জস্য দূর করতে মিডিয়া এনগেজমেন্ট আরও জোরদার করতে হবে।"
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, "একীভূত এই পাঁচটি ব্যাংকের ৪৫০ থানার মধ্যে ৩০০ থানায় কোনো শাখা নেই। অর্থাৎ সার্ভিস ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে যেখানে শুধু বিত্তশালী জনগোষ্ঠী বাস করেন বা যেখানে ডিপোজিট ও ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ বেশি।"
তিনি আরও বলেন, "অনেকে বলেছেন, এই মার্জারের মাধ্যমে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। অতীতে যে কারণগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয়েছে, সেসব জায়গা আমাদেরকে এবার বিশেষভাবে সমাধান করতে হবে।"
আলোচনায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. কবির আহম্মদ, গভর্নরের উপদেষ্টা ও নির্বাহী পরিচালক আহসান উল্লাহ, ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারপারসন ফারুক মঈনউদ্দীন এবং সিটিজেনস ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল লতিফ প্রমুখ।
