সংকটাপন্ন পাঁচ বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করে হচ্ছে নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা আনার লক্ষ্যে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সিদ্ধান্তের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।
পোস্টে বলা হয়, সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান—কেপিএমজি (শ্রীলঙ্কা) ও ইওয়াই (শ্রীলঙ্কা)—এর মাধ্যমে ছয়টি তফসিলি ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান যাচাই করা হয়। এসব ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, উল্লিখিত ব্যাংকগুলোর বিশাল অঙ্কের শ্রেণিকৃত ঋণ ও মূলধন ঘাটতি রয়েছে। তাই ছয়টির মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে সরকারি মালিকানায় একটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে। তবে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি'র শেয়ার মালিকানা সংক্রান্ত মামলা উচ্চ আদালতে চলমান থাকায় এটিকে একীভূতকরণের বাইরে রাখা হয়েছে।
পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারল্য সহায়তা দেওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি; বরং তাদের তারল্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে। মূলধন ঘাটতি, শ্রেণীকৃত ঋণ ও বিনিয়োগের হার, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব ব্যাংক আমানতকারী ও পাওনাদারদের দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে ব্যাংকিং খাতে জনআস্থা নষ্ট হচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
উল্লেখিত পাঁচটি ব্যাংকের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সম্ভাবনা না থাকায় আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য 'ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫' অনুযায়ী দ্রুত রেজল্যুশন প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নতুন শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রেজল্যুশনের আওতাধীন পাঁচটি ব্যাংক হবে 'হস্তান্তরকারী ব্যাংক' এবং সরকার প্রতিষ্ঠিত নতুন ব্যাংক হবে 'হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক'। প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।
এ ছাড়া, গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের বিশেষ সভায় 'রেজল্যুশন পরিকল্পনা (স্কিম) ২০২৫' অনুমোদিত হয়, যেখানে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংককে সরকারি মালিকানায় নতুন একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে, ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল (বিসিএমসি)-এর সভায় পাঁচটি সংকটাপন্ন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ব্যাংকের লোকসানের দায়ভার গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনাসহ নতুন ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকের ৪০,০০০ (চল্লিশ হাজার) কোটি টাকার "অনুমোদিত মূলধনের" বিপরীতে "পরিশোধিত মূলধন" হিসেবে আনুমানিক ৩৫,০০০ (পঁয়ত্রিশ হাজার) কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংকটির মূলধন বিষয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীগণের ১৫,০০০ (পনেরো হাজার) কোটি টাকার আমানত মূলধনে রূপান্তর করা যেতে পারে এবং অবশিষ্ট ২০,০০০ (বিশ হাজার) কোটি টাকা সরকার মূলধন হিসেবে প্রদান করতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সংকটাপন্ন ৫ টি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংককে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত প্রস্তাব করা হয়:
(ক) ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক পিএলসি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এই ৫ টি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক-কে মার্জার বা একীভূতকরণ করা যেতে পারে;
(খ) ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর বিধান অনুযায়ী হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের মালিক/শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা নিষ্পত্তি হবে। তাছাড়া, আইন অনুযায়ী ব্যাংকসমূহের মালিকানা দায় দ্বারা সীমিত। ফলে হস্তান্তরকারী ব্যাংকসমূহের উচ্চ মূলধন ঘাটতি ও NAV ঋণাত্নক থাকায় এ মার্জার প্রক্রিয়ায় মালিক/শেয়ারহোল্ডারগণের কোন দাবী পরিশোধের সুযোগ নেই। তবে ব্যক্তি আমানতকারীগণের জমাকৃত অর্থ ব্যাংক রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনে আমানত সুরক্ষা তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা যেতে পারে;
(গ) উল্লিখিত ৫ টি ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি নতুন শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে অর্থ বিভাগ সরকারের পক্ষে হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংকের মালিক হবে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে উক্ত মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা যেতে পারে;
(ঘ) প্রস্তাবিত নতুন শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে সরকার ২০,০০০ (বিশ হাজার) কোটি টাকা মূলধন প্রদান করতে পারে, যার মধ্যে নগদে ১০,০০০ (দশ হাজার) কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ১০,০০০ (দশ হাজার) কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করা যেতে পারে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীগণের ১৫,০০০ (পনেরো হাজার) কোটি টাকার আমানত বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলধনে রূপান্তর করা যেতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিশোধ করা যেতে পারে;
(ঙ) বিদ্যমান সরকারী মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ন্যায় প্রস্তাবিত নতুন ব্যাংক (হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক) গঠন সংক্রান্ত কার্যক্রম (আরজেএসসি নিবন্ধন, ব্যাংক লাইসেন্স গ্রহণ ইত্যাদি) ও পরিচালনা Allocation of Business Among The Different Ministries and Divisions, 1996 এর বিধান অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সম্পাদিত হতে পারে। এছাড়াও ব্যাংকটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন হবে;
(চ) উল্লিখিত সংকটাপন্ন ৫ টি ব্যাংকের মন্দ ঋণ, বিনিয়োগ ও সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী মালিক, পরিচালনা পর্ষদ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং খেলাপী ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করবে।