আত্মনির্ভরতার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার, এআইভিত্তিক কর্মসংস্থানে প্রণোদনা বাড়াবে সরকার
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে—এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, "এখন সময় এসেছে নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আত্মনির্ভরশীলতার পথে এগিয়ে যাওয়ার।"
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ বিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।
দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ভিত্তিক কাজে প্রণোদনা বাড়ানো হবে। বর্তমানে এ খাতে ৬ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়া হয়, যা আরও বাড়ানো হবে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান তিনি।
সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "আমাদের নিজেদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে—আমরা আর কারও ওপর নির্ভরশীল থাকতে চাই না। আমাদের আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। আমরা যেহেতু এখনো নির্ভরশীল, তাই যত দ্রুত সম্ভব সেই নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হওয়াই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "এটা করতে হলে আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। আত্মনির্ভরশীলতা মানে হলো বুদ্ধিমত্তা, পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্প।"
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "এটি কঠিন হলেও এর মধ্যেই আনন্দ রয়েছে। আমরা যে 'নতুন বাংলাদেশ'-এর কথা বলছি, সেটি একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ।"
তিনি আরও বলেন, "এই জাতির নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। আমাদের শক্তি হলো তরুণ প্রজন্ম ও তাদের সৃজনশীলতা—এগুলোই আমাদের মূল সম্পদ। আমাদের একটি আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে এবং দেশকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে হবে; আমরা পরাধীন হয়ে বাঁচতে চাই না।"
বাংলাদেশ আগামী বছরের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের (গ্রাজুয়েশন) যোগ্যতা অর্জন করতে যাচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা এই প্রক্রিয়া দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।
ভিসা জটিলতা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, পূর্ববর্তী সরকারের সময় থেকে চলে আসা কিছু ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। তিনি এসব জটিলতা দ্রুত সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অতিরিক্ত উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সভায় পূর্ব ইউরোপের নতুন শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টা আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট ও কসোভোর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
শফিকুল আলম বলেন, "প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেছেন, ভিসা জটিলতা যেন এসব নতুন সুযোগের পথে বাধা না হয়।"
তিনি আরও জানান, পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেক সময় ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে ভিসা আবেদন করতে হয়।
"সভায় এই বিষয়টি একাধিকবার আলোচনায় এসেছে," বলেন শফিকুল আলম। "পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং আরও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, "অবলোপনযোগ্য ঋণের (নন-পারফর্মিং লোন) পরিমাণ এখন প্রায় ২৪ শতাংশ। এটি শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতির ফল, যার প্রভাব থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি বের হতে পারিনি। তবে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে—রিজার্ভ শক্তিশালী হয়েছে, গত ১২ মাসে মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। চালের দাম বাড়ায় এটি ৭ শতাংশের নিচে নামেনি, তবে দাম আবার কমতে শুরু করেছে, এবং আমরা আরও উন্নতি আশা করছি।"
সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষর এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানান। তারা খাতভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন নিয়েও গুরুত্বারোপ করেন বলে জানান শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, "সভায় বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় মূলত এলডিসি গ্রাজুয়েশন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতির বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।"
সভায় তিন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন—ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আব্দুল মুক্তাদির, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ।
শফিকুল আলম বলেন, "আমরা আমদানি নীতিমালা নিয়েও আলোচনা করেছি। ২০২৬–২০২৮ মেয়াদের জন্য নতুন ইমপোর্ট পলিসি খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে। ভিসা-সংক্রান্ত বিষয়ও আলোচনায় এসেছে।"
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান সভায় ম্যান-মেড ফাইবার শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান। তিনি দ্রুত রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের কাজ শেষ করার আহ্বান জানান এবং আমদানির সক্ষমতা বাড়াতে আরেকটি ল্যান্ড-বেইজড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের প্রস্তাব দেন।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের প্রতিনিধি আব্দুল মুক্তাদির বলেন, বাংলাদেশকে দ্রুত অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) উৎপাদনে যেতে হবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, "দেশে বিপুলসংখ্যক বিবিএ ও এমবিএ পাস করা তরুণ আছে, কিন্তু বিজ্ঞানী তৈরি হচ্ছে না।" তিনিও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
শফিকুল আলম আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা করছে। "জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা বেশ এগিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এসব চুক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এডিবি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তা নেবে।"
তিনি আরও বলেন, "সভায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল আইসিটি খাত। এই খাতে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, যদিও অনেক কাজ দৃশ্যমান নয়। আগে এই খাতে ৬ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়া হতো। এখন এআই-ভিত্তিক কাজের জন্য ইনসেনটিভ আরও বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে, যাতে এই খাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়।"
সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এছাড়া সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমাদ তাইয়েব, এসডিজি মুখ্য সমন্বয়কারী লামিয়া মোরশেদ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।