বাসমতি চাল কার? পাকিস্তান না ভারতের?

ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত একটি বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার মাঝেই ইউরোপীয় বাণিজ্য কমিশনার মারোশ শেফচোভিচ একটি বড় সমস্যা সম্মুখীন হচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘ দানাদার, সুগন্ধি বাসমতির উৎপত্তি স্থল নিয়ে। ভারত তাদের চাপ দিচ্ছে বাসমতিকে ভারতীয় বলে স্বীকৃতি দিতে। অপরদিকে ইউরোপীয় বাণিজ্য কমিশন চায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে।
১২ সেপ্টেম্বর নিউ দিল্লিতে আলোচনার একটি পর্ব শেষ করে ফেরার পথে শেফচোভিচ স্বীকার করেন, 'অবশ্যই এটি সেই বিষয়গুলির একটি, যা তালিকায় আছে।'
এই সপ্তাহে ব্রাসেলসে নতুন আলোচনা চলছে, কারণ ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দু'পক্ষই বছর শেষ হওয়ার আগেই একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতি উভয় পক্ষকেই নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ার চাপের মধ্যে রেখেছে।
অবশ্যই, শেফচোভিচ এবং তার ভারতীয় প্রতিপক্ষের মধ্যে আলোচনার বিষয়গুলির মধ্যে বাসমতি চাল থাকবে, কারণ ভারত ইউরোপে তার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সুরক্ষিত রাখতে চায়।
কিন্তু এই স্বীকৃতি সহজে পাওয়া যাবে না। কারণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী পাকিস্তান―যারা ১৯৪৭ সালে দুই দেশের বিভাজনের পর থেকে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে ভারতের সাথে বিরোধে লিপ্ত। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাসমতিকে পাকিস্তানে উৎপত্তি বলে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তার অংশীদারদের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনায় সাধারণত এর জন্য একটি পৃথক ধারা থাকে। সমৃদ্ধ কারুশিল্প ও রান্নার ঐতিহ্যের কারণে, প্রধানত ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের কৃতিত্বে, ইউরোপের কাছে বিশ্বের সর্বাধিক জিআই রয়েছে।
বাণিজ্য আলোচনায়, ব্রাসেলস চেষ্টা করে যত বেশি সম্ভব তার পণ্যগুলোকে অন্য পক্ষের দেশে সংরক্ষিত করতে, যাতে সেই দেশে নকল প্রতিরোধ করা যায়। ফ্রান্সের শ্যাম্পেন এবং ইতালির বিখ্যাত পারমিজিয়ানো রেজিয়ানো চিজ সবচেয়ে বেশি নকল হওয়া পণ্যের মধ্যে অন্যতম।
এবং আলোচনার অন্য পক্ষ এটি মেনে নিতে পারে, তবে শর্ত হলো চুক্তিটি তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং জিআই গুলোকেও রক্ষা করবে।
যৌথ স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ
যদি কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে থাকত, তবে তারা অনেক আগেই বাসমতি চালকে ভারতীয় এবং পাকিস্তানির হিসেবে স্বীকৃতি দিত—কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়।
প্রথম দিকে পরিস্থিতি তত খারাপ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, ভারত এবং পাকিস্তান একসাথে যুক্ত হয়ে একটি মার্কিন কোম্পানি রাইসটেকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, যা ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে বাসমতি চালের পেটেন্ট পেয়েছিল। ২০০১ সালে, মার্কিন পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অফিস সেই পেটেন্ট বাতিল করে।
কয়েক বছর পর, ইউরোপে বাসমতি চালের উৎপত্তি রক্ষা করতে পাকিস্তান (ইসলামাবাদ) এবং ভারত (নিউ দিল্লি) ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে যৌথভাবে কাজ করেছিল। তারা ইউরোপীয় কমিশনের কাছে একটি যৌথ আবেদন জমা দেয় যাতে উভয়ের সংযুক্ত ঐতিহ্য স্বীকৃতি পায়, বিশেষ করে সেই বাসমতি চালের জন্য যা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে আসে।
কিন্তু ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা ও ১৬০ জন নিহতের ঘটনায় ভারত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দায়ী করেছিল। যার কারণে দুই দেশের এ যৌথ প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় ও এবং পরিস্থিতি পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে পড়ে।
বছরের দীর্ঘ অচলাবস্থা এবং উত্তেজনার পর, ভারত ২০১৮ সালে ইউরোপীয় কমিশনের কাছে জিআই রেজিস্ট্রেশনের জন্য একপাক্ষিক আবেদন জমা দেয়।
আবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই চালের বৈশিষ্ট্য হলো "অদ্ভুত সুগন্ধ, মিষ্টি স্বাদ, নরম টেক্সচার, সূক্ষ্ম বাঁক," এবং এটি ইন্দো-গঙ্গিয়ান সমভূমিতে উৎপাদিত হয়। অঞ্চলটি ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া এবং নেপালের মধ্যে বিভক্ত এবং এর মধ্যে পাঞ্জাব অঞ্চলও রয়েছে।
এর কয়েক মাস পর, পাকিস্তান ভারতের আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে, একে "বাসমতি" শব্দের একচেটিয়া ব্যবহার নিশ্চিত করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়।
উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ব্যর্থ আলোচনার পর, পাকিস্তান ২০২৩ সালে নিজস্ব জিআই আবেদন জমা দেয়, যাতে শুধু ইন্দো-গঙ্গিয়ান সমভূমিই নয়, বরং বিতর্কিত কাশ্মীরের চারটি জেলা—মিরপুর, ভিম্বার, পুনছ এবং বাগ—কেও বাসমতি চাল উৎপাদনের এলাকা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
উভয় পক্ষই একচেটিয়া স্বীকৃতির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছে। কয়েক বছরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে, ইইউ কাশ্মীরের ভৌগোলিক স্বীকৃতি সংক্রান্ত জটিল সমস্যায় ফেঁসে গেছে।
নোভাগ্রাফ আইন সংস্থার ট্রেডমার্ক বিশেষজ্ঞ মাত্তেও মারিয়ানো বলেন, 'কমিশন একটি ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত কমানোর চেষ্টা করছে।'
তিনি বলেন, 'তারা চাইলে "আগে আসলে আগে পাবেন" ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিতে পারত। কিন্তু তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সমস্যাগুলো তাদের উদ্বেগের বিষয় নয় বলে বিবেচনা করেনি।'
ইউরোনিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করা পাকিস্তান ও ভারতের উভয় পক্ষের সূত্র জানিয়েছে যে তাদের দেশ বাসমতি চালের উৎপত্তি একচেটিয়া স্বীকৃতি চাচ্ছে না। তবু, একটি যৌথ সমাধির পথে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
বৃহত্তর বাণিজ্য চুক্তি—যা অটোমোবাইল বাজার, দুগ্ধজাত পণ্য ও সরকারি ক্রয়-সহ বিস্তৃত—আলোচনার মধ্যে, ইইউ নিজেকে নাজুক পরিস্থিতিতে দেখতে পাচ্ছে।
মারিয়ানো বলেন, 'যদি কমিশন শক্ত হাতে কাজ করে, তবে এটি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যৌথ রেজিস্ট্রেশন জোর করে করাতে পারে।' তবে এটি নির্ভর করছে ভারতের জন্য বাণিজ্য চুক্তির গুরুত্বের উপর এবং ইইউ-এর কাছে জিআই আলোচনা ব্লক করার সময় আছে কিনা তার উপর নির্ভর করছে।'
আইনজীবীর মতে, ভারত যদি নিজের জন্য দরজা খুলে দিতে চায়, তাহলে ইইউ তার নিজস্ব কোম্পানিগুলিকে লাভবান করার জন্য তা কাজে লাগাতে পারে।
কিন্তু এর জন্য, কমিশনকে একজন বিচক্ষণ কৌশলবিদ হতে হবে, কারণ দিল্লির প্রতিনিধিত্ব করছেন "কঠিন আলোচকরা"। সেপ্টেম্বরে শেফকোভিচ নিজেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।