বেসরকারি হাসপাতালে রোবোটিক সার্জারি বিপ্লবের উদ্যোগ

দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোবোটিক সার্জারি চালুর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে, যার সুবাদে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের এক বড় পরিবর্তনের দোরগোড়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত।
এই উদ্যোগ স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে—যেখানে অস্ত্রোপচারে নির্ভুলতা বাড়বে, রোগীর জটিলতা কমবে এবং বিদেশে গিয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসার ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠান—ল্যাবএইড, ইউনাইটেড ও এভারকেয়ার হাসপাতাল—ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)- এর কাছে সার্জারি রোবট আমদানির অনুমতির জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে। প্রতিটি রোবটের দাম আনুমানিক ২০–২৫ কোটি টাকা। ডিডিজিএ–এর একজন মুখপাত্র ডা. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে অনুমোদন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
সরকারি সমর্থন ও অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা
সরকার এই উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দুর রহমান বলেন, দেশের হাসপাতালে রোবোটিক সার্জারি চালু করতে আমরা প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেব। "এরমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনে বিষয়ে সরকার ইতিবাচক।"
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রোবোটিক সার্জারির ফলে চিকিৎসার মান উন্নত হবে এবং সবচেয়ে বড় সুবিধা হবে—বিদেশে উন্নত সার্জারির জন্য যাওয়া রোগীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
যদিও এই প্রযুক্তির পেছনে প্রাথমিকভাবে বড় বিনিয়োগ করতে হয়, তবুও দীর্ঘমেয়াদে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের মতো অর্থনৈতিক ও ক্লিনিক্যাল সুবিধা এই খরচের তুলনায় বহুগুণ বেশি হবে বলে তারা মনে করেন।
কর মওকুফের আহ্বান
ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রোবোটিক সার্জারি শুরু করতে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলোর সাথে রোবট কেনার বিষয়ে আলোচনা করছি। এবিষয়ে পারমিশনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আমরা মৌখিকভাবে জানিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তারা মূলত ট্যাক্সের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।"
দেশে রোবোটিক সার্জারি শুরু করতে প্রথম পাঁচটি রোবট আমদানি অন্তত কর মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে ডা শামীম বলেন, "একটা রোবট কিনতে ২০–২৫ কোটি টাকা লাগবে। দেশে হয়তো চার-পাঁচটি রোবট আসবে। রোবট আমদানি ট্যাক্স থেকে সরকার আর কত টাকা পাবে? যদি সরকার ট্যাক্স মওকুফ করে, তাহলে বছরে অন্তত ৯০০ কোটি টাকা দেশের ভেতরেই থেকে যাবে।"
বিদেশে রোবোটিক সার্জারির জন্য বাংলাদেশিদের প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা ব্যয়
ডা. এ এম শামীম বলেন, ''বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ জন রোগী শুধু প্রোস্টেটের রোবটিক সার্জারির জন্য বিদেশে যায়। এতে মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। সব ধরনের রোবোটিক সার্জারি মিলিয়ে এই ব্যয় বছরে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশে রোবটিক সার্জারি চালু হলে শুধু অর্থ সাশ্রয়ই হবে না, বরং রোগীরা দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসা পাবেন।''
তিনি আরও জানান, ভারতে প্রোস্টেটের রোবোটিক সার্জারির খরচ বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, ব্যাংককে প্রায় ৬০ লাখ টাকা, আর সিঙ্গাপুরে তা পৌঁছায় ৮০ লাখ টাকায়। "আমরা হয়তো দেশে ১৫ লাখ টাকায় তা দিতে পারব।"
রোবট চালুর প্রস্তুতি
ইউনাইটেড হসপিটাল লিমিটেড -এর জেনারেল ম্যানেজার ডা. মো. ফজলেরাব্বি খান বলেন, "রোবট আমদানির জন্য আমরা তিন মাস আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করেছি। অনুমোদন পেলে রোবট কেনা হবে। আমরা চেষ্টা করছি যত কম দামে মেশিন কিনতে পারি। আমরা যদি নেগোশিয়েশন করে কম দামে মেশিন আনতে পারি তাহলে রোগীদেরও কম খরচে সার্জারি সেবা দেওয়া যাবে।"
এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসেস -এর পরিচালক আরিফ মাহমুদ বলেন, "রোবট আমদানির পারমিশনের জন্য আমরা আড়াই মাস আগে ডিজিডিএতে আবেদন করেছি। পারমিশন পেলে দ্রুত মেশিন আনার চেষ্টা করবো। বাংলাদেশেও রোগীরা এখন সচেতন, তারাও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি চান। তাই এই উদ্যোগটা মূলত রোগীদের চাহিদা থেকেই আসছে। এখনো খরচ ঠিক করা হয়নি তবে রোবোটিক সার্জারিতে খরচ প্রচলিত সার্জারির তুলনায় দেড়-দুই লাখ টাকা বেশি হতে পারে।''
ডা. শামীম জানান, রোবোটিক সার্জারির জন্য ল্যাবএইড তাদের সার্জনদের আন্তর্জাতিক সহায়তায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। তিনি বলেন, "আমরা যাদের মেশিন আনার চেষ্টা করছি, সেই কোম্পানির সাথে কথা হয়েছে প্রথম ১০টি সার্জারিতে তাদের টিম আমাদের সার্জনদের সাপোর্ট দিবে। আমাদের দেশেও রোবোটিক সার্জারির ওপর ডিগ্রি নেওয়া চিকিৎসক আছে, এবং রোবটিক সার্জারি শুরু হলে আরো জনবল তৈরি হবে।"
রোবোটিক সার্জারির সুবিধা
মায়ো ক্লিনিক–এর তথ্য অনুযায়ী, রোবোটিক সার্জারি বা রোবট-সহায়িত অস্ত্রোপচারে একটি ক্যামেরা আর্ম ও সার্জিক্যাল টুলসসহ যান্ত্রিক বাহু ব্যবহার করা হয়, যা সার্জন কনসোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই সিস্টেম উচ্চ-রেজোলিউশনের থ্রিডি ভিউ দেয়, যার ফলে খুব সামান্য কাটা বা ছিদ্রের মাধ্যমে অত্যন্ত সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়।
ডা. সরকার কামরুন জাহান ঝিনুক, ইউনাইটেড হাসপাতালের পরামর্শক ও দেশের প্রথম রোবোটিক সার্জারি ফেলো বলেন, এই প্রযুক্তি রোগী, সার্জন ও সার্বিক চিকিৎসা ফলাফলের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তিনি বলেন, "রোবোটিক সার্জারিতে বড় কাটা বা ছিদ্র প্রয়োজন হয় না। ছোট ছিদ্রের মাধ্যমেই জটিল সার্জারি করা সম্ভব, ফলে রোগীর হাসপাতালে থাকার দিন কমে আসে, দ্রুত আরোগ্য ও বাসায় ফেরা সম্ভব হয়। পাশাপাশি রোগীর কসমেটিক বেনিফিটও অনেক বেশি—কাটা-ছেঁড়ার বড় দাগ থাকে না।''
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "অনেক ডিপ ক্যাভিটিতে, যেখানে ল্যাপারোস্কোপ দিয়েও কাজ করা যায় না, সেখানে রোবোটিক ইনসট্রুমেন্ট সহজে কাজ করতে পারে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি নন-টাচ টেকনিক, ফলে সার্জন ও রোগীর সরাসরি সংস্পর্শ হয় না, ইনফেকশনের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।"
রোবোটিক সার্জারি সার্জনের কাজকেও সহজ করে তোলে বলে জানান কোরিয়া ইউনিভার্সিটি আনাম হসপিটাল থেকে ফেলোশিপ করা এই চিকিৎসক। "আগে যেখানে পাঁচ-ছয়জন সহকারী লাগত, সেখানে এখন একটি রোবটই তাদের কাজ করে দিতে পারে। এতে সার্জনের শারীরিক চাপ কমে যায় এবং অপারেশনে একিউরেসি (নির্ভুলতা) বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের ক্যান্সার সার্জারি বা হাইপ্যাক সার্জারির ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত কার্যকর," বলেন ডা. ঝিনুক।
তিনি আরও বলেন, "গাইনিকোলজি, ইউরোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি, ব্রেস্ট, কোলোরেক্টাল, এমনকি হেড-নেক ও কার্ডিয়াক সার্জারিতেও রোবটিক টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। এখনকার সার্জারিতে এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে রোবোটিক সার্জারি করা যাচ্ছে না।"
যুক্তরাষ্ট্রে ২০০০ সালে এই প্রযুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয় এবং এখন তারা ষষ্ঠ প্রজন্মের সিস্টেম ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, আমরা ২০২৫ সালে এসে প্রথম প্রজন্মের প্রযুক্তি দিয়ে শুরু করব। অথচ বিশ্বে ইতিমধ্যে ষষ্ঠ প্রজন্মের রোবোটিক সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা যদি এখন উদ্যোগ না নেই, তাহলে বিশ্বমানের চিকিৎসায় পিছিয়ে পড়ব।
ল্যাবএইডের ডা. এম এ শামীম বলেন, "প্রোস্টেট ক্যান্সারে রোবোটিক সার্জারিতে নির্ভুলতা অনেক বেশি, ইনকন্টিনেন্স বা ইউরিন ঝরে পড়ার সমস্যা প্রায় থাকে না। হাত দিয়ে সার্জারি করলে যেসব সাইড ইফেক্ট হয়, রোবোটিক সার্জারিতে তা অনেক কম। এছাড়া ওভারিতে ছোট টিউমার কাটতে গেলে হাত দিয়ে করলে অনেক সময় ওভারির গঠন নষ্ট হয়ে যায়, ফলে মেয়েটির ভবিষ্যতে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু রোবোটিক সার্জারিতে খুব নিখুঁতভাবে কাজ হয়, ওভারির গঠন ঠিক থাকে, ভবিষ্যতে গর্ভধারণ সম্ভব হয়।"
বাংলাদেশে রোবোটিক চিকিৎসার বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে এখনও নিজস্ব সার্জিক্যাল রোবট দিয়ে পূর্ণমাত্রার অস্ত্রোপচার শুরু হয়নি, তবে রোবটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। সেন্টারে ৬২টি রোবট রয়েছে, যার মধ্যে ২২টি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। এসব রোবটের মাধ্যমে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফিজিওথেরাপি, স্নায়ুবিক পুনর্বাসন এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম জানান, সরকার তিন থেকে চারটি রোবোটিক সার্জারি সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে। এই সার্জিক্যাল রোবটগুলো জেলা পর্যায়ে বিতরণ করা হবে, যাতে রোগীদের ঢাকায় আসার ঝামেলা কমে।
এর আগে ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোবট দিয়ে দুজন রোগীর হার্টে স্টেন্টিং করা হয়। এনআইসিভিডি-তে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টিতে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি পরীক্ষামূলকভাবে এক মাস ব্যবহারের জন্য ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়েছিল।
প্রতিবেশী ভারত ২০০০ সালে এআইআইএমএস হাসপাতালে প্রথম সার্জিক্যাল রোবট চালু করে এবং বর্তমানে দেশটিতে ৭০টিরও বেশি হাসপাতালে বছরে ২০ হাজারের বেশি রোবোটিক সার্জারি সম্পন্ন হয়।