নীতি জটিলতা, আমদানি সিন্ডিকেট, নকল পণ্য আটকে দিচ্ছে ৪১ হাজার কোটি টাকার মেডটেক বাজার
বাংলাদেশ এখন আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনে সক্ষম। স্থানীয় শিল্পগুলো রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, গ্লুকোমিটার, নেবুলাইজার, মবিলিটি এইড, হাসপাতালের বেড, সাকশন মেশিন, রিহ্যাবিলিটেশন সরঞ্জাম, আইসিইউ–সিসিইউ বেড, মডুলার অপারেশন থিয়েটার সিস্টেম, ভেন্টিলেটর—এমনকি কিছু ইমেজিং যন্ত্রপাতিও চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি করছে।
অথচ এরপরেও দেশের হাসপাতাল–ক্লিনিকগুলো ব্যাপকভাবে আমদানির ওপরই নির্ভর করছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, দেশে মেডিকেল ডিভাইসের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়লেও শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরেই বাংলাদেশ ৭ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৪ হাজার কোটি টাকার তুলনায় এটা অনেকটাই বেশি।
স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরেও, আমদানি নির্ভরতার এই বৈপরীত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে: যে দেশ ৩ বিলিয়ন ডলারের ওষুধশিল্প গড়ে তুলেছে—যা স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ সরবরাহ করে এবং ১৬০টির বেশি দেশে রপ্তানি করে—সেই দেশ মেডিকেল ডিভাইসে একই সাফল্য আনতে ব্যর্থ হলো কেন?
যেখানে ওষুধশিল্প এখন জাতীয় সাফল্যের প্রতীক, সেখানে স্থানীয় মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদকরা মেটাতে পারে জাতীয় চাহিদার মাত্র ১০–১৫ শতাংশ। বাকি অংশ আসে আমদানি থেকে। এই আমদানি নিয়ন্ত্রণের দুর্বল ব্যবস্থার কারণে সস্তা, নিম্নমানের ও নকল পণ্য বাজারে ঢুকে পড়ে।
এদিকে চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ার ফলে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজারেও দুই অংকের প্রবৃদ্ধি বজায় আছে। কিন্তু স্থানীয় শিল্পের জন্য উৎপাদনশীল খাতে পাওয়ারহাউজ হিসেবে উঠে দাঁড়ানোর পথ আটকে আছে—মূলত বাংলাদেশে একটি আধুনিক ও সার্বিক মেডিকেল ডিভাইস পলিসির অভাব।
এ ধরনের নীতি না থাকলে, বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় থাকে; বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে সরে যায়, আর স্থানীয় উৎপাদকরা স্কেল বা উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক সনদের মানদণ্ড অর্জনেও হিমশিম খায়।
দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল ডিভাইস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান—জেএমআই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, "১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু মেডিকেল ডিভাইস, যন্ত্রপাতি এমনকি কসমেটিকসের জন্যও ওই ধরনের কোনো নীতি আজও নেই।"
তিনি বলেন, একটি কৌশলগত রোডম্যাপ না থাকায় উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে দ্বিধায় থাকেন এবং পুরো সেক্টর আমদানিনির্ভর অবস্থায় আটকে আছে।
১৫ হাজার কোটি টাকার বাজার, প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসেস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্সের হিসাবে, এখাতে দেশীয় বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার, যার প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ১৫ শতাংশ। মোট চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ—সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে ইমেজিং ও সার্জিক্যাল মেশিন—সবই আমদানির করা হয়।
এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাজারটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ -এ উপস্থাপিত প্রক্ষেপণ অনুসারে, স্বাস্থ্যসেবা খাত ওই সময়ে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হতে পারে।
জেএমআই গ্রুপের রাজ্জাক বলেন, "ডায়াগনস্টিক ইকুইপমেন্ট, ইমেজিং মেশিন, সার্জিক্যাল সরঞ্জাম, পিপিই, আইভি সেট—আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য অপরিহার্য, কিন্তু স্থানীয় উৎপাদনে কোনো নীতিগত সমর্থন নেই।"
তিনি বলেন, "এমনকি শুধু ১০ বছরের একটি প্রণোদনামূলক নীতি—স্বল্প সুদে ঋণ, কর ছাড়, মার্কেটিং সাপোর্ট—ঘোষণা করলেই একটি টেকসই দেশজ শিল্প গড়ে উঠতে পারবে।" তার মতে, দীর্ঘদিনের "আমদানি সিন্ডিকেট" বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, যা দেশীয় শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে দমন করছে।
তিনি বলেন, শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাংলাদেশ সহজেই ভেন্টিলেটর, ডায়ালাইসিস মেশিন, ডিজিটাল এক্স-রে ইউনিট, আলট্রাসাউন্ড, ইসিজি, ইনফিউশন পাম্প, মনিটরিং সিস্টেমসহ উচ্চমানের ইকুইপমেন্ট উৎপাদন বাড়াতে পারবে।
শক্তিশালী তদারকি, কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাংলাদেশ সহজেই ভেন্টিলেটর, ডায়ালাইসিস মেশিন, ডিজিটাল এক্স-রে ইউনিট, আলট্রাসাউন্ড মেশিন, ইসিজি, ইনফিউশন পাম্প, মনিটরিং সিস্টেমসহ উচ্চমানের মেডিকেল ইকুইপমেন্ট উৎপাদন বাড়াতে পারবে বলেও জানান আবদুর রাজ্জাক।
স্যালাইন থেকে উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি
বাংলাদেশে মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালে অপসোনিন স্যালাইনের প্রথম কারখানা দিয়ে। এরপর ১৯৯৯ সালে জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস গণহারে সিরিঞ্জ উৎপাদন শুরু করে।
তারপর থেকে নিপ্রো জেএমআই, লিবরা ইনফিউশনস, প্রাণ-আরএফএল-এর গেটওয়েল, ইনসেপ্টা হসপিকেয়ার, প্রোমিক্সকো, ডিবিএল, তাইওয়ান–বাংলা মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, অ্যাকুরা বায়োটেকনোলজি এবং শেফটা মেডিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ এ খাতে প্রবেশ করে।
এখন দেশীয় শিল্পে তৈরি হচ্ছে ডায়াগনস্টিক যন্ত্রপাতি, ইমেজিং ডিভাইস, সার্জিক্যাল টুলস, পিপিই, সিরিঞ্জ, আইভি–ইনফিউশন সেট, হেমোডায়ালাইসিস টিউবিং সেট, রেসপিরেটরি কেয়ার আইটেম, ক্রিটিকাল কেয়ার কনজ্যুমেবলসহ নানা ডিভাইস।
প্রোমিক্সকো গ্রুপের চেয়ারপার্সন মৌসুমী ইসলাম বলেন, "জেএমআই গ্রুপ ৪০টির বেশি দেশে হেমোডায়ালাইসিস টিউবিং সেট রপ্তানি করে, আর প্রোমিক্সকো বাংলাদেশে আইসিইউ–এনআইসিইউ–সিসিইউ বেডের প্রায় ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে।"
স্থানীয় উৎপাদন সিরিঞ্জ, স্যালাইন ও পিপিই–এর প্রাপ্যতা বাড়িয়েছে, তবুও মোট চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশের কম জোগান দিচ্ছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি—নীতি সহায়তা
ইনসেপ্টা ২০১৭ সালে মেডিকেল ইকুইপমেন্টে প্রবেশ করে, জেলা-পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত সার্জিক্যাল স্যুচার ও ইনফিউশন সেট উৎপাদনে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু উচ্চ বিনিয়োগ, কমপ্লায়েন্সের কঠোর শর্ত এবং বিনিয়োগ থেকে আয় আসতে দীর্ঘসময় লাগার কারণে খুব কম কোম্পানিই এখাতের গভীরে প্রবেশ করে।
ইনসেপ্টা হসপিকেয়ারের প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, স্টেরাইল বা জীবাণুমুক্ত উৎপাদন লাইন স্থাপন, আইএসও ও ডিডিজিএ সার্টিফিকেশন, মাননিয়ন্ত্রণ— সবকিছুর জন্যই বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু দর-নিয়ন্ত্রণ করা সরকারি টেন্ডারের চাপ ও নকল–সস্তা আমদানির কারণে স্থানীয় শিল্পের লাভের সুযোগ কমে যায়।
বৈধ স্থানীয় উৎপাদকরা কাঁচামালে উচ্চ ভ্যাট–শুল্কের মুখোমুখি হন; অথচ আন্ডার-ইনভয়েসিং করা আমদানিকারকরা এসব খরচ এড়িয়ে যায়। বিলম্বিত ভ্যাট-রিফান্ড কার্যত কোম্পানির চলতি পুঁজির ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
এদিকে বুয়েট, বিএসএমএমইউসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর শত শত বায়োমেডিকেল প্রকৌশলী বের হলেও— দেশে উচ্চপ্রযুক্তির কাজের সংকটে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়।
উৎপাদন ব্যয় বাড়াও শিল্পে বৈচিত্র্যপূর্ণ বা নানামুখী বিনিয়োগকে মন্থর করেছে।
অপসোনিন ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহমান বলেন, "আমাদের স্যালাইন উৎপাদন চলছে, কিন্তু অন্যান্য ডিভাইস উৎপাদনে কাঁচামালের খরচ এত বেড়েছে যে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। অনেক সময় চোরাচালান অথবা আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে করা পণ্য— আমাদের উৎপাদন খরচের চেয়ে কমে বিক্রি হয়।"
নকল আমদানি ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি
শক্তিশালী দেশীয় শিল্প না থাকায় গ্রাম–পৌর এলাকায় অসংখ্য ছোট আমদানিকারক ও অনিবন্ধিত পরিবেশক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ভুল ক্যালিব্রেটেড বা নকল যন্ত্রপাতি—বিপি মনিটর থেকে শুরু করে ডায়াগনস্টিক কিট—গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ২০২২ সালে ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রচুর মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ডায়গনোস্টিক কিট জব্দ করা হয়, যেগুলোর মেয়াদ পরিবর্তন করা হয়েছিল—এমনকি ২০১০ সালের তৈরি পণ্যও পাওয়া যায়।
মিজানুর রহমান বলেন, "আমদানিকারকদের প্রায় কোনো দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি নেই। কিন্তু স্থানীয় উৎপাদকরা নানা বাধার সম্মুখীন হন।"
নিয়ন্ত্রক বাধা, তবে সম্ভাবনা অবারিত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশে মেডিকেল ডিভাইসের আমদানি–রপ্তানি ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। বেশকিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের নতুন কারখানা কর্তৃপক্ষটির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, তবে দেশে উচ্চপ্রযুক্তির ডিভাইস উৎপাদন এখনো শুরু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, ভোক্তা সুরক্ষাই আমাদের মূল লক্ষ্য। দেশে পণ্য না থাকলে কেবল তখনই জরুরিভাবে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, দেশে এখনো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন টেস্টিং ল্যাব নেই—ফলে উৎপাদকদের ব্যয়বহুল বিদেশি সার্টিফিকেশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কাঁচামালে উচ্চ শুল্কও স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়।
প্রোমিক্সকোর চেয়ারপার্সন মৌসুমী ইসলাম বলেন, "অনুমোদন পেতে দীর্ঘসময় লাগে। এছাড়া দেশে দক্ষ বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারের সংকটও শিল্পের বিকাশে বড় বাধা।"
নতুন নিয়ন্ত্রক যুগ ও সম্প্রসারণ
বাংলাদেশ ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট ২০২৩-এর মাধ্যমে দেশের বিধিবিধান ইইউ এমডিআর, ডব্লিউএইচও ও ইউএস এফডিএ মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। মৌসুমী বলেন, এটি স্থানীয় শিল্প-ভিত্তির পরিপক্বতার ইঙ্গিত।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের গেটওয়েল ব্র্যান্ড ২০২০ সালে ১৫৪ কোটি টাকার প্রাথমিক বিনিয়োগের পর তাদের মেডিকেল ডিভাইস কারখানার আরও সম্প্রসারণ করেছে।
গ্রুপের মার্কেটিং পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "আমরা মার্কেটে আসার পর থেকে প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ভালো পেয়েছি। চাহিদা বাড়ায় আমরা আমাদের প্রোডাক্ট লাইন সম্প্রসারণ করছি।"
প্রোমিক্সকো-ও রেসপিরেটরি কেয়ার, ডায়াগনস্টিক অ্যাক্সেসরিজ ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার কনজ্যুমেবলে সম্প্রসারণ করছে।
জেএমআই গ্রুপের হেমোডায়ালাইসিস টিউবিং সেট রপ্তানি সক্ষমতা দেখায়—সঠিক নীতি থাকলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজ্জাক বলেন, "আমাদের প্রযুক্তি আছে, মানবসম্পদ আছে, বাজার আছে। যা নেই তা হলো ধারাবাহিক নীতি-সহায়তা।"
