অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে পারে যে টিকা
গত সোমবার শুরু হয়েছে, ওয়ার্ল্ড অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স অ্যাওয়ারনেস উইক—যা মানবস্বাস্থ্যের সামনে থাকা সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়; আর শুরু হয় শিশুর জন্মের পরপরই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রতি ছয়টি সংক্রমণের মধ্যে একটি ঘটে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা। এএমআর বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স—এখন সংক্রমণে নবজাতক মৃত্যুর ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দায়ী।
ডব্লিউএইচওকে এএমআর বিষয়ে বৈশ্বিক সচেতনতা বাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়ার দশ বছর পর, নজরদারি বা সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও সমন্বিত প্রতিক্রিয়া কার্যত থমকে গেছে। মহামারির ঝুঁকির সঙ্গে স্পষ্ট সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, চলতি বছরের মে মাসে গৃহীত ডব্লিউএইচও প্যান্ডেমিক অ্যাগ্রিমেন্ট–এ এএমআরকে প্রায় উপেক্ষাই করা হয়েছে। সংস্থাটির দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই সংকীর্ণ—মূলত সেখানে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনের দিকে ঝোঁক থাকে, অথচ নতুন ওষুধ উন্নয়নের গতি বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। শেষ ভরসার অ্যান্টিবায়োটিকগুলোও যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেখানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো পাওয়া যায় না।
তার ওপর, এই সংকীর্ণ কাঠামো দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাস্তবতা আড়াল করে—যেখানে সংঘাত, দক্ষ চিকিৎসকের অভাব, ভেঙে পড়া অবকাঠামো, স্যানিটেশনের ঘাটতি—সব মিলিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকই হয়ে ওঠে সবচেয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিকল্প ব্যবস্থা।
উদাহরণস্বরূপ গাজার কথা বলা যায়—যেখানে ধারাবাহিক বোমাবর্ষণে হাসপাতাল, পানি শোধনাগার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফল ভয়াবহ। ২০২৩ সালের পর থেকে গাজায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার দশগুণ বেড়েছে; এবং মৃত্যুর প্রায় ৫৫ শতাংশই নবজাতক। জীবাণুনাশক যন্ত্রপাতি, অ্যান্টিবায়োটিক, এমনকি ক্লোরিন পর্যন্ত গাজায় প্রবেশে বাধা দেওয়ায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে—এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে অত্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু ও তথাকথিত সুপারবাগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ব্যাপক।
বহু দেশে সর্বজনীন টিকাদান শিশুদের পাঁচ বছরের নিচের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে এনেছে, কিন্তু নবজাতক মৃত্যুহার—অর্থাৎ জন্মের প্রথম এক মাসে মৃত্যু—একই অনুপাতে কমেনি। এই আগাম মৃত্যুর তিনটি প্রধান কারণের মধ্যে অন্য দুটি যেমন—অপরিণত শিশুর জন্ম পরবর্তী শারীরিক জটিলতা এবং সন্তান প্রসবকালীন জটিলতা—ঠিক ততটা প্রতিরোধযোগ্য নয়; কিন্তু সংক্রমণ—যেমন সেপসিস, নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস—প্রায় পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য। শুধুমাত্র নবজাতক সেপসিসই প্রতি বছর ৫০ লাখের বেশি শিশুতে দেখা দেয় এবং প্রায় ৮ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটায়।
কিন্তু আকর্ষণীয় নতুন গবেষণা একটি বাস্তবসম্মত হস্তক্ষেপের দিকে আলোকপাত করছে: শতবর্ষী ব্যাসিল কালমেট-গুয়েরিন (বিসিজি) ভ্যাকসিন—যা সস্তা, নিরাপদ এবং বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য। একাধিক র্যান্ডমাইজড ট্রায়ালে প্রমাণ মিলেছে, জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিসিজি দিলে সংক্রমণ-সম্পর্কিত মৃত্যুহার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে—এমনকি ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণুর কারণে হওয়া মৃত্যুও কমে। কিন্তু যে প্রায় ১০ কোটি নবজাতককে এই টিকা দেওয়ার কথা, তাদের বেশিরভাগই জন্মের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর গিয়ে তা পায়।
এই দেরি প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ জীবন কেড়ে নিচ্ছে এবং নিঃশব্দে চলমান এএমআর মহামারিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
বিসিজি ভ্যাকসিনটি ১৯২১ সালে যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল। তাই নবজাতক সেপসিস প্রতিরোধে এর ব্যবহার প্রথমে অস্বাভাবিকই মনে হয়—কারণ যক্ষ্মার বিকাশ ধীর এবং এটি সচরাচর নবজাতকদের মৃত্যু ঘটায় না। কিন্তু বিসিজি টিকা যক্ষ্মার বিরুদ্ধে সীমিত সুরক্ষা দিলেও এখন পরিষ্কার যে এটি নবজাতকের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকেও শক্তিশালীভাবে উদ্দীপিত করে—বিশেষত যে রোগজীবাণুগুলো নবজাতক সংক্রমণের অধিকাংশের জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে।
বিসিজির সুরক্ষা যে শুধুমাত্র টিবির বাইরেও বিস্তৃত—এ বিষয়টি প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন এর অন্যতম আবিষ্কারক আলবেয়ার কালমেট। তিনি ১৯৩১ সালে রিপোর্ট করেন, বিসিজি নেওয়া শিশুদের মৃত্যুহার অবিশ্বাস্যভাবে ৭৫ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু বিস্ময়কর এই ফল বহু বছর উপেক্ষিত ছিল; ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে গিনি–বিসাউয়ের গবেষকেরা দেখান যে বিসিজি টিকা পাওয়া শিশুদের সার্বিক মৃত্যুহার— যক্ষ্মা প্রতিরোধ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব এমন সীমার অনেক নিচে নেমে যায়।
পরে ধারাবাহিক র্যান্ডমাইজড ট্রায়াল দেখিয়েছে, জন্মের সময় বিসিজি দেওয়ায় নবজাতক মৃত্যুহার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে—মূলত প্রাণঘাতী সংক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে। এই ফলাফলকে বলা হচ্ছে ভ্যাকসিনের 'নন-প্যাসিফিক বেনিফিসিয়াল এফেক্ট —অর্থাৎ টিবির বাইরে অন্যান্য সংক্রমণের বিরুদ্ধে জন্মগত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দ্রুত ও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার জন্য "প্রশিক্ষিত" করা যাচ্ছে।
এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ নবজাতকদের জন্য—কারণ গর্ভকালীন সময়ে মাতৃদেহে সংক্রমের আক্রমণ এড়াতে তাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিকভাবেই দমিয়ে রাখা হয়। অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া এবং কম ওজনের শিশুরা আরও দুর্বল—অপরিণত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দুর্বল রোগপ্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে জন্মায়। আধুনিক সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে এসব ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে: মাতৃপুষ্টির ঘাটতি, প্রসবপূর্ব চিকিৎসা ও জরুরি সেবা না পাওয়া, সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি এবং দীর্ঘস্থায়ী গর্ভকালীন মানসিক চাপ—সব মিলিয়ে অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর হার বেড়ে যায়। (ইউনিসেফের তথ্যমতে, গাজায় প্রতি পাঁচটি শিশুর একটি অপরিণত বা কম ওজন নিয়ে জন্মাচ্ছে।)
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় র্যান্ডমাইজড ট্রায়াল—যা বিএমজে জার্নালে প্রকাশিত—বিসিজির এই নন-স্পেসিফিক উপকারিতার অখণ্ড প্রমাণ দিয়েছে। ভারতের এই গবেষণা করা হয় ৫,০০০-এর বেশি অত্যন্ত দুর্বল নবজাতকের ওপর, যাদের অনেকেই জন্মেছে অপরিণত অবস্থায় এবং যাদের সবার ওজন ছিল মাত্র ৪.৫ পাউন্ডের নিচে। ডব্লিউএইচও'র গাইডলাইনে, এমন শিশুকে জন্মের সময় টিকা দেওয়ার জন্য "অতিরিক্ত দুর্বল" ধরা হয়, ফলে টিকা অনেক সময় এক মাসেরও বেশি দেরিতে দেওয়া হয়।
গবেষণার কন্ট্রোল গ্রুপে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে একজন এক মাসের মধ্যেই মারা গেছে। কিন্তু জন্মের সময় বিসিজি প্রাপ্ত শিশুদের সার্বিক মৃত্যু ১৭ শতাংশ কমেছে। কন্ট্রোল গ্রুপে মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক ছিল সংক্রমণের কারণে—আর বিসিজি এই ঝুঁকি প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ মাত্র সাতটি শিশুকে জন্মের সময় বিসিজি দিলে একটি জীবন বাঁচানো যায়। প্রথম ৭২ ঘণ্টায়ই এ উপকার পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত করে, বিসিজি শুধু হাসপাতাল বা সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমে ছড়ানো সংক্রমণই শুধু নয়—বরং প্রসবকালীন সেপসিসের বিকাশও থামাতে পারে।
ডব্লিউএইচও এখনো এই প্রমাণকে যৌক্তিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি—যদিও তাদের নিজস্ব ২০১৬ সালের রিভিউ জানিয়েছিল, যক্ষ্মা প্রতিরোধের বাইরেও বিসিজি নবজাতকদের সার্বিক মৃত্যুহার কমায়। সেই রিভিউ ৪৯টি দেশকে জন্মের সময় সর্বজনীন বিসিজি দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বর্তমান ডব্লিউএইচও নির্দেশনা অনুযায়ী, অপরিণত বা কম ওজনের শিশুদেরই জন্মের সময় টিকা পাওয়ার সুযোগ সবচেয়ে কম। অথচ সাব-সাহারা আফ্রিকা ১৪ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ২৫ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়।
ডব্লিউএইচও'র মনিটরিংও বিজ্ঞানের চেয়ে পিছিয়ে। শিশুদের টিবি প্রতিরোধে বিসিজি জন্মের সময় দেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু ডব্লিউএইচও বিসিজি কভারেজ মাপে ১২ মাস বয়সে—যা ভুল ধারণা দেয় যে সময়মতো টিকা দেওয়া হচ্ছে। যদি এক সপ্তাহ বয়সে কভারেজ মাপা হতো, তাহলে স্বাস্থ্যকর্মীরা জন্মের পরপরই টিকা দিতে আরও উৎসাহিত হতেন—এতে যক্ষ্মা ও অন্যান্য সংক্রমণ দুটোর বিরুদ্ধেই সর্বোচ্চ সুরক্ষা পাওয়া যেত। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ২০-ডোজের ভায়াল অপচয় এড়াতে কমপক্ষে ১০টি শিশু না হলে ভায়াল খোলেন না।
তাছাড়া, সঠিক টিকাদান কৌশল অত্যন্ত জরুরি। বেশিরভাগ ভ্যাকসিন—ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিটেনাস, কোভিড—ইন্ট্রামাসকুলার দেওয়া হয়। কিন্তু বিসিজি একমাত্র ভ্যাকসিন যা ইন্ট্রাডার্মালি দিতে হয়—সঠিকভাবে দিলে একটি ছোট ফোস্কা বা প্যাপিউল তৈরি হয় এবং পরে দাগ থাকে, যা সফল ইমিউন প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন। বিসিজি পাওয়া শিশুদের মধ্যে যারা এই দাগ তৈরি করে, তাদের মৃত্যুহার দাগ না হওয়া শিশুদের তুলনায় ৩৯ শতাংশ কম। অথচ প্রশিক্ষণহীন স্বাস্থ্যকর্মীদের কারণে অনেক এলাকায় মাত্র অর্ধেক শিশুর দাগ তৈরি হয়।
এছাড়া সব বিসিজি স্ট্রেইন সমান কার্যকর নয়। বিভিন্ন দেশের ব্যবহৃত স্ট্রেইনে ইমিউন প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে ভিন্ন। ডেনিশ ও জাপানি স্ট্রেইনগুলোই প্রশিক্ষিত রোগপ্রতিরোধ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে উদ্দীপিত করে; রাশিয়ান স্ট্রেইন—যা এখনো এশিয়ার কিছু দেশে ব্যবহৃত—টিবি প্রতিরোধ ব্যতীত অন্য সংক্রমণে খুব কম বা কোনো সুরক্ষাই দেয় না, যা ভারতের আরেক গবেষণায় দেখানো হয়েছে। তাই শক্তিশালী স্ট্রেইনের ব্যবহার নিশ্চিত করাই হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এই টিকার বিস্তার রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
মহামারি–বিশেষজ্ঞ অনেকের কাছে এটি হতাশাজনক যে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে থাকা আমাদের হাতে সবচেয়ে পুরোনো টিকাগুলোর একটি—যার নন-স্পেসিফিক রোগপ্রতিরোধ শক্তিবর্ধক প্রভাব সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত—সেটিই দীর্ঘ উপেক্ষার শিকার। এর কারণ আংশিকভাবে ইতিহাসগত: টিবি-বিরোধী টিকা ও চিকিৎসায় শতাব্দীজুড়ে বিভ্রান্তিকর বৈজ্ঞানিক লড়াই, এবং টিবি–সংক্রান্ত পণ্য নিয়ে বিশাল শিল্প। যদিও বিসিজি প্রতি ডোজের দাম মাত্র ১০ সেন্ট, তবে এটি টিবিকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারে না—ফলে এটি টিবি-নির্মূল কৌশলের কেন্দ্রে কখনোই স্থান পায়নি।
অন্যদিকে, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে টিবি চিকিৎসা বিলিয়ন ডলারের বাজার। তাই বিসিজি টিকার প্রসার বাড়ালে বৈশ্বিক ওষুধ শিল্পের নিজস্ব স্বার্থে আঘাত আসতে পারে। ১৯৮০ ও '৯০–এর দশকে আফ্রিকার এইচআইভি মহামারির সময়—যখন শিশুমৃত্যু ব্যাপকহারে বেড়ে যায়—বিসিজির নন-স্পেসিফিক উপকারিতার প্রথম শক্তিশালী উপলব্ধি ঘটে। কিন্তু এসব ফলাফল আন্তর্জাতিক মহলে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। ২০০৮ সালে ডব্লিউএইচও বিশেষজ্ঞ কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা শুরু করলেও ২০১৪ সালে তারা বিভক্ত মত দেয় এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এদিকে, মানবদেহের জন্মগত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিপ্লবাত্মক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি—যা দেখিয়েছে এই ব্যবস্থা "শিখতে পারে" বা প্রশিক্ষিত হতে পারে। এটাই বিসিজির নন-স্পেসিফিক প্রভাবকে শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়। প্রশিক্ষিত রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা (বা ট্রেইনড ইমিউনিটি) ধারণাটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত: বিসিজি প্রতিরোধকারী কোষগুলোর মধ্যে এপিজেনেটিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে, যা তাদের ভবিষ্যৎ হুমকির বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় সক্ষম করে। অর্থাৎ টিকা শরীরকে জন্ম–রক্ষাকবচ দেয়।
কোভিড–১৯ মহামারির সময় ১৬টি র্যান্ডমাইজড ট্রায়াল হয়; তার মধ্যে দুটি ট্রায়াল দেখায় যে বিসিজি করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমায় এবং জীবন বাঁচায়, যখন অন্যান্য টিকায় এমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা যায়নি। এই মিশ্র ফলাফলের মূল কারণ ছিল অংশগ্রহণকারীদের মাঝপথে টিকাপ্রাপ্ত হওয়া, বিভিন্ন বিসিজি স্ট্রেইনের ব্যবহার এবং ভিন্ন ভিন্ন ডোজিং–শিডিউল। একটি ট্রায়ালে স্বাস্থ্যকর্মীরা দশটি টিকা পেলেও, যারা টিকা পাননি তারা অন্য কোনো ট্রায়ালে গিয়ে আলাদা টিকা নিয়ে ফেলেন।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বা মহামারি ঠেকাতে বিসিজি দিয়ে "ইমিউন বুস্ট" করা সম্ভব নয়—এটি টিবি প্রতিরোধের বিকল্পও নয়। কিন্তু নবজাতকদের জন্য—বিশেষ করে কম ওজন ও অপরিণত নবজাতক শিশুদের জন্য—এটি জন্মের পর প্রথম সপ্তাহেই মৃত্যুর ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে কমাতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো: এই সহজ, সস্তা, নিরাপদ টিকার নন-স্পেসিফিক উপকারিতা কেন এখনো বিশ্ব টিকানীতি বা ডব্লিউএইচও নির্দেশনায় পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়নি? কেন কম ওজন ও অপরিণত শিশুরা জন্মের সময় এটি পেতে ব্যর্থ হয়? বিজ্ঞানীরা বলছেন—নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের ভুল ধারণা, বাজেট অগ্রাধিকার, এবং টিকানীতিতে "নন-স্পেসিফিক প্রভাব" ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করতে অনীহাই এর পেছনে প্রধান কারণ।
সমীকরণটি সরল: জন্মের সময় বিসিজি দিতে পারলেই জীবন বাঁচে—তাৎক্ষণিকভাবে।
এই উপকারিতা যক্ষ্মার বিরুদ্ধে বিসিজির সুরক্ষার অনেক বাইরেও বিস্তৃত।
ডব্লিউএইচও–র গ্লোবাল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড ইউজ সার্ভেইলেন্স সিস্টেম (জিএলএএসএস) বিশ্বজুড়ে ওষুধ-প্রতিরোধী সংক্রমণ ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা নজরে রাখে। তাদের উচিত জন্মের সময় বিসিজি টিকা কীভাবে নবজাতক সেপসিস ও ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণুর কারণে মৃত্যুহার কমায় তা পর্যবেক্ষণ করা। ইমিউনাইজেশনের ডেটা এবং ল্যাব ফলাফল একত্র করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে প্রশিক্ষিত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে এএমআর মোকাবিলায় ভূমিকা রাখে।
সর্বশেষ জিএলএএসএস রিপোর্ট যথার্থভাবে এএমআর–কে বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করলেও, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে এ সমস্যার বিস্তার ও বিসিজি টিকার অপ্রয়োগিত সম্ভাবনার কথা যথেষ্টভাবে উল্লেখ করেনি।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোতে বিসিজি টিকা হতে পারে রূপান্তরমূলক। যুদ্ধক্ষেত্র এখন ওষুধ–প্রতিরোধী সংক্রমণের উর্বর ভূমি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২–এর পর পোল্যান্ডে বহুঔষধ-প্রতিরোধী বা রিফ্যাম্পিসিন-প্রতিরোধী টিবি রোগীর অর্ধেকের বেশি ছিল ইউক্রেনীয়। ইউরোপজুড়ে কার্বাপেনেম–রেজিস্ট্যান্ট সংক্রমণ বাড়ছে—যা বিস্ফোরণ–আঘাতে আহত রোগীদের ওয়ার্ড ও সংকট অঞ্চলের আইসিইউগুলোর জীবাণু–প্রোফাইলের সঙ্গে অভিন্ন। আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতের সাম্প্রতিক বৃহত্তম ট্রায়ালে দেখা গেছে, বিসিজি–টিকাপ্রাপ্ত নবজাতকদের মধ্যে কার্বাপেনেম সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। অর্থাৎ প্রশিক্ষিত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এমন জীবাণুর আক্রমণও আংশিকভাবে প্রতিহত করতে পারে।
বিসিজি টিকা প্রিটার্ম এবং কম-ওজন শিশুদের জন্যও নিরাপদ ও কার্যকর—ফলে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের জন্য এটি বিশেষভাবে উপযোগী। মানবিক সহায়তা সীমিত হলেও—যেমন দেখা গেছে গাজার মতো এলাকাতে—পোলিও টিকার মতো কর্মসূচি চালানো সম্ভব।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যর্থ হলে তা সর্বত্র ব্যর্থ হয়—একযোগে ড্রাগ–রেজিস্ট্যান্ট সংক্রমণের মহামারি সৃষ্টি করে। এএমআর আক্রান্ত নবজাতক শুধু নিজেই বেশি ঝুঁকিতে থাকে না—সে অন্যদের জন্যও হুমকি হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএআইডি ধ্বংসের পর দেশটির বৈদেশিক সহায়তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিসিজি টিকা এখনও সবচেয়ে কার্যকর, সাশ্রয়ী, এবং বাস্তবায়নযোগ্য হস্তক্ষেপগুলোর একটি—জন্মেই ওরাল পোলিও ভ্যাকসিনের সঙ্গে প্রয়োগ করলেই হয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও যুক্তি অপ্রতিরোধযোগ্য: বিসিজি এত সস্তা যে এটি অনেক দেশের বিদ্যমান টিকার বাজেট বা বৈশ্বিক পোলিও নির্মুল কর্মসূচির ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়। পরিবহন, কোল্ড–চেইন, কর্মী—সব মিলিয়েও প্রতি ডোজের খরচ ২ ডলারের কম। সেপসিসে একটি নবজাতকের মৃত্যু ঠেকাতে খরচ পড়ে ২৫ ডলারেরও নিচে—স্বাস্থ্য খাতে এমন সাশ্রয়ী বিনিয়োগ খুব কমই আছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সেপ্টেম্বরে ২০৩০ এজেন্ডার অগ্রগতি পর্যালোচনায়, প্রতিরোধযোগ্য নবজাতক মৃত্যু বন্ধের লক্ষ্যটি ছিল বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। এটি ইঙ্গিত করে যে ডব্লিউএইচও ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বিশ্ব কতটা লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে তা স্বীকারে অনীহা দেখাচ্ছে—এবং ইউএসএআইডি ভেঙে পড়ার পরিণতির মুখোমুখি হতেও দ্বিধান্বিত। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে গেলেও এসব নীতি সংশোধনের জন্য ওয়াশিংটনের অনুমোদন প্রয়োজন নেই।
বিসিজি টিকার নতুন করে ব্যবহার—নবজাতক সংক্রমণ কমাতে ও এএমআর প্রতিরোধে—বিশ্বস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরল "উইন–উইন" সুযোগ।
এটি জাতিসংঘের ২০৩০ সালের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বকে এগিয়ে নিতে পারে—প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর জীবন বাঁচিয়ে—একই সঙ্গে ওষুধ–প্রতিরোধী সংক্রমণের হুমকি কমিয়ে।
দশকের পর দশক নবজাতক মৃত্যুহার কমাতে যে ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে—তার সমাধানটি আমাদের হাতের নাগালেই ছিল প্রায় এক শতাব্দী ধরে। এখন শুধু তা প্রয়োগ করতে হবে।
