২০২৫: দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কঠিন এক বছর
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ২০২৫ ছিল অত্যন্ত কঠিন এক বছর। সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান, অর্থনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক টানাপোড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংঘাতের নেতিবাচক প্রভাব—সব মিলিয়ে অঞ্চলটি একাধিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়া থেকে উঠে আসা সবচেয়ে বড় খবরগুলো—কিছুটা বিস্ময়কর, আবার কিছু প্রত্যাশিত—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশাজনক। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে ২০২৬ সাল উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের বছর হয়ে উঠতে পারে।
পাঁচটি প্রধান ঘটনা চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়াকে সংজ্ঞায়িত করেছে বলে মনে করছেন মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো মাইকেল কুগেলম্যান, যা এখানে তুলে ধরা হলো—
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর সীমান্ত যুদ্ধবিরতির কারণে বছরটি শুরু হয়েছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ভারত—প্রমাণ উপস্থাপন না করেই—এই হামলায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলে এবং দুই সপ্তাহ পর সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালালে শুরু হয় সংঘাত।
চার দিন ধরে ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের ভূখণ্ডের গভীরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ১৯৭১ সালের পর দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়। এই সামরিক অভিযানের পাশাপাশি ব্যাপক মাত্রায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ও অপপ্রচারও ছড়ানো হয়।
১০ মে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি সহিংসতা থামালেও কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটেনি। বছর শেষে এসে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক গভীর সংকটে রয়েছে। সীমান্ত কার্যত বন্ধ, বাণিজ্য স্থগিত। দীর্ঘদিন ধরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিরল সাফল্য হিসেবে বিবেচিত সিন্ধু পানি চুক্তিও ভারত স্থগিত করেছে। এমনকি ক্রিকেটও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
উত্তেজনা নিরসনে পারমাণবিক শক্তিধর দুই বৈরী প্রতিবেশীর মাঝে সংলাপ প্রায় নেই বললেই চলে। নভেম্বর মাসে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লিতে টানা দুই দিনে সন্ত্রাসী হামলা পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এই সংঘাত বিশ্বকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক উত্তেজনা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। একই সঙ্গে এর পরবর্তী বাস্তবতা দেখিয়েছে, বহু বছর ধরে অস্বস্তিকর শান্তি বজায় থাকলেও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এখনও কতটা জটিল ও নাজুক রয়ে গেছে।
নেপালে গণঅভ্যুত্থান
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার ঘটনার এক বছরের মধ্যেই প্রতিবেশী নেপালেও একই দৃশ্যপট দেখা গেল। সেপ্টেম্বরে মূলত তরুণদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় সরকারের বিরুদ্ধে। কয়েক দিনের মধ্যেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন এবং মার্চে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির দায়িত্ব নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণার পরই এই আন্দোলনের সূচনা, যা অনেক তরুণের কাছে সেন্সরশিপ আরোপের চেষ্টা হিসেবে ধরা পড়ে। তবে বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের মূল কারণ ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থনৈতিক চাপ এবং এই ধারণা যে রাজনৈতিক শ্রেণি জনদুর্ভোগের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত।
নেপালে যা ঘটেছে, তা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল না। রাজনীতি নিয়ে তরুণদের অসন্তোষ বহু বছর ধরেই স্পষ্ট ছিল। আগামী বছর এই অসন্তোষ আবারও তীব্র হতে পারে। আন্দোলনকারীরা চায় চিরচেনা রাজনৈতিক মুখগুলোর শাসনের অবসান, আর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি নতুন দলসহ একাধিক দল মার্চের নির্বাচনের জন্য নিবন্ধনও করেছে। তবুও সম্ভাবনা রয়েছে, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় আসবে পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থারই (এস্টাব্লিশমেন্টের) প্রতিনিধিরা।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের অবনতি
কয়েক দশক ধরে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুততম বিকাশমান ও সবচেয়ে স্থিতিশীল অংশীদারত্বগুলোর একটি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতেও সম্পর্ক ভালোই চলছিল; এমনকি এবছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হোয়াইট হাউসে এক সম্মেলনে আমন্ত্রণও জানানো হয়।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভারতের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ, রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে নয়াদিল্লির ওপর প্রবল চাপ, এবং যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের হঠাৎ উষ্ণতা—সব মিলিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে নেমে যায়।
তবুও সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত ছিল, যার মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া ও নতুন ১০ বছরের প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি রয়েছে। মহাকাশ খাতেও সহযোগিতা হয়েছে—দুই দেশ যৌথভাবে একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ভারতে পলাতক ঘোষিত কয়েকজন অভিযুক্তকে আটক করেছে।
তবু যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ২০২৬ সালে প্রবেশ করবে আস্থাহীনতার আবহে। সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন বাণিজ্য চুক্তি বা ট্রাম্পের ভারত সফরের মতো কোনো আস্থা-সৃষ্টিকারী উদ্যোগ প্রয়োজন হবে।
আরেকটি আফগান শরণার্থী সংকট
চলতি বছরে অঞ্চলটির সবচেয়ে উপেক্ষিত ঘটনাগুলোর একটি ছিল পরিচিত এক মানবিক বিপর্যয়—পাকিস্তানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর নিজ সম্প্রদায় থেকে উৎখাত হয়ে আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন, এমন একটি দেশে যেখানে নতুন প্রজন্মের অনেকেরই আগে কখনো বসবাস ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফগান শরণার্থীদের প্রধান আশ্রয়স্থল পাকিস্তান ও ইরান এই জনগোষ্ঠীর প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
তবে এ বছর সংখ্যাটা ছিল বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত ২০২৫ সালে ইরান ও পাকিস্তান থেকে প্রায় ২৮ লাখ মানুষ আফগানিস্তানে ফিরে গেছে, যার মধ্যে ১৩ লাখের বেশি ছিল জোরপূর্বক বহিষ্কৃত। সবচেয়ে বড় ঢল নেমেছিল জুলাইয়ে—মাত্র ১৫ দিনে ইরান থেকে ৬ লাখের বেশি আফগান শরণার্থী ফেরত যেতে বাধ্য হয়।
ইরান ও পাকিস্তান—দুই দেশেই আফগান শরণার্থীরা ভূরাজনীতির শিকার হয়েছে। সীমান্ত সন্ত্রাস নিয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুলের উত্তেজনা পাকিস্তানে বসবাস করে আসা আফগান সম্প্রদায়কে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। আর ইরান–ইসরায়েলের সংঘাতের সময় কিছু আফগানকে ইসরায়েলি গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
আসিম মুনিরের নজিরবিহীন ক্ষমতা
পাকিস্তানে সেনাবাহিনী যে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, আর সেনাপ্রধান যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি—তা নতুন কিছু নয়। তবে চলতি বছর সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ক্ষমতা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। মে মাসে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের পরপরই তাকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়—এই সম্মান এর আগে মাত্র একজন পাকিস্তানি, সাবেক সামরিক শাসক আইয়ুব খান পেয়েছিলেন।
নভেম্বরে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস হয়, যার মাধ্যমে 'চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস' নামে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয় এবং সেটিও একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের হাতে ন্যস্ত করা হয়। সংশোধনীতে পাঁচ তারকা জেনারেলদের আজীবন বিচার-অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং মুনিরের সেনাপ্রধান হিসেবে মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে—একজন অনির্বাচিত কর্মকর্তার জন্য যা বিস্ময়কর বিশেষাধিকার।
মুনিরের উত্থান আসলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের বড় একটি প্রতিবিম্ব। সামরিক বাহিনীর আইনগতভাবে স্বীকৃত ক্ষমতা আত্মীকরণের ফলে দেশটির গণতন্ত্র ক্রমেই ম্লান হয়ে পড়ছে—আর বেসামরিক নেতৃত্ব ও সংসদ প্রায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই এই প্রক্রিয়াকে মেনে নিচ্ছে।
লেখক: মাইকেল কুগেলম্যান ফরেন পলিসি-র সাপ্তাহিক 'সাউথ এশিয়া ব্রিফ'-এর লেখক এবং আটলান্টিক কাউন্সিলে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি দক্ষিন এশিয়া নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। এর আগে তিনি উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন।
