কাজী ফার্মসের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে আসছে আলফামার্ট, বিনিয়োগ করবে ১২০ মিলিয়ন ডলার

দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী কাজী ফার্মস গ্রুপ ও জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি মিতসুবিশি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ রিটেইল প্রতিষ্ঠান (খুচরা বিক্রেতা) আলফামার্ট বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে।
এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দেশজুড়ে আধুনিক সুবিধাভিত্তিক খুচরা দোকানের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যেখানে গুরুত্ব পাবে ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি)। এফএমসিজি বলতে মূলত দ্রুত বিক্রি হয় এবং দাম তুলনামূলক কম এরকম পণ্য বোঝায় ।
উদ্যোগটির লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে বিশ্বমানের রিটেইল ব্যবসা সংস্কৃতি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পেশাদার সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চালু করা। বর্তমানে দেশের রিটেইল খাত এখনো মূলত স্থানীয় দোকান ও বিচ্ছিন্ন বিতরণব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
বুধবার (৭ অক্টোবর) ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই যৌথ উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।
দুই ধাপে ১২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই ধাপে মোট ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হবে। প্রথম ধাপে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হবে। পরবর্তী ধাপে আরও ৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এই অর্থ দিয়ে আলফামার্টের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী খুচরা দোকান, গুদাম ও লজিস্টিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
প্রথম পর্যায়ে দোকানগুলো খোলা হবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে, যেখানে বেছে নেওয়া হবে আবাসিক ও জনবহুল নগর এলাকা, যাতে ক্রেতারা সহজে দোকানে যেতে পারেন। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি জেলা শহর ও মফস্বল এলাকায় কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছে, যা বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার ধরণে নতুন মাত্রা আনতে পারে।
কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, আলফামার্টের উন্নত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর রিটেইল ব্যবস্থাই এই অংশীদারিত্বের প্রধান আকর্ষণ।
তিনি বলেন, 'আলফামার্টের সিস্টেম প্রতিটি দোকানের বিক্রয় ও মজুদের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে অনুসরণ করতে পারে। এতে পণ্যের সঠিক মজুদ বজায় থাকে এবং বিক্রয় দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।'
তিনি আরও জানান, এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে খুচরা ব্যবসা পরিচালনা, গ্রাহকসেবা ও কর্মী ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানের শ্রেষ্ঠ চর্চা চালু হবে।
আলফামার্টের বর্তমান কার্যক্রম
আলফামার্ট বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনসে প্রায় ২৭ হাজার খুচরা দোকান পরিচালনা করছে। এসব দোকানে কর্মরত আছেন এক লাখ ৫০ হাজারের বেশি কর্মী, যাদের প্রায় ৪০ শতাংশ নারী। প্রতিষ্ঠানটি ইন্দোনেশিয়ার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান ও টেকসই রিটেইল ব্যবসা মডেলের জন্য সুপরিচিত।
কাজী জাহিন হাসান বলেন, 'আমরা আশা করি, বাংলাদেশেও আলফামার্টের দোকানগুলো এমন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে, যা নারীদের ও তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় হবে।'
আলফামার্টের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার মিতসুবিশি করপোরেশন এই যৌথ উদ্যোগ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বৈশ্বিক রিটেইল অংশীদারিত্বে মিতসুবিশির অভিজ্ঞতা— বিশেষ করে লসন ও ইউনিক্লো-এর মতো ব্র্যান্ডের মাধ্যমে— বাংলাদেশের এই নতুন উদ্যোগে আন্তর্জাতিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মিতসুবিশি করপোরেশন বর্তমানে জাপান ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৭ হাজারেরও বেশি লসন দোকান পরিচালনা করছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আধুনিক খুচরা ব্যবসার ধরন বিস্তারে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
বাংলাদেশের আধুনিক খুচরা বাজার গত এক দশকে দ্রুত বেড়েছে। নগরায়ণ, আয় বৃদ্ধির সুযোগ এবং ভোক্তাদের পরিবর্তিত অভ্যাস এই প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। শিল্পখাতের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের এফএমসিজি ও সংগঠিত খুচরা বাজারের আকার ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশের বাজারে আলফামার্টের প্রবেশ স্থানীয় ক্ষুদ্র দোকানকেন্দ্রিক খুচরা ব্যবসা থেকে সংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর খুচরা ব্যবস্থার দিকে পরিবর্তনকে আরও দ্রুততর করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যৌথ উদ্যোগটি দেশে হাজারো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় এফএমসিজি উৎপাদকদের জন্য সরাসরি খুচরা বিপণনের সুযোগ তৈরি করবে এবং পণ্যের গুণমান, পরিচ্ছন্নতা ও সেবার মান নিয়ে ভোক্তাদের প্রত্যাশাও বাড়িয়ে তুলবে।
কাজী জাহিন হাসান জানান, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে আলফামার্টের দোকানগুলোতে থাকবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোক্তাপণ্য— যেমন খাদ্য, পানীয়, ব্যক্তিগত পরিচর্যার সামগ্রী ও গৃহস্থালির পণ্য। পরবর্তীতে ভোক্তার চাহিদা ও সরবরাহব্যবস্থার সক্ষমতা অনুযায়ী ধীরে ধীরে লাইফস্টাইল ও গৃহসজ্জা পণ্য যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
উদ্যোগটির অংশীদারেরা স্থানীয় এফএমসিজি উৎপাদকদের সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতার বিষয়টি যাচাই করছেন, যাতে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলোও আলফামার্টের খুচরা বিতরণব্যবস্থার সুবিধা পায়— যেখানে ব্যবহৃত হবে রিয়েল-টাইম বিক্রয় বিশ্লেষণ ও চাহিদা পূর্বাভাস প্রযুক্তি।