হারানো অভিধানের জন্য এলিজি

স্কুলে পড়ি তখন। ক্লাস ফোর বা ফাইভ কিংবা সিক্সও হতে পারে। পুরোপুরি মনে নেই। এক দুপুরবেলায় স্কুল থেকে এসে উঠোনে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছি। হঠাৎ দেখি, হাতে ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকলেন বাবা। ঢুকতে ঢুকতেই আমাকে ডাক দিলেন। বাবা বিদেশ থাকতেন, একাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে খুবই সিরিয়াস মানুষ। আমরা প্রচণ্ড ভয় পেতাম তাঁকে, বিদেশ থেকে আসবে শুনলেই ভয় লাগত। সেদিনও ডাক শুনে ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে। ভাবলাম, খেলছি দেখে হয়তো বকা দেবেন। দ্রুত পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনো কথা না বলে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন। খুলে দেখলাম সেখানে দুইটা অভিধান। একটা জয়কলি ইংলিশ টু বাংলা পকেট ডিকশনারি; যেটা এখনো আমার কাছে আছে। আর অন্যটা ছিল বাংলা থেকে বাংলা ডিকশনারি; সেটা অবশ্য পরে হারিয়ে ফেলেছি। এটা কোন কোম্পানির, সেটাও এখন আর মনে নেই। তবে আকারে একটু বড়ই ছিল। এই দুইটা অভিধান যেন আমার কৌতূহলী কিশোর মনকে নতুন করে জাগিয়ে দিল।
তখনো গল্পের বই খুব বেশি হাতে আসেনি। এক বন্ধুর কাছ থেকে চুরি করে আনা গোপাল ভাঁড়ের একেকটি গল্পই কয়েকবার করে পড়া হতো। তার ওপর বয়সের কারণে বাসার পরিবেশও ঠিক 'আউটবই' পড়ার উপযোগী না। ফলে নতুন কিছুর খোঁজে এই অভিধানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়তে হলো। বেশ রহস্যময় একটা সম্পর্ক বলা যায়। নানা জায়গা থেকে ইংরেজি শব্দ এনে সেগুলোর অর্থ খুঁজে বের করতাম এবং ছোট নোটপ্যাডে শব্দগুলো আলাদা করে লিখে রাখতাম। স্কুল পাঠ শেষ করার আগ পর্যন্ত আমার এই অভ্যাসটা ছিল। এভাবে প্রচুর বাংলা-ইংরেজি শব্দের অর্থ আমি শিখেছি। আমি জানি না কীভাবে যেন অভিধানের মতো এই কাঠখোট্টা জিনিসটা আমার অনেক প্রিয় হয়ে ওঠে।
একসময় বানানের চেয়ে নতুন নতুন বাংলা শব্দ শেখার নেশায় পেয়ে বসল। তখন সব বাদ দিয়ে নতুন শব্দ আর শব্দের নানাবিধ অর্থ খুঁজে বের করার দিকেই ছিল আমার যত মনোযোগ। তবে সে সময় অভিধানের পাশাপাশি আরেকটা বিষয় নিয়ে বেশ আগ্রহ কাজ করত, সেটি ছিল সাধারণ জ্ঞান। টাকা জমিয়ে তখন 'কারেন্ট ওয়ার্ল্ড' এবং 'কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স' সংগ্রহ করতাম। এটা-সেটা মুখস্থ করে সবাইকে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এরপর সেই চমকে দেওয়ার প্রচেষ্টায় যুক্ত হলো অপ্রচলিত, শুনতে কঠিন চমকপ্রদ বাংলা শব্দ।
তেমন কয়েকটা শব্দের উদাহরণ দেওয়া যাক। 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়'—এই শব্দটা আমি প্রথম অভিধানে পড়েই জেনেছি। এই শব্দ শেখার পর অদ্ভুত একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল আমিই বোধ হয় এই শব্দের প্রথম আবিষ্কারক। আমার মাধ্যমে সবাই জানবে এটার কথা। শুরুতে অবশ্য মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল; যে কারণে আমি খাতায় শব্দটা লিখে নিয়েছিলাম। সেদিন বন্ধুদের এই নতুন শব্দ শোনানোর যে আনন্দ, আমি সেটা এখনো অনুভব করতে পারি।
একইভাবে গজমূষিকন্যায়, কৃত্তিবাস কিংবা প্রভঞ্জনের মতো অপ্রচলিত শব্দের কথা বলা যায়। সেই কবে এই শব্দগুলো শিখেছিলাম। এরপর কত কিছু ভুলে গেছি। কিন্তু শব্দগুলো এখনো মনে রয়ে গেছে। তেমনি সাধারণ জ্ঞানের অনেক কিছু তখন মুখস্থ করার পর এখনো মনে আছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সাধারণ জ্ঞান বিষয়টার ওপর একধরনের বিরক্তি চলে আসে। সম্ভবত বিভিন্ন পরীক্ষায় জোর করে শিখতে হতো বলে এই দশা। জোরজবরদস্তি আনন্দ নষ্ট করে। পছন্দের বিষয়েও নিয়ে আসে চরম অনীহা, যা সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। নয়তো নতুন বাংলা শব্দ শেখার নেশা তো আমার এখনো গেল না! এখনো হাতের কাছে অভিধান পেলে দশ-বিশ করে পৃষ্ঠা উল্টে খুঁজে নিই নতুন শব্দ। যদিও সর্বশেষ কবে যে উল্টেছি, তা এখন মনে করত পারছি না।
এরপর ধীরে ধীরে ছোট অভিধানের জায়গা নিল ঢাউস আকারের বড় অভিধান। তবু কোনো শব্দের অর্থ জানতে হলে আমি সবার আগে ছোট অভিধানই দেখতাম। সেখানে না পেলে তারপর বড় অভিধানের কাছে যেতাম। একটা শব্দ খুঁজতে গিয়ে অন্য কিছু শব্দ শেখা হয়ে যেত। ভুলে যাব দেখে দাগিয়ে রাখতাম কিংবা আলাদা নোট নিয়ে নিতাম। একটা নতুন শব্দ শেখার সেই আনন্দ ছিল অকৃত্রিম। নতুন একটি শব্দের ভেতর থেকে অর্থের ডানা মেলার যে দৃশ্য, তা সত্যিই মুগ্ধতা জাগানোর মতোই ব্যাপার।

এরপর অবশ্য যমুনার জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ইন্টারনেটের দুয়ার খুলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে ইন্টারনেটেই শব্দের অর্থ ও বানান দেখার অভ্যাস তৈরি হলো। তারপরও হার্ড কভারের পেটমোটা ডিকশনারির আবেদন একেবারে ফুরিয়েও যায়নি। বিভিন্ন সময় অথেনটিসিটির কারণে অভিধান খুলে দেখতেই হতো। বিশেষ করে পত্রিকা অফিসে কাজ শুরুর পর অভিধান খুলে ক্রস চেক করা হতো নিয়মিত। তবে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে অনলাইনে পিডিএফ সহজলভ্য হওয়ার পর। অথেনটিসিটির সমস্যা আর থাকল না। অনলাইন ডিকশনারিতে সব জেনে নেওয়া যায়; পত্রিকা অফিসে অভিধানের ভূমিকা আরও গৌণ হয়ে গেছে স্পেলচেকার আসার পর। এখন স্পেলচেকারই সব বানান ঠিক করে দিচ্ছে; যা অনেক ক্ষেত্রে প্রুফ রিডার বা সম্পাদনা সহকারীর কাজও সীমিত করে দিচ্ছে। পাশাপাশি এর ফলাফলস্বরূপ অফিসের ডেস্ক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বিশালাকার অভিধানগুলোও।
বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পুরোনো কিছুর হারিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক সরাসরি নিয়তির সঙ্গে। মানে আপনি চান বা না চান, এটা ঘটবেই। অনেক প্রিয় প্রিয় জিনিসের শেষ ঠিকানা হয়েছে নস্টালজিয়ার ভাগাড়ে। মানুষ স্মৃতিকাতরতার ভেতর দিয়েই শুধু জিনিসটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যেমন: চিঠি কিংবা ল্যান্ডফোন অথবা হারিকেন—মানুষ এখন এসব শুধু স্মৃতিতেই ধরে রেখেছে, এসবের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। ফলে আজকের দিনটা যে আগামীকাল স্মৃতি হয়ে যাবে, এটা মেনে নিয়ে সামনে এগোনোই বুদ্ধিমানের কাজ। তবু মানুষ চাইলেই কত আর বুদ্ধিমান হতে পারে! সে সামনে গিয়েও পেছনে ফিরে তাকাতে চায়। এই চাওয়াটাই মানুষকে সজীব রাখে, রাখে জীবন্তও।
একইভাবে অভিধানের গন্তব্য আপাতত সেই নস্টালজিয়ার ভাগাড়ে হলেও আমাদের স্মৃতিতে তা জীবন্ত থাকবে আরও অনেক দিন। পাশাপাশি মেনে নিতে হবে কঠিন বাস্তবতাও। আগে অভিধান খুলে শব্দ খুঁজে বের করার জন্য যে সময় ব্যয় করা হতো, সেটা নিয়ে নিয়েছে অন্য কিছু। সেটা হতে পারে রিলস, দীর্ঘ সময়ের অফিস, আড্ডা, ফেসবুক বা সেই অন্য কিছু। ফলে চাইলেও এখন আর অভিধান খুলে বের করে বসার সময় আর কারই বা আছে! অবশ্য এমন না যে মানুষ এখন আর নতুন শব্দ শিখছে না। অবশ্যই শিখছে। কিন্তু শেখার মাধ্যম বদলে গেছে। অভিধানের প্রয়োজনীতা ক্রমেই কমার দিকে, যা সামনের দিনগুলোতে আরও কমবে। আর স্কিবিডি, ভাইব, ফোমো, রিজ, স্লে, অরা, ব্রেইনরট, পুকি, ডেলুলু, নো ক্যাপ কিংবা গোস্টিংয়ের মতো জেন-জি শব্দ কোন অভিধানেই পাওয়া যাবে! ফলে সবাই অনলাইন অভিধানের দিকে হাত পাতছে। কারণ, ভার্চুয়াল দুনিয়ার এসব শব্দ নিয়ে তৈরি জেন-জি অভিধান কিন্তু ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়।
যা-ই হোক, আমি বলছিলাম হার্ড কপি অভিধান নিয়ে আমাদের নস্টালজিয়া ও তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার কথা। কদিন আগে পর্যন্ত কিছুটা চাহিদা থাকলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেটাও একরকম শেষ করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি মূলত বদলে দিয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই। এটা একটা নতুন বাস্তবতা, যা মানুষের সৃষ্টিশীলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এআই প্রতিনিয়ত মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে শোষণ করে নিচ্ছে। এমনকি সৃষ্টিশীল মানুষকেও তার ওপর নির্ভর করিয়ে নিচ্ছে। বানান দেখা বা শব্দের অর্থ খুবই সামান্য ব্যাপার। এআই এখন কপি রাইটার এবং কপি এডিটরের ভূমিকায় নেমেছে। তবে এটাও সত্য যে এআইয়ের যে সৃষ্টিশীলতার ভান, সেটাও মানুষকে শুষে নিয়েই গড়ে উঠেছে। এখনো এআই হয়তো পুরোপুরি মানবীয় মস্তিষ্কের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, কোথায় গিয়ে থামে, সেটা একটা দেখার বিষয় হবে। এখন আপনি চাইলে এক নির্দেশে সব শুধরে নিতে পারবেন। এমনকি কী শুধরাল, তা-ও জানার প্রয়োজন হয় না। এই যে না চাইতে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে, তা মানুষের জানা-বোঝায় ন্যূনতম ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডির মুখোমুখি আমরা হচ্ছি। অনেক কিছুই আমাদের নামে লেখা হচ্ছে, যার সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নাই।
এখানে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমার মনে পড়ছে উরুগুয়ের কথাসাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর একটা লেখার কথা। চিলড্রেন অব দ্য ডেইজ বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'গোটা বিশ্বে আলঝেইমার রোগ নিরাময়ের খোঁজে যত পয়সা খরচ করা হয়, তার পাঁচ গুণ বেশি খরচ করা হয় পুরুষের যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি আর নারীদের স্তন বৃদ্ধির জন্য সিলিকন ব্যবহারে। পাঁচ বছরের মধ্যে সুবিশাল স্তনধারী বৃদ্ধা আর ঋজু পুরুষাঙ্গের বৃদ্ধ পাওয়া যাবে। কিন্তু মুশকিল হলো, তারা কিছুতেই মনে করতে পারবে না যে ওগুলো দিয়ে কী করা হয়।'
এআই নিয়েও আমার একই কথা মনে হয়, এমন দিন আসবে, যখন আমরা নিজেদের ঢাউস লেখাপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারব না, এগুলো আমরা কবে লিখেছিলাম বা আদৌ লিখেছিলাম কি না! আর তখন খানিকটা আড়ালে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে ঢাউস সাইজের অভিধানগুলো।