অভিধানের দিন কি তবে ফুরাল?

সালটা ২০১৫। আমি তখন আমেরিকার অভিধান জগতের কিংবদন্তী, মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের সদর দফতরে। আমার প্রকল্প ছিল এই ক্লাসিক অভিধানের যুগান্তকারী পরিবর্তনের সাক্ষী থাকা আর সেই গল্পটাই তুলে ধরা।
তবে মনে একটা গোপন ইচ্ছেও ছিল—আমার নিজের দেওয়া কিছু শব্দ যদি অভিধানে জায়গা করে নেয়! যেমন, 'ডগপাইল' শব্দটা। মানে, খেলা জেতার পর সবাই মিলে আনন্দে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ভাবতাম, এই শব্দটা এখনো কেন যে অভিধানে নেই!
মেরিয়াম-ওয়েবস্টার তখন তাদের বিখ্যাত সৃষ্টি, 'ওয়েবস্টার'স থার্ড নিউ ইন্টারন্যাশনাল ডিকশনারি, আনব্রিজড'-এর ওপর নতুন করে কাজ শুরু করেছিল। ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার শব্দ, ২,৭০০ পৃষ্ঠা আর প্রায় ছয় কেজি ওজনের এই বিশাল বইটাকে নিছক দরজা আটকানোর পাথর বললেও ভুল হবে না! ১৯৬১ সালে প্রকাশের পর এর গায়ে আর নতুন করে হাত পড়েনি। নতুন সংস্করণটি ছাপা বই নয়, বরং হওয়ার কথা ছিল একটি অনলাইন সংস্করণ, যার জন্য সাবস্ক্রিপশন লাগত। আর ধরেই নেওয়া হয়েছিল, এই মহাযজ্ঞ শেষ হতে কয়েক দশক লেগে যাবে।
কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সব হিসেব গেল পাল্টে। মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের ফ্রি ওয়েবসাইট ছিল তাদের বিজ্ঞাপনের আয়ের মূল উৎস। কিন্তু, এই ওয়েবসাইটে হু হু করে পাঠক কমতে শুরু করল। গুগলের অ্যালগরিদমে সামান্য কিছু পরিবর্তনের ফলে মেরিয়ামের সার্চ রেজাল্ট একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকল। সংস্থাটি চিরকালই ছিমছাম থেকেও লাভজনক ছিল, কিন্তু এই আর্থিক ধাক্কাটা বেশ ভালোমতোই লাগল। তাদের মূল সংস্থা, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, নিজেরাই তখন অস্তিত্বের সংকটে—উইকিপিডিয়ার যুগে বিশ্বকোষের আর দরকারটাই বা কী? ফলে তারা খরচ কমানোর নির্দেশ দিল। মেরিয়াম এক ডজনেরও বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করল। সংস্থার দীর্ঘদিনের প্রকাশককে সময়ের আগেই অবসরে পাঠানো হলো। আর মেরিয়ামের সেই স্বপ্নের প্রকল্পটাকে মাঝপথেই জলাঞ্জলি দেওয়া হলো।
এটাই বোধহয় আধুনিক অভিধানের সবচেয়ে বড় হেঁয়ালি। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন শব্দ নিয়ে চর্চা আর গবেষণার স্বর্ণযুগ চলছে। আমরা যেন ভাষার ভেতরের ভাষাটাকেও বুঝতে শিখছি। অভিধান এখন আমাদের হাতের মুঠোয়, ল্যাপটপ বা ফোনেই হাজির। আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অভিধান ব্যবহার করছে। পডকাস্ট, নিউজলেটার আর 'ওয়ার্ডস অফ দ্য ইয়ার'-এর দৌলতে নতুন নতুন শব্দ দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।
কিন্তু এই অগ্রগতিই আবার অভিধানের ব্যবসাকে গলা টিপে মারছে। যেকোনো সংজ্ঞা এখন এক ক্লিকেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সংজ্ঞার উৎস কী—কোনো বিশেষজ্ঞের গবেষণা, নাকি ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ানো কোনো ভুতুড়ে ওয়েবসাইট থেকে তুলে আনা তথ্য, তা নিয়ে কেই-বা মাথা ঘামায়? মেরিয়াম ছাড়ার আগে এর প্রকাশক আমাকে বলেছিলেন, মিডিয়া এবং সরকারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন মানুষের অবিশ্বাসের শিকার হচ্ছে, পুরোনো অভিধানগুলোকেও একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
আমেরিকার অভিধান জগতের অন্যান্য বড় নামগুলোও ততদিনে একে একে মাঠ ছেড়ে পালাচ্ছিল। ২০০১ সালে, র্যান্ডম হাউস অভিধান বানানোই পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। 'ওয়েবস্টার'স নিউ ওয়ার্ল্ড ডিকশনারি' বিভিন্ন মালিকের হাতে ঘুরতে ঘুরতে ২০১৪ সালে তার শেষ সংস্করণ প্রকাশ করে। আর একসময়ের প্রবল প্রতিপক্ষ 'দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি' এখন তার কিংবদন্তিতুল্য অতীতের একটি ছায়া মাত্র।
এই দশকের শুরুতে আমেরিকার অভিধান ব্যবসায় মাঠে টিকে ছিল মূলত দুজন খেলোয়াড়: ২০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার, আর ডিকশনারি ডটকম। মিডিয়া জায়ান্ট 'আইএসি' এটি কিনে নেওয়ার পর, ডিকশনারি ডটকমের ছোট দলটি নতুনত্বের ঝড় তোলে। ২০১৬ সালে আমি যখন তাদের অফিসে যাই, তখন স্ল্যাং, ইমোজি, মিম এবং লিঙ্গ ও যৌনতা সম্পর্কিত শব্দের জন্য তাদের বিভাগগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। শোনা যায়, ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি তাদের ওয়েবসাইটে বছরে ৫০০ কোটিরও বেশি সার্চ হতো!
২০১৮ সালে, এই সংস্থাটিকে কিনে নিলেন ধনকুবের ড্যান গিলবার্ট—কারণটা নাকি ছিল তার ব্যক্তিগত অভিধানপ্রীতি। তিনি নিজে এই প্রকল্পে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে কিছুদিনের জন্য মনে হচ্ছিল অভিধানের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ হয়তো হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
২০২৩ সালে, ডিকশনারি ডটকম তিনজন অভিজ্ঞ ভাষাবিদকে নিয়োগ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল অভিধানটিকে আধুনিক করে তোলা, কারণ এর কিছু সংজ্ঞা ছিল এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো। দলটি 'থিওরি' ও 'হাইপোথিসিস'-এর মতো বহু ব্যবহৃত শব্দগুলোকে নতুন করে লেখে, যেমন 'মিড' (মাঝারি) শব্দটির নতুন অর্থ হিসেবে যুক্ত করা হয় গড়পড়তা, অপ্রভাবশালী, অথবা হতাশাজনক -এর মতো নতুন শব্দ।
ব্যারেট নামে এক ভাষাবিদ এমন এক প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যার ফলে নতুন শব্দ যোগ করার গতি তিনগুণ বেড়ে যায়! 'বারবিকোর', 'বেড রটিং', 'এনশিটিফিকেশন'-এর মতো একেবারে নতুন শব্দও যোগ করা হয়।
এই ছোট ছোট সাফল্যগুলো অভিধানের মান এবং আকর্ষণ দুটোই বাড়িয়েছিল। কিন্তু ব্যারেট জানতেন, অভিধানের ব্যবসাটা আসলে ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছিল। তিনি বলেন, 'ভাবলাম, যতক্ষণ চলে চলুক। কিন্তু তারপর গাড়ির চাকাগুলো সত্যি সত্যিই খুলে পড়ে গেল।'
আসলে হয়েছিল কী, গুগল তার 'নলেজ বক্স' দিয়ে সার্চ রেজাল্টের শুরুর দিকের সেরা জায়গাটা নিজেই দখল করে নিল। এতে ডিকশনারি ডটকমের ওয়েবসাইটে পাঠক প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। মহামারীর কারণে বিজ্ঞাপনের আয়ও তলানিতে ঠেকে। এর ওপর গিলবার্টের মূল ব্যবসায় লোকসান হওয়ায়, চাপটা এসে পড়ল এই অভিধানের ওপর।
শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের এপ্রিলে, ডিকশনারি ডটকমকে বিক্রি করে দেওয়া হলো। আর তার ঠিক এক মাসের মধ্যেই নতুন মালিকপক্ষ সংস্থার প্রায় সমস্ত ভাষাবিদকে এক কলমের খোঁচায় ছাঁটাই করে দিল। বছরের শুরুতে যেখানে ৮০ জন কর্মী ছিল, সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন অবশিষ্ট রইল।
চাকরি হারানোর পর ব্যারেট অবাক হননি। তিনি বুঝেছিলেন, 'অভিধান তৈরি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি কাজ। আর মানুষ ভাষা তৈরিতে এতটাই পারদর্শী যে, তাল মেলানোর মতো যথেষ্ট কর্মী আপনার কাছে কখনই থাকবে না।'
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? কোন জাদুমন্ত্রে বাঁচবে এই শিল্প? প্রযুক্তি দৈত্যদের হাতে পড়ে রকেট গতিতে লাভের আশা করা যে বৃথা, তা প্রমাণিত। আবার শখের বশে কোনো ধনকুবেরের ভরসাও আর করা যাচ্ছে না।
তবে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার এখনও তাদের পুরোনো মডেল আঁকড়ে টিকে আছে। প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তাদের বুদ্ধিদীপ্ত, দুষ্টুমিভরা আর রাজনৈতিকভাবে খোঁচা দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য তারা দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প একবার 'unprecedented'-এর বদলে 'unpresidented' টুইট করেছিলেন, তখন মেরিয়াম উত্তর দেয়: 'শুভ সকাল! আজকের শব্দটি... 'unpresidented' নয়। আমরা এই শব্দটি যোগ করিনি। এটি একটি নতুন শব্দ।'
মেরিয়াম হয়তো টিকে আছে, কিন্তু ডিজিটাল দুনিয়ার পাঠকদের বদলে যাওয়া অভ্যাসের কাছে অনেক বড় ব্র্যান্ডকেই মাথা নোয়াতে হয়েছে। রক্ত-মাংসের ভাষাবিদদের লেখা সংজ্ঞা থেকে গুগলের এআই মনোযোগ কেড়ে নেওয়া শুরু করার আগেই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
মেরিয়ামের সেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও আমি সেখানে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম এবং প্রায় ৯০টি সংজ্ঞা তৈরি করেছিলাম। তার বেশিরভাগই গৃহীত হয়নি। কিন্তু কয়েকটি অনলাইনে অমর হয়ে আছে, যার মধ্যে 'মাইক্রোঅ্যাগ্রেশন'-এর মতো রাজনৈতিক শব্দ এবং হ্যাঁ, আমার সেই প্রিয় 'ডগপাইল'-এর মতো মজাদার শব্দও রয়েছে।
অভিধানবিদ্যায় আমার এই ছোট অবদানের জন্য আমি গর্বিত। কিন্তু এই জগতে ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি: ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসা এই শিল্পটাকে বাঁচানো কতটা জরুরি। কুড়ি বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০০ জন পূর্ণকালীন ভাষাবিদ কাজ করতেন; আজ সেই সংখ্যা সম্ভবত ৫০-এরও কম। আজ যখন ' 'ইনসারেকশন', 'ফ্যাসিজম' , 'ফেক নিউজ' বা 'ওক'-এর মতো শব্দগুলো আমাদের পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ভাষার প্রহরী হিসেবে এক নির্ভরযোগ্য অভিধানের প্রয়োজন আগের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি।
- অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা