নারকেল নেমেছে যুদ্ধে: প্রাণ বাঁচায়, জীবন পোড়ায়

ভুল পথে মোড় নিল গাড়িটি। সেই একটি মাত্র ভুলেই ইউরোপ ঢুকে পড়ল ভয়াবহ, ধ্বংসাত্মক এবং রক্তবন্যার এক মহাযুদ্ধে। সেদিন সকালবেলা রাজকীয় গাড়ির দিকে বোমা ছোড়া হয়েছিল। একজন সেনা কর্মকর্তা আহত হলেও গাড়ির ভেতরে থাকা দুই গুরুত্বপূর্ণ যাত্রী অক্ষত রইলেন। ফেরার পথে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিকল্প রাস্তা দিয়ে রেলস্টেশন যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু যোগাযোগে গড়বড় হয়ে গেল। গাড়িটির চালককে কেউ জানায়নি এ কথা। তাই সে আগের পথেই চলতে লাগল। গাড়ির সঙ্গে থাকা এক কর্মকর্তা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে থামালেন। গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে সেটি মুহূর্তের জন্য থামল। ঠিক তখনই সামনে এসে দাঁড়াল সকালের সেই বোমাবাজ দলের আরেক সদস্য।
তার নাম গ্যাভরিলো প্রিন্সিপ। বয়স মাত্র উনিশ। ছাত্ররাজনীতির কর্মী। রাজরোগ যক্ষ্মায় ভুগছিল। শিকার তার সামনে এসে গেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তা বলে সে দেরি করল না। দ্রুত পিস্তল বের করে কাছ থেকে গুড়ুম গুড়ুম, দুটি গুলি চালাল। মারা গেলেন আর্চডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্দ আর তার স্ত্রী সোফি। ১৯১৪ সালের ২৮ জুনে ঘটে এই ঘটনা, সেদিন ছিল তাদের বিবাহবার্ষিকী।
সারায়েভোর সেই হত্যাকাণ্ড থেকেই এক অপ্রতিরোধ্য ঘটনাপ্রবাহ শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত সেটিই রূপ নিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দাবানলে। সার্বিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন, বেলজিয়াম ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরি—সব পক্ষই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক সেই একই সময় ভিয়েনার উত্তর-পশ্চিমে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট শহর স্টক্কারাউতে চলছিল ভিন্ন এক কাজ।
সেখানে ফান্টো-ভের্কে নামের একটি কারখানায় নারকেলের খোসার কাঠকয়লা থেকে তৈরি হচ্ছিল এক বিশেষ পদার্থ। এর নাম রাখা হয়েছিল এপোনিট। এই উপাদানের শোষণক্ষমতা প্রচণ্ড। কারখানার শ্রমিকেরা কল্পনাও করতে পারেননি যে তাদের আর্চডিউকের মৃত্যু আর এই কাঠকয়লার মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে। অথচ সেই কাঠকয়লাই একদিন আধুনিক যুদ্ধের সংজ্ঞা পাল্টে দেবে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে রবিন লরেন্সের 'কোকোনাট হাও দ্য সাই ফ্রুট শেপড আওয়ার ওয়ার্ল্ড' নামের বইতে।
যুদ্ধের শুরু থেকেই ভয় ছিল, জার্মানি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। সেই ভয় বাস্তবে রূপ নেয় ১৯১৫ সালের জানুয়ারির শেষে। জার্মানির নবম সেনাদল রাশিয়ার ওপর ১৮,০০০ গ্যাসশেল ফেলে। কিন্তু শীতে রাসায়নিক-উপাদান জমে গিয়েছিল। ঠিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ল না। যুদ্ধে এই মারণ-গ্যাসের প্রভাব দাঁড়াল প্রায় শূন্য। গির্জার টাওয়ার থেকে জেনারেল মাক্স হফমান নিজে হতাশ হয়ে দেখলেন গ্যাস আক্রমণ কীভাবে ভেস্তে গেল।
তবুও হাল ছাড়লেন না জার্মান বিজ্ঞানীরা। নেতৃত্বে ছিলেন ইহুদি রসায়নবিদ ফ্রিৎস হাবার। অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণের পথপ্রদর্শক, পরবর্তী সময়ে নোবেলজয়ী। মাথা মোড়ানো, ছোট গোঁফ, চোখে পিন্স-নে, অর্থাৎ নাকে চেপে রাখা চশমা। সাদা কোট গায়ে কঠোর ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের চশমার কোনো ডাঁট নেই, কানের সাথে আটকে থাকে না।
ফ্রিৎস হাবার গবেষণা দলকে কঠিনভাবে তাড়িয়ে বেড়ালেন। কয়েক মাসে তৈরি হলো উন্নত ক্লোরিন গ্যাস আর তার সিলিন্ডার। জার্মান সেনারা খুশি হলো। ফ্রিৎস হাবারের স্ত্রী ক্লারা ইম্মেরভার ছিলেন নিজেও একজন রসায়নবিদ, পিএইচডি পাওয়া প্রথম জার্মান নারী বিজ্ঞানীদের একজন। তিনি আদর্শবাদী ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল বিজ্ঞান মানে জীবনের উন্নতি, মানুষের কল্যাণ, ধ্বংস নয়।
কিন্তু তার স্বামী হাবার যুদ্ধের শুরুতেই বিজ্ঞানকে বেছে নিলেন মারণাস্ত্র বানানোর জন্য। ক্লোরিন গ্যাসের আক্রমণ যখন প্রস্তুত হলো, তিনি ভয়ে ও হতাশায় ভেঙে পড়লেন। স্বামীকে বোঝালেন, থামতে বললেন। কিন্তু হাবার বললেন দেশের সুরক্ষাই সবার আগে।
১৯১৫ সালে ইপ্রেসের দ্বিতীয় যুদ্ধের শুরুতে যখন জার্মানরা ফরাসি আলজেরিয়ান সৈন্যদের ওপর হাবারের চাপযুক্ত নতুন গ্যাস সিলিন্ডার ছুড়ল, তখন গল্পটা একদম অন্য রকম হয়ে গেল। এপ্রিলের শেষ দিকে সূর্যোদয়ের পরপরই আক্রমণটি শুরু হয়েছিল। ভোরে ৫,৭০০ সিলিন্ডার ফেটে ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। হলুদ-সবুজ মেঘকুণ্ডলী মিত্রপক্ষের পরিখা বা ট্রেঞ্চ ভরিয়ে তোলে। ফরাসিরা অপ্রস্তুত ও সুরক্ষাহীন ছিল। মাত্র দশ মিনিটে পাঁচ হাজার সেনা শ্বাসরোধে মারা গেল। আরও অনেকে সাময়িকভাবে অন্ধ হলো। সাময়িকভাবে শ্বাস নিতে পারল না অনেকে। এই বিভ্রান্তির মধ্যে গ্যাসমাস্ক পরা জার্মান সেনারা এগিয়ে গিয়ে দুই হাজার ফরাসি সেনাকে পাকড়াও করল।
এক কানাডীয় চিকিৎসক, যিনি একই সঙ্গে রসায়নবিদও ছিলেন; দ্রুত শনাক্ত করলেন গ্যাসটি ক্লোরিন। তিনি সৈন্যদের বললেন, কাপড় প্রস্রাবে ভিজিয়ে নাকে-মুখে চেপে ধরতে। এতে অন্তত কিছুটা সুরক্ষা মিলবে।
নারকেল তখনো দৃশ্যপটের বাইরে। তবে শিগগিরই তার আবির্ভাব ঘটবে। এদিকে সেই রাতেই ক্লারা তার স্বামীর রিভলভার তুলে নিয়ে নিজের হৃদয়ে গুলি চালালেন। হাবার তবু নির্বিকার রইলেন। তার কাছে স্ত্রীর জীবনের চেয়েও জরুরি হয়ে উঠল মারণাস্ত্র নির্মাণ। স্বদেশ রক্ষার অজুহাতে এ অস্ত্র বানানো হলো।
তাদের ছোট ছেলে হারমান হাবার মায়ের আত্মহত্যার সময় পাশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। সকালে ঘুম ভেঙে সে জানল, মা আর নেই। হারমান বড় হলো সেই ভারী ছায়ার মধ্যে। একদিকে প্রতিভাধর বাবা, যিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন। অন্যদিকে মায়ের স্মৃতি, যিনি প্রতিবাদ করেছিলেন আর প্রাণ দিয়েছেন। এই দ্বন্দ্ব তার জীবনে বিষাক্ত হয়ে রইল।
পরের দিকে হিটলারের জার্মানিতে ইহুদি হওয়ায় ফ্রিৎস হাবার নিজেও নির্বাসিত হলেন। সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নিলেন এবং ১৯৩৪ সালে মারা গেলেন। কিন্তু ছেলে হারমানকে স্বদেশ কখনো মেনে নিল না।
হারমান আমেরিকায় চলে গেলেন। সেখানে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মন থেকে নামাতে পারলেন না অতীতের বোঝা। তার মা আত্মহত্যা করেছিলেন, তার বাবা ছিলেন একই সঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক, একদিকে কোটি মানুষের জীবন রক্ষাকারী, অন্যদিকে রাসায়নিক যুদ্ধের জনক।
এই অস্থিরতা তাকে ক্রমে গিলে ফেলল। ১৯৪৬ সালে হারমান হাবারও আত্মহত্যা করলেন। মা ক্লারার আত্মহত্যার দাগ তাদের ছেলের জীবনেও থেকে গিয়েছিল। বাবার বৈজ্ঞানিক মহিমা আর নৈতিক দ্বন্দ্ব—এই বোঝা সে আর সহ্য করতে পারেননি।
ইতিহাসের অদ্ভুত পরিহাস হলো, যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মারণাস্ত্রের নির্মাতা হাবার পেলেন রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মারণাস্ত্র তৈরিতে জড়িত তৎপরতার জন্যেই তাকে নোবেলে ভূষিত করা হয়।
হাবারের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক অর্জন ছিল অ্যামোনিয়া সংশ্লেষণ। যুদ্ধের আগে থেকেই তিনি গবেষণা করছিলেন—কীভাবে বাতাসের নাইট্রোজেন আর হাইড্রোজেন মিশিয়ে বিপুল পরিমাণে অ্যামোনিয়া তৈরি করা যায়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর তিনি প্রক্রিয়াটি শিল্প কারখানার জন্য কার্যকর করার উপায় বের করেন। এই প্রক্রিয়া পরে তার সহকর্মী কার্ল বশ উন্নত করেন। তাই একে বলা হয় হাবার বশ প্রক্রিয়া।
অ্যামোনিয়া দিয়ে তৈরি হয় সার। সেই সার ছাড়া আজকের পৃথিবীর কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন কল্পনাই করা যায় না। অনুমান করা হয়, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের খাদ্যের উৎস সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হাবারের ওই অ্যামোনিয়ার ওপর নির্ভর করে। অন্যভাবে বললে, মানবজাতির কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচানোর কৃতিত্বও তার নামে লেখা যায়।

যুদ্ধ শেষ হলো ১৯১৮ সালে। হাবারকে মিত্রশক্তি যুদ্ধাপরাধী হিসেবেও দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালে সুইডিশ বিজ্ঞান একাডেমি ঘোষণা করল, রসায়নে নোবেল পাচ্ছেন ফ্রিৎস হাবার। কারণ, তিনি বাতাস থেকে অ্যামোনিয়া তৈরির পথ খুলে দিয়েছেন, যা কৃষিকে নতুন যুগে নিয়ে গেছে।
ভাবুন কী পরিহাস। যে মানুষটি ক্লোরিন গ্যাস দিয়ে মৃত্যু নামিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, সেই মানুষকেই বলা হলো কোটি কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ত্রাণকর্তা।
হাবারের টাক মাথা, ছোট গোঁফে ঢাকা ঠোঁট আর চোখে পিন্স-নে চশমা নোবেল অনুষ্ঠানে ধরা দিল দারুণ গর্ব নিয়ে। ইউরোপ তখনো যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে বসে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে আর হাবার দাঁড়িয়ে আছেন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে, যিনি একই সঙ্গে জীবনদাতা আবার মৃত্যুর কারিগর।
নোবেল ওয়েবসাইট মারণাস্ত্র হিসেবে তার গ্যাস-অস্ত্র ব্যবহারের ইতিহাসকে ছোট করে লিখেছে, তিনি গ্যাস আক্রমণ আর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগঠিত করেছিলেন। অথচ এতে মারা যায় হাজারো সৈন্য।
হ্যাঁ, এদিকে ১৯১৫ সালের যুদ্ধে জার্মানির প্রথম এই গ্যাস আক্রমণে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ দেখা দেয়। ডেইলি মিরর লিখল, হে শয়তানি, তোমার নাম জার্মানি। ব্রিটিশ কমান্ডার স্যার জন ফ্রেঞ্চ বললেন, সভ্য যুদ্ধের নিয়মকে নির্মমভাবে উপেক্ষা। অথচ কয়েক মাস পর তিনি নিজেই বললেন, শত্রুর কারণে গ্যাস ব্যবহার শুরু করতে হয়েছে। জার্মান জেনারেল কার্ল ফন আইনেম লিখলেন, যুদ্ধ আর ভদ্রতার নয়। সভ্যতা যত উঁচু হয়, মানুষ তত নিচে নামে।
গ্যাস অনেক সেনার কাছে বুলেট এবং বেয়োনেটের আতঙ্কের চেয়েও বেশি ছিল। গ্যাস আতঙ্ক সৈন্যদের মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করত। সেকালের তরুণ করপোরল অ্যাডলফ হিটলার পর্যন্ত ভয়ে কাবু হয়ে সেনাবাহিনী ছেড়েছুড়ে পরে রাজনীতির পথ বেছে নেন। লন্ডনের কিংস কলেজের সেন্টার ফর মিলিটারি হেলথ রিসার্চের গবেষক অধ্যাপক এডগার জোনস মূলত সামরিক চিকিৎসা ইতিহাস এবং যুদ্ধ-মানসিকতা গবেষণার বিশেষজ্ঞ। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের মানসিক ভয়, ট্রমা এবং মনোবল কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, সে বিষয় নিয়েই তার গবেষণা। অধ্যাপক জোনস লিখেছেন, দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মনোবলই প্রধান আর বিষাক্ত গ্যাস ছিল সেই মনোবল ধ্বংসেরই অস্ত্র।
চিত্রশিল্পী জন সিঙ্গার সার্জেন্টের বিখ্যাত চিত্রকর্ম গ্যাসড, অন্ধ সৈন্যদের সারি বেঁধে হাঁটার দৃশ্য। আজও সেই ভয়াবহতার সাক্ষী। কবি উইলফ্রেড ওউনের কবিতা ডুলচে এট ডেকোরাম এস্টের অর্থ, দেশের জন্য মরে যাওয়া মধুর ও মর্যাদার বিষয়। প্রায় প্রবাদ বাক্যের মতো চলে আসা এ কথাকে কবি বলেছেন দ্য ওল্ড লাই বা প্রাচীন মিথ্যা। কবিতায় সবুজ ক্লোরিন মেঘে ছটফট করে মরতে থাকা সৈন্যদের বেদনাদায়ক বর্ণনা আছে। তার কবিতা শেষে সেই প্রাচীন মিথ্যা উন্মোচিত হলো, দেশের জন্য মরে যাওয়া কত মধুর, আসলে তা ভয়ংকর প্রতারণা।
নারকেলের আবির্ভাব
প্রথম দিকে গ্যাস ঠেকানোর চেষ্টা হয়েছিল লাল সিডারের কাঠকয়লা দিয়ে। কাজ হয়নি। বাদাম, কফি, চিনা শিম, আঙুরের বিচি, ব্রাজিল—সব ব্যর্থ হলো। তখন এল নারকেল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালের হিন্দু নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পানিশোধনে নারকেলের কাঠকয়লার ব্যবহারের কথা। দক্ষিণ গোলার্ধে নারকেলের খোসা পোড়ানো হতো জ্বালানি হিসেবে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন এর অদ্ভুত শোষণক্ষমতা। আয়ারল্যান্ডের জন হান্টার প্রথম দেখালেন নারকেলের কাঠকয়লার গ্যাস শোষণক্ষমতা। পরে রসায়নবিদ রাফায়েল অস্ট্রেজকো বাষ্প প্রবাহিত করে এই ক্ষমতা দ্বিগুণ করলেন। এর ফলেই স্টক্কারাউয়ের ফ্যাক্টরিতে তৈরি হলো এপোনিট। ক্ষুদ্র ছিদ্রবহুল এই কাঠকয়লা ক্লোরিন আর মাস্টার্ড গ্যাস আটকে দিতে সক্ষম হলো।
আমেরিকার এজউড কেমিক্যাল বায়োলজিক্যাল সেন্টারের গ্রেগরি পিটারসন বললেন, সক্রিয় কার্বন দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস ঠেকানোর কাজ চলছে শতাব্দীর বেশি সময়। নারকেল কাঠকয়লা দীর্ঘস্থায়ী টেকসই আর নানা গ্যাস প্রতিরোধে কার্যকর।
রাশিয়ার রসায়নবিদ নিকোলাই জেলিনস্কি প্রথম গ্যাসমাস্কে নারকেলের কাঠকয়লা ভরেছিলেন। দ্রুত ইউরোপ আমেরিকায় তার অনুকরণ শুরু হলো। যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধ দপ্তর নারকেলের খোসার খোঁজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নারকেলভিত্তিক খাবার খেতে আমেরিকান গৃহিণীদের উৎসাহিত করা হলো, যাতে খোসা সংগ্রহ করা যায়। বিজ্ঞাপনে লেখা হলো—'নারকেলের খোসা দিয়ে জার্মান গ্যাসশেল মোকাবিলা করুন।'
নারকেলের টন টন খোসা সংগ্রহ হয়ে পাঠানো হলো এজউডে। ফিলিপাইনে খোলা হলো কাঠকয়লার কারখানা। গ্যাসমাস্ক তৈরি হলো লাখ লাখ। ব্রিটেনে এভন রাবার কোম্পানি সাইকেলের টায়ার ছেড়ে গ্যাসমাস্ক বানাতে শুরু করল। ১৯৩৯ সালের শেষে ব্রিটেনে তৈরি হলো ৩৬ মিলিয়ন মাস্ক। স্কুলশিশুরা অনুশীলন করল গ্যাস আক্রমণের নাটকীয় মহড়া। এমনকি ফিলিপাইনে কারখানা গড়ে তোলা হয়। ১৯১৭ সালে সেখানে ২৫,০০০ গ্যাসমাস্ক তৈরি হয়। ১৯১৮ সালে তৈরি হয় তিন মিলিয়ন মাস্ক, যার দুই মিলিয়ন পাঠানো হয় ইউরোপে। ব্রিটেনেও একইভাবে নারীদের শ্রমে লক্ষ লক্ষ মাস্ক তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর আগেই কেবল ব্রিটেনে ৩৬ মিলিয়ন মাস্ক বিতরণ করা হয়।
নারকেলের কাঠকয়লার ছিদ্র খুবই ছোট, ৪ ন্যানোমিটারের কম। এর চারটি ক্যাপসুল দিয়েই একটি ফুটবল মাঠ ঢেকে দেওয়া যায়। এতে আটকে যায় ক্লোরিন থেকে শুরু করে মাস্টার্ড গ্যাস। ফলে দ্রুত নারকেল কাঠকয়লা গ্যাসমাস্কের মূল উপাদান হয়ে ওঠে।
নাপাম ও নারকেল
নারকেলের এই রক্ষাকবচের পাশাপাশি এল এক অন্ধকার অধ্যায়, নাপাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবার নারকেল যুক্ত হলো ভিন্ন ভ'মিকায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ লুইস ফিসার ছিলেন কর্টিসোন তৈরির জন্য পরিচিত। আলো আর আগুনের রসায়নবিদ লুইস ফিসারের দ্বিমুখী উত্তরাধিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ লুইস ফিসার ছিলেন একদিকে বিজ্ঞানী সমাজের গর্ব, অন্যদিকে মানবতার কাছে পরিহাসের এক চরিত্র। কারণ, তার হাতেই তৈরি হয়েছিল একদিকে কর্টিসোন, অন্যদিকে নাপাম। একটিতে মানুষ পেল আরোগ্য, অন্যটিতে আগুনে ঝলসে যাওয়া মৃত্যু।
কর্টিসোন: আরোগ্যের আলো
ফিসারের নাম প্রথম পরিচিতি পায় কর্টিসোন সংশ্লেষণের কাজের জন্য। কর্টিসোন হলো একধরনের স্টেরয়েড হরমোন, যা মানুষের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। এটি শরীরে প্রদাহ কমায়, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক চাপের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে। ফিসারের কৃত্রিম কর্টিসোন তৈরির ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটে। হাঁপানি, বাত, অ্যালার্জি, অটোইমিউন রোগ—এমন অসংখ্য অসুখের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ডাক্তারদের হাতে এটি হয়ে ওঠে প্রাণ বাঁচানোর ওষুধ।
ফিসারের কৃত্রিম কর্টিসোন তৈরির ফলে চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটে। হাঁপানি, বাত, অ্যালার্জি, অটোইমিউন বা দেহ প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত রোগ, এমন অসংখ্য অসুখে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। চিকিৎসাজগতে এটি হয়ে ওঠে প্রাণ বাঁচানোর ওষুধ।
একজন বিজ্ঞানীর জীবনের সেরা পরিচয় হতে পারত এই অর্জন। ফিসার তখন ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক আশার প্রতীক।
নাপাম: মৃত্যুর আগুন
ইতিহাসের চাকা ফিসারকে নিয়ে গেল সম্পূর্ণ বিপরীত পথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের গোপন গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে ফিসারকে ডাকা হলো। তিনি গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্য নতুন আগুনে বোমা বানাতে শুরু করলেন। নাম দেওয়া হলো প্রকল্প নম্বর চার।
ফিসার গ্যাসোলিনে মিশিয়ে দিলেন একধরনের বাদামি শুষ্ক গুঁড়া। গুঁড়ার উপাদান ছিল দুই ভাগ নারকেল তেল এক ভাগ ন্যাফথেনিক অ্যাসিড আর এক ভাগ ওলেইক অ্যাসিড। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, নারকেলের খোসা আর তেল থেকে প্রাপ্ত অ্যাসিড গ্যাসোলিনের সঙ্গে মিশে তৈরি হলো ভয়ংকর নাপাম।

ভ্যালেন্টাইনস ডে ১৯৪২ সালে হার্ভার্ডের ব্যবসায়িক স্কুলের পেছনের কৃত্রিম জলাশয়ে পরীক্ষা করা হলো বোমাটি। দমকল বাহিনী দাঁড়িয়ে রইল। ফিসার সুইচ টানতেই জলাশয়ের ওপর আকাশচুম্বী আগুন উঠল। তাপমাত্রা ছুঁল দুই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। গন্ধ ছড়াল। রসুন আর গ্যাসোলিন মেশানো এক অদ্ভুত ঘ্রাণ।
আমেরিকার সেনারা বোমাটি পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলো। তারপর শুরু হলো বাণিজ্যিক উৎপাদন। ডাও কেমিক্যাল কোম্পানি দায়িত্ব নিল। উটাহ মরুভূমিতে বানানো হলো জাপানি আর জার্মান ঘরবাড়ির হুবহু অনুকরণ। সেগুলোতে বোমা ফেলা হলো। প্রতিবার দেখা হলো আগুন নেভাতে কত সময় লাগে। যত বেশি সময় লাগল, তত বেশি কার্যকর ধরা হলো বোমাটি। সবচেয়ে সফল হলো এম উনষাট নামের ক্লাস্টার বোমা। এর ভেতরে ছিল ফিসারের নাপাম, যার প্রধান উপাদান নারকেলের পামিটিক অ্যাসিড।
১৯৪৫ সালের মার্চে তিন শতাধিক বি উনত্রিশ বোমারু বিমান টোকিওতে ভয়ংকর অগ্নিবোমা হামলা চালায়। এ অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল অপারেশন মিটিং হাউস। রাতভর আগুন জ্বলল। ১৬ বর্গমাইল শহর ছাই হয়ে গেল। এক লাখ মানুষ মারা গেল। এক মিলিয়ন মানুষ হলো গৃহহীন। জেনারেল কার্টিস লে মে স্বীকার করেন, মার্কিন বিমানবাহিনীর সহায়তায় আমরা সেই রাতে টোকিওতে যত মানুষ পোড়ালাম, তা হিরোশিমা আর নাগাসাকির পরমাণু বোমার মৃতের সংখ্যার চেয়েও বেশি।
কিন্তু ফিসার পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিনি লিখেছিলেন, নাপামকে মানুষ হত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি করা উচিত। তিনি বলেছিলেন, নাপাম তৈরি করার সময় তিনি একে কখনো মানুষ মারার অস্ত্র হিসেবে ভাবেননি। কিন্তু জনমত তাকে ক্ষমা করেনি। তিনি মারা যান ১৯৭৭ সালে। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা জাতিসংঘ প্রটোকল স্বাক্ষর করে দাহ্য অস্ত্র নিষিদ্ধ করেন। তবু ইতিহাসে ফিসারের নাম রয়ে গেল পৈশাচিক আগুনে-মৃত্যুর সঙ্গে।
কেনেডি ও নারকেলের খোল
নারকেলের খোলের সবচেয়ে নাটকীয় ব্যবহার দেখা গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগরে। ১৯৪৩ সালে তরুণ নৌ সেনা কর্মকর্তা জন এফ কেনেডি টর্পেডো বোট পিটি এক শ নয়ের অধিনায়ক ছিলেন। এক অন্ধকার রাতে জাপানি ডেস্ট্রয়ার আমাগিরি তাদের বোটকে ধাক্কা দিয়ে মাঝখান থেকে ভেঙে দিল। দুই নাবিক মারা গেলেন। বাকিরা আহত হয়ে পানিতে ভেসে রইলেন।
কেনেডি নিজেই আহত হয়েছিলেন, তবু দাঁতে লাইফ জ্যাকেটের দড়ি কামড়ে অগ্নিদগন্ধ প্রকৌশলী প্যাট্রিক ম্যাকমাহনকে টেনে নিলেন কয়েক মাইল দূরের ছোট দ্বীপে। সেখানে খাবার বা পানি ছিল না। সাগরে ডোবা থেকে বেঁচে যাওয়া মার্কিন সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়ছিল।
দূরে আরেক দ্বীপে নারকেলগাছ দেখা গেল। সাঁতরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে তারা সেখানে পৌঁছাল। নারকেল তাদের বাঁচাল। ফল দিল পানি দিল। ছায়াও দিল।
কিন্তু যোগাযোগের উপায় ছিল না। তখন কেনেডি এক নারকেলের খোল পরিষ্কার করলেন। ছুরি দিয়ে বার্তা খোদাই করলেন, 'নাউরো দ্বীপ, কমান্ডার, স্থানীয় লোক অবস্থান জানে। সে পথ দেখাতে পারবে। ১১ জন জীবিত। ছোট নৌকা দরকার। কেনেডি।' বার্তাটি স্থানীয় দুই দ্বীপবাসী এরনি কুমানা এবং বিয়ুকু গাসা নিয়ে গেলেন মিত্রবাহিনীর ঘাঁটিতে। এই নারকেলের খোলের বার্তাই পরে কেনেডি ও তার ক্রুদের উদ্ধার করেছিল।
১৯৬১ সালে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কেনেডির ডেস্কে সেই নারকেলের খোল সাজানো ছিল। শীতল যুদ্ধের সংকটকালে ওভাল অফিসে বসা তরুণ প্রেসিডেন্টের সামনে সেই খোল যেন বারবার মনে করিয়ে দিত সাহস সংকল্প আর টিকে থাকার গল্প।
নারকেল যুদ্ধের ইতিহাস: দ্বীপ থেকে মরুভূমি পর্যন্ত
নারকেলকে আমরা ভাবি এক লাজুক ফল—ঝুপড়ি ঘরের আঙিনায় দুলছে, ছায়া দিচ্ছে, পানি দিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, এই ফলই যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো রক্ষক, কখনো আক্রমণকারী, কখনো বিদ্রোহীর পতাকা, আবার কখনো ধ্বংসের আগুন।
প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট ছোট দ্বীপে যুদ্ধ ছিল আটপৌরে জীবনের স্বাভাবিক অংশ। কিরিবাতি এবং নাউরুর যোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামত এমন সাজে, যা আজও অবাক করে দেয়। শরীরে থাকত নারকেলের আঁশ দিয়ে বোনা শক্ত বর্ম। এই আঁশে গড়া বর্ম বর্শার আঘাত ঠেকিয়ে দিতে পারত। হাতে থাকত অস্ত্র, যেগুলো নারকেলের আঁশে বাঁধা থাকত ধারালো হাঙরের দাঁত দিয়ে। মাথায় থাকত এক ধরনের মাছের শুকনো চামড়ার শিরস্ত্রাণ। এর গায়ে ছিল ছোট ছোট কাঁটার মতো শক্ত আঁশ, যা প্রতিরক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়াত।
এই সাজ শুধু সুরক্ষা নয়, প্রতিপক্ষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিত। যুদ্ধ মানেই লোহার ঢাল আর তলোয়ার নয়, প্রকৃতির দান দিয়েও যুদ্ধ করা যায়, সেই শিক্ষা দিয়েছিল এই দ্বীপবাসীরা। নারকেল সেখানে কেবল ফল নয়, ছিল জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী দেয়াল।
১৯৮০ সাল। তখনো নিউ হেব্রিডস দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশ আর ফরাসি উপনিবেশ। স্বাধীনতার দাবিতে দ্বীপবাসীরা রাস্তায় নামল, দমন করতে এল ঔপনিবেশিক শক্তি। এই সংঘর্ষ ইতিহাসে জায়গা করে নিল এক অদ্ভুত নামে, কোকোনাট ওয়ার। কেন এই নাম? কারণ, দ্বীপবাসীর হাতে ছিল নারকেল, নারকেলগাছের ডাল আর নারকেল থেকে তৈরি অস্ত্র। রাইফেল, কামানের পাশে এই ফল হয়ে উঠল প্রতিরোধের প্রতীক। একদিকে ব্রিটিশ ও ফরাসি দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে দ্বীপবাসীর বিদ্রোহ—সব মিলিয়ে যুদ্ধ যেন এক কৃষ্ণরসিক প্রহসনের অনুভব এনে দিয়েছিল।
শেষমেশ জন্ম নিল নতুন দেশ, ভানুয়াতু। স্বাধীনতার পরেও নারকেল সেখানে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এর আঁশ, কাঠ, তেল সবই ব্যবসার পণ্য। আজ গবেষণা চলছে কীভাবে নারকেল তেল গাড়ি চালানোর জ্বালানি হতে পারে। যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসকে পেছনে ফেলে নারকেল আজ নতুন শক্তির স্বপ্ন দেখাচ্ছে দ্বীপবাসীদের।
নারকেলের আগুন
না, নারকেল সব সময় রক্ষক হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোপন ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা নারকেলের তেল থেকে তৈরি করলেন নাপাম, যে আগুন ছড়িয়ে দিল অভিশাপের মতো মৃত্যু। ১৯৪৫ সালের মার্চে টোকিওতে যে অগ্নিবোমা হামলায় ১৬ বর্গমাইল শহর ছাই হয়ে গেল, এক লাখ মানুষ পুড়ে মরল, সেই আগুনের ভেতর ছিল নারকেলের অংশও।
নাপাম হয়ে উঠল আগুনের শয়তানি প্রতীক। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে মানুষের দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেল এই আগুনে। প্রশ্ন উঠল, একটি লাজুক ফলের শরীর থেকে পাওয়া তেল কীভাবে হয়ে উঠল আগুনের রাক্ষস। প্রধাণত তার বাহন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব।
গাজার অগ্নিগাঁথা
আজও সেই আগুন জ্বলছে ফিলিস্তিনের গাজায় ইহুদিবাদী আগ্রাসনের হাত ধরে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মিনমিন করে হলেও স্বীকার করছে, ফসফরাস বোমার পাশাপাশি নাপামসদৃশ দাহ্য অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে গাজার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে। নারকেল থেকে পাওয়া উপাদান আবারও রক্তে ভিজে যাচ্ছে, ইসরায়েলের ইহুদিবাদী এই আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট শিশুদের দগ্ধ দেহ পৃথিবীর সামনে ছুড়ে দিচ্ছে সেই পুরোনো প্রশ্ন, মানুষ কি শিখল কিছু?
পরিহাসের ইতিহাস
অদ্ভুত ও করুণ বিদ্রূপের নাম ইতিহাস। নাপামের সূত্রপাত করেছিলেন জার্মান ইহুদি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী লুইস ফিসার। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গ্যাস আক্রমণের জনক ছিলেন আরেক ইহুদি বিজ্ঞানী ফ্রিৎস হাবার। হাবারের স্ত্রী ক্লারা প্রতিবাদ করেছিলেন স্বামীর গবেষণাগারের নৃশংস যুদ্ধবিজ্ঞান থামানোর জন্য, নিজের জীবন দিয়েছিলেন। তাদের ছেলে হারমানও সেই দগ্ধ উত্তরাধিকারের চেতনা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। যেন একটি পরিবার ইতিহাসের শাস্তি নিজের দেহে বহন করেছিল।
নারকেলের যুদ্ধের ইতিহাস তাই এক দ্বিমুখী আয়না। কখনো এটি সৈন্যদের প্রাণরক্ষার কাঠকয়লা, কখনো দ্বীপবাসীর বর্ম, কখনো স্বাধীনতার প্রতীক, আবার কখনো ভয়ংকর আগুনের জ্বালানি। নারকেল আমাদের শেখায়, প্রকৃতির দান মানুষের হাতে কেমনভাবে রক্ষকের থেকেও রাক্ষস হয়ে উঠতে পারে। গাজা আজ তার নির্মম প্রমাণ। নারকেলের পাতায় বাতাস বয়ে যাচ্ছে। শিরশির শব্দ হচ্ছে। মনে হয়, ইতিহাস আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে, আগুন যেদিন অন্যের ঘরে ছড়াও, প্রস্তুত থেকো, একদিন সেই আগুনই ফিরে আসবে তোমার সন্তানদের ঘরে।