নারকেল ‘ফারাওয়ের বাদাম’!
সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ, ঝিরঝিরে বাতাস আর তটরেখা ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি নারকেলগাছ—এমন দৃশ্য দেখলেই মনে যে প্রশান্তি আসে, নারকেলের ইতিহাস তার চেয়ে আরও অনেক গভীর, অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।
বাইবেল, গ্রিক পুরাণ বা শেক্সপিয়ারের লেখায় এই ফলের নাম খুঁজে আপনি হয়তো হয়রান হবেন। কারণ, নারকেলের রাজত্ব পশ্চিমে নয়, এর জন্ম আর বেড়ে ওঠা প্রাচ্যের আলো-বাতাসে। এর ইতিহাস কোনো পাথরের ফলকে লেখা নেই; বরং মিশে আছে পলিনেশীয় দ্বীপবাসীর মুখে মুখে ফেরা পুরাণে, ভারতীয় লোককথায় আর আরব বণিকদের সমুদ্রযাত্রার গল্পে। তাই এই ফলের শিকড় খুঁজতে হলে ইউরোপের গ্রন্থাগার ছাড়াও পাড়ি দিতে হবে প্রাচ্যের কাহিনির সমুদ্রে।
অবশ্য পাশ্চাত্যের আধুনিক সাহিত্যে যে নারকেলের উপস্থিতি একেবারেই নেই, তা-ও কিন্তু না। হারম্যান মেলভিল, জেমস এ মিশনার, রবার্ট লুই স্টিভেনসন বা সমারসেট মমের মতো লেখকদের গল্পে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ পটভূমি হয়ে আসায় নারকেলগাছও উঠে এসেছে শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে। এমনকি চার্লস নর্ডহফ ও জেমস নরম্যানের বিখ্যাত উপন্যাস 'মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি'-এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একটি চুরি হওয়া নারকেলকে কেন্দ্র করে।
আধুনিক পপ সংস্কৃতিতেও এর ছাপ স্পষ্ট। জে কে রাউলিংয়ের 'হ্যারি পটার' সিরিজের তৃতীয় বইয়ে জাদুকরদের মিষ্টির দোকানে 'পিঙ্ক কোকোনাট আইস' নামে একটি বিশেষ মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।
'উদ্ভিদ জগতের সুইস আর্মি নাইফ'
নারকেলকে অনেকে মজা করে বলেন 'উদ্ভিদ জগতের সুইস আর্মি নাইফ'। আর বলবেনই বা না কেন! এর পানি ও শাঁস তো আমরা খাই, কিন্তু এর বাকি কোনো অংশই ফেলনা নয়। পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, আঁশ দিয়ে বানানো হয় শক্ত দড়ি আর শক্ত খোলটা হয়ে যায় রান্নার জ্বালানি বা থালা-বাটি।
আজও শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন বা আফ্রিকার মতো যেসব দেশে নারকেল জন্মায়, সেখানে গবেষণা চলছে—নারকেল দিয়ে আরও নতুন কী কী করা যায়।
যুদ্ধক্ষেত্রেও যখন ভরসা ছিল নারকেল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটা কথা খুব চালু আছে। বলা হয়, আহত সৈন্যদের বাঁচানোর জন্য রক্তের বদলে নাকি নারকেলের পানি ব্যবহার করা হতো। যদিও এর কোনো পাকাপোক্ত প্রমাণ মেলেনি।
কিন্তু এটা সত্যি যে, নারকেল তখন জীবন বাঁচাতে দারুণ কাজে দিয়েছিল। ১৯৪৩ সালের কথা। আমেরিকার পাইলটদের শেখানো হচ্ছিল, যদি কখনো শত্রু এলাকায় বা অচেনা দ্বীপে বিমান ভেঙে পড়ে, তবে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে। যেহেতু তারা কেউই নারকেল বা এই এলাকার গাছপালা চিনতেন না, তাই তাদের হাতে-কলমে শেখানো হতো—কীভাবে ডাব পেড়ে পানি খেতে হয়, শাঁস খেতে হয়, এর আঁশ দিয়ে কাপড় বা দড়ি বানাতে হয়, আর খোল দিয়ে বাটি বা পাত্র তৈরি করতে হয়।
এমনকি নারকেলের ছোবড়া জ্বালিয়ে আগুনও ধরানো যেত। সেই আগুনে সৈন্যরা তাদের সিগারেট পর্যন্ত জ্বালাত।
কেনেডির জীবন বাঁচানো সেই নারকেল
যুদ্ধের ময়দানে নারকেলের ভূমিকা নিয়ে অনেক গল্প চালু থাকলেও ইতিহাসে সত্যি সত্যি জায়গা করে নিয়েছে এক প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচানোর কাহিনি। সময়টা ১৯৪৩ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ডুবে গেল তরুণ জন এফ কেনেডির নৌযান। চারপাশে অথই জল, বাঁচার আশা ক্ষীণ। তখন ভরসা একটাই—নারকেল।
কেনেডি একটি নারকেলের খোলের ওপর বার্তা খোদাই করে তুলে দেন স্থানীয় দুই সলোমন দ্বীপবাসীর হাতে। তাদের অসীম সাহসিকতায় সেই বার্তা পৌঁছে যায় মিত্র বাহিনীর কাছে। আর এই পুরোটা সময় শুধু নারকেল খেয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। দুদিন পর উদ্ধার পান কেনেডি। সেই ঐতিহাসিক নারকেলটি আজও বোস্টনের প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিতে সযত্নে রাখা আছে।
পৌরাণিক ও দার্শনিক রূপক
নারকেল শুধু মানুষের জীবনই বাঁচায়নি, মহাবিশ্বকে বোঝার রূপক হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, কুক দ্বীপপুঞ্জের এক সৃষ্টিপুরাণ অনুযায়ী, আমাদের এই মহাবিশ্বটাই যেন একটা বিশাল নারকেল! এর ভেতরের অংশ হলো পাতাল আর বাইরের শক্ত খোলসটি হলো আমাদের চেনা পৃথিবী।
আবার মানুষের জীবনদর্শনও উঠে এসেছে নারকেলকে ঘিরে নানা প্রবাদে। মালয়েশিয়ার একটি প্রবাদ ভাবার মতো—'নারকেলের খোলের নিচে থাকা ব্যাঙ ভাবে, এর বাইরে কোনো জগৎ নেই।' এর মানে হলো, সংকীর্ণমনা মানুষ নিজের ছোট গণ্ডিকেই পুরো দুনিয়া মনে করে। জাঞ্জিবারের আরেকটি প্রবাদও বেশ চমৎকার: 'এক খোল নারকেলের পানি একটা পিঁপড়ার কাছে সমুদ্রের সমান।' অর্থাৎ যার দৃষ্টি ছোট, তার কাছে সামান্য জিনিসও অনেক বড় মনে হয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রবাদে কর্মফল বোঝাতে নারকেলের উদাহরণ টেনে বলা হয়: 'নারকেলের খোল ভেসে থাকে আর পাথরের ভাগ্যে আছে ডুবে যাওয়া।' অর্থাৎ, জীবনে কারও ভাগ্যে ভেসে ওঠা আছে, আবার কারও ভাগ্যে ডুবে যাওয়া—এটাই নিয়তি।
সিনবাদ থেকে বাবর: অভিযাত্রীদের চোখে নারকেল
বিখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে আরব্য রজনীর নাবিক সিনবাদ—কার লেখায় নেই নারকেলের কথা! ষষ্ঠ শতকে আরব বণিকেরা সমুদ্রপথে মসলা আর নারকেলের বিশাল বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল। আরব্য রজনীর বিখ্যাত নাবিক সিনবাদও তার পঞ্চম অভিযানে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে নারকেল কেনাবেচা করে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন।
ত্রয়োদশ শতকে ইতালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো ইউরোপকে প্রথম নারকেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি ভারতে এসে এর নাম দিয়েছিলেন 'ফারাওয়ের বাদাম'। পোলো তার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলেন, ইউরোপে শুকনো নারকেল দেখে এর আসল মজা বোঝা সম্ভব নয়। গরম দেশে ক্লান্ত শরীরে ঠান্ডা ডাবের পানি আর নরম শাঁস খাওয়ার যে অনুভূতি, তা আর কিছুতেই মেলে না।

চতুর্দশ শতকে আরেক বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা মালদ্বীপে গিয়ে নারকেলের জন্ম নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প শুনেছিলেন। সেখানকার মানুষ বিশ্বাস করত, এক রাজার নির্দেশে এক মন্ত্রীর মাথা কেটে ফেলা হয়। পরে সেই মাথার ওপর একটি খেজুরবীজ পুঁতে দিলে সেখান থেকে যে গাছ জন্মায়, তা-ই হলো নারকেলগাছ!
এমনকি মোগল সম্রাট বাবরও তার আত্মজীবনী 'বাবরনামা'-তে নারকেলের কথা লিখেছেন। সুদূর কাবুলে বসে তিনি লিখেছেন, গরমকালে চিনির সঙ্গে নারকেলের পানি মিশিয়ে খেলে দারুণ লাগে।
মোগলদের রান্নার বইয়ে তো নারকেল, আম, আদা, লেবু আর নানা রকম মসলা দিয়ে বানানো শরবতের রেসিপিও পাওয়া যায়। বাবর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন—তখনকার দিনে নদী ও সমুদ্রের সব জাহাজের দড়ি বানানো হতো নারকেলের শক্ত আঁশ দিয়ে।