ডাবের আশ্চর্য শহরযাত্রা!
ধরুন, তীব্র ছাতিফাটা গরমে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। হাঁটতে গিয়ে তৃষ্ণা পেলে কী খেতে ইচ্ছে করবে, বলুন তো? পানি, ফলের জুস, ডাবের পানি, ঠান্ডা কোমলপানীয়সহ সব ধরনের পানীয়ই বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আপনার সামনে। আপনি কোনটি বেছে নেবেন?
যদি ডাব বেছে নেন, তাহলে বোঝা যাবে, সত্যিকারের ভালোবাসা বেছে নিয়েছেন। কারণ, ইংরেজিতে একটা কথা রয়েছে- 'ট্রু লাভ ইজ ওয়ান কোকোনাট অ্যান্ড টু স্ট্রজ'। অর্থাৎ, একটি ডাব ও দুটি স্ট্র হলো প্রকৃত ভালোবাসা।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ডাবের আবেদন কিন্তু এখনো এক ফোঁটাও কমেনি, বরং বেড়েছে। পানীয়ের তালিকায়ও ডাবের অবস্থান ওপরের দিকেই। তবে ডাব নিয়ে যতই 'রোমান্টিসিজম' থাকুক না কেন, ডাবের উৎপত্তি খুঁজতে গেলে উঠে আসে অনেক পুরোনো ইতিহাস। ডাব বা নারকেলের ইংরেজি রূপ 'কোকোনাট' শব্দটি এসেছে পর্তুগিজ শব্দ 'কোকো' থেকে। প্রথম দিকের স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা পনেরো শতকে নারকেলকে অভিহিত করতেন 'কোকোস' বা 'বানরের মুখ' হিসেবে।
অনেক উদ্ভিদবিদের ধারণা, ডাবের উৎপত্তি হয়েছিল পাপুয়া নিউগিনিতে। আবার অনেকে মনে করেন, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলই বুঝি ডাবের প্রথম উৎপত্তিস্থল। পরে শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ঘানাসহ পৃথিবীর প্রায় ৯৩টি দেশে এর বিস্তার ঘটে। উৎপত্তিস্থল যা-ই হোক, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে বর্তমানে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ ডাব বা নারকেল সরবরাহ হয় ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ফিলিপাইন থেকে। এর মধ্যে ২০২২ সালে শুধু ইন্দোনেশিয়ায় ডাব বা নারকেল উৎপাদন হয় ১ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার টন। বাংলাদেশ ডাব ও নারকেল উৎপাদনে বিশ্বের ১৫তম দেশ। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৪ লাখ টন ডাব ও নারকেল উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশে ডাবের উৎস
বাংলাদেশে লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাট ও নাটোর অঞ্চলে নারকেল বা ডাবের চাষ হয়। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, দেশের মোট নারকেল উৎপাদনের বড় অংশই উৎপাদন হয় উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলায়। ১৪৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের লক্ষ্মীপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে ডাব বা নারকেলগাছ। এত দিন নারকেলের জন্য এ জেলার সুনাম থাকলেও এখন ডাবের জন্যও সারা দেশে সুপরিচিত লক্ষ্মীপুর।
প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে মূলত ডাব বা নারকেলের ফলন ভালো হয়। উপকূলীয় উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া ডাব বা নারকেল চাষে অতি উপযোগী। সফলভাবে চাষ সম্প্রসারণের জন্য যে অনুকূল জলবায়ু দরকার, তার সবই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিরাজ করে। তা ছাড়া নারকেলগাছের জন্য মাটি নিয়েও কোনো সমস্যা হয় না। যেকোনো মাটিতেই এর ফলন ভালো হয়।
বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিসের তথ্যানুসারে, তারা বারি নারকেল-১ ও বারি নারকেল-২ নামে দুটি জাত অবমুক্ত করেছে। দুটি জাতই আকারে লম্বা ও মুক্ত পরাগায়িত। উপকূলীয় অঞ্চলের ভেতরে এ দুই জাতের ডাব সম্প্রসারণ করার যোগ্য।
ডাব ও নারকেলের পার্থক্য
ডাব ও নারকেল আদতে একই ফল হলেও অনেকে এর পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নন। নারকেল হলো ডাবের পরিপক্ব রূপ। ডাব পেকে গেলে তা নারকেলে রূপান্তরিত হয়।
ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম ও সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে; যা শরীরের জন্য ভীষণ কার্যকর। আকারভেদে একেকটি ডাবে থাকতে পারে ২০০ থেকে ১০০০ মিলিলিটার পর্যন্ত পানি। এ ছাড়া অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ অনেক পুষ্টি উপাদান থাকে ডাবের পানিতে।
ডাব যখন নারকেলে রূপান্তরিত হয়, তখন এর মধ্য থেকে পানির পরিমাণ অনেকখানি হ্রাস পায়; যার ফলে মোটা শাঁস তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, ডাবের পানি থেকে পুষ্টি হিসেবে যে পরিমাণ খনিজ পাওয়া যেত, সেটি নারকেল হওয়ার পর সেসবের পরিমাণও হ্রাস পায়। যার জন্য নারকেলের পানির তুলনায় ডাবের পানি বেশি পুষ্টিকর বলে ধরা হয়।
কেন তড়তড়িয়ে বাড়ছে ডাবের দাম
সময়ের সাথে সাথে ডাবের উৎপাদন বাড়লেও ডাবের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে বেজায় আক্ষেপ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই লাগামহীনভাবে বাড়ছে ডাবের দাম। ২৫ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলার পাঁচজন পাইকারি ডাব ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে বর্তমানে মাঠপর্যায়ে ডাবের দাম সর্ম্পকে জানা যায়। তারা জানান, বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে ডাব বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। তা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে এলে দাঁড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। শহরে এলেই মূল্য বেড়ে যায় প্রায় ৪ গুণ।
কমলনগর উপজেলার তোরাব আলী মিয়ার খামারবাড়িতে রয়েছে ১ হাজার ৫০০ নারকেলগাছ। এ বাড়ি থেকে প্রতি দেড় থেকে দুই মাস পরপর ডাব বিক্রি করা হয়। প্রতিবার বিক্রি হয় ২ থেকে ৩ হাজার ডাব। বাগানমালিক নুরুল আমিন মিয়া জানান, কয়েক মাস আগে প্রতি হাজার ডাব ২৮ থেকে ৩৫ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করেছেন স্থানীয় এক পাইকারের কাছে। বর্তমানে তার বিক্রয়মূল্য ৫০-৫৫ হাজার টাকা। খামারের বয়স প্রায় শত বছর।
ব্যবসায়ী নুরুল আমিন মিয়া বলেন, শহরে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় ডাব কিনে খেলেও গত ২ বছরের মধ্যে কখনো ২৮-৫৫ টাকার বেশি মূল্যে ডাব বিক্রি করতে পারেননি তিনি।
ব্যবসায়ীদের তথ্যে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় প্রায় ৭০ জন ডাব ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা স্থানীয় বাজার ও বাগান থেকে ডাব কিনে বড় শহরে নিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন।
স্থানীয় পাইকারি ডাব ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ৩-৪ লাখ ডাব বড় শহরে বিক্রি হয়। কিন্তু রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় দৈনিক কমপক্ষে ৭ লাখ।
ডাবের পরিবহন চক্র
ব্যবসায়ীদের মতে, গ্রাম থেকে শহরের একজন ক্রেতার হাতে এক একটি ডাব পৌঁছাতে এর মধ্যে প্রায় ১২ বার হাতবদল হয়। প্রতিটি হাতেই থাকে লাভের হিসাব। আবার ডাবপ্রতি ২০-৩০ টাকা লাভ নেয় শহরের মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা আড়তদার।
লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের মেঘনা বাজারের ডাবের স্থানীয় আড়তদার ও ডাব ব্যবসায়ী মো. রবিউল আলম ১৮ বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করছেন। তিনি স্থানীয় বাগানমালিক ও ছোট ছোট ব্যবসায়ীর থেকে ডাব কিনে পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার বড় পাইকারি আড়তে বিক্রি করেন।
রবিউল বলেন, প্রথমত, তারা বাগানের বা বাড়ির মালিকদের থেকে বর্তমানে প্রতিটি ডাব গড়ে কিনেছেন ৫০-৫৫ টাকায়। দ্বিতীয়ত, গাছ থেকে প্রতিটি ডাব নামাতে স্থানীয় পাড়িয়াদের (যারা গাছ থেকে ডাব কাটে) জন্য খরচ করতে হয় ৩-৪ টাকা। তৃতীয়ত, যারা গাছের গোড়ায় রশি ধরে এবং ঝরা ডাব এক স্থানে জড়ো করে, তাদের দিতে হয় ডাবপ্রতি ৪০-৫০ পয়সা। চতুর্থত, স্থানীয় ভ্যানচালক বা ছোট ট্রাক ড্রাইভারকে দিয়ে স্থানীয় আড়তে জড়ো করতে খরচ ২ টাকা।
এরপর শুরু হয় ডাব ঢাকায় নিয়ে আসার কর্মযজ্ঞ। পঞ্চম হাত হিসেবে ডাব ট্রাকযোগে ঢাকার আড়তে পৌঁছাতে খরচ হয় আরও ৪-৫ টাকা। তখন আড়তের শ্রমিকদের দিতে হয় ৪০-৫০ পয়সা। আড়ত পর্যন্ত পৌঁছাতে একজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর প্রতিটি ডাবে খরচ হয় ১০-১৪ টাকা। যখন স্থানীয় একজন বিক্রেতা ঢাকার বাজারে যখন ডাব নিয়ে পৌঁছান, তখন বাগানে কেনা ৫৫ টাকা দামের ডাবের মূল্য দাঁড়ায় কমপক্ষে ৭৫ টাকায়। তার সাথে নিজের খরচ, বিনিয়োগ এবং শারীরিক পরিশ্রম মিলে জেলার একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ৪-৫ টাকা লাভে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার আড়তদারদের নিকট ডাব বিক্রি করেন গড়ে ৮০ টাকায়। এরপর অষ্টম হাত হিসেবে বড় শহরের আড়তদারদের কাছে ডাব পৌঁছায়।
রবিউল আলম আরও জানান, 'গ্রাম থেকে অনেক রকম কষ্ট করে ডাব নিয়ে বড় শহরে এনে আমরা সর্বোচ্চ ৪-৫ টাকা লাভ করি। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে শহরের আড়তদারেরা নবম হাত হিসেবে ভ্যানচালক কিংবা ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে ২০-৩০ টাকা লাভে ডাব বিক্রি করেন। মাঝেমধ্যে আরও ২টি জায়গায় ডাবপ্রতি টাকা খরচ করতে হয়। সবশেষে একজন গ্রাহক ভ্যানে করে ডাব বিক্রয়কারীদের ১০-২০ টাকা লাভ দিয়ে ডাব কিনে খায় ১০০-১৫০ টাকায়। এইভাবে ১২ হাত বদল হয়ে ডাব শহরে পৌঁছায়।
বরিশাল থেকেও একইভাবে কয়েক হাত বদলের পর ডাব ঢাকায় এসে পৌঁছায়। সেখানেও খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে ডাবচাষিরা সব সময় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। ঝালকাঠি সদরের ডাবের পাইকারি কালেক্টর হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমে বাগান থেকে একটি ডাব বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এরপর তা স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
বরিশালের আরেকজন পাইকারি ডাব সরবরাহকারী মিজানুর রহমান জানান, ঢাকায় পাঠানো ডাব গ্রীষ্মকালে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ডাবের দাম তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। এর মূল কারণ হিসেবে অবশ্য ডাবগাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকেই চিহ্নিত করেছেন তিনি। বরিশাল থেকে ডাব ঢাকার কদমতলীতে আসার পর ঢাকার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি ছড়িয়ে পড়ে খুচরা শুরু হয়।
ডাব শুধু রোগীর পথ্য!
ডাবের পানির উচ্চমূল্যের কারণে স্বাভাবিকভাবে ডাবের পানি পান করা অনেক মানুষের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এর ফলে যারা শরীর সুস্থ রাখতে বা গরমে পানিশূন্যতা দূর করতে ডাব খেতে চাইতেন, তাদের অনেকেই এখন এটি এড়িয়ে চলছেন এবং শুধু চিকিৎসার প্রয়োজনে বা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা রোগীরাই এখন এটি বেশি কিনছেন।
কমছে নারকেলের উৎপাদন
ডাবের চাহিদা বাড়ার কারণে কমে যাচ্ছে নারকেলের উৎপাদন। নারকেলচাষি ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. হাসান শরীফ জানান, কোমল পানীয় হিসেবে অতীতে সব সময়ই কমবেশি ডাবের চাহিদা ছিল। কিন্তু দেশব্যাপী করোনাসহ বিভিন্ন জ্বরের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় প্রচুর পরিমাণ ডাবের চাহিদা তৈরি হয়েছে। চাহিদার সাথে সাথে ডাবের দাম নারকেলের চেয়ে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা এখন গাছ শূন্য করে ডাব বিক্রি করে ফেলছে। এতে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নারকেল উৎপাদন প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে দেশব্যাপী অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে ডাবের দাম।
রামগঞ্জ উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের ফরিদ আহমেদ জানান, নারকেলের তুলনায় ডাবে বেশি টাকা পাওয়া যায়, তাই বাগানের মালিকেরা এখন সারা বছরই ডাব বিক্রি করে দিচ্ছেন। বছরে ৬-৭ বার ডাব বিক্রি করা যায়। কিন্তু নারকেল বিক্রি করা যায় বছরে ২ বার; এখন ডাবেই আয় বেশি।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের নারকেল উৎপাদনকারী আলাউদ্দিন সাজু জানান, যেখানে একটি ডাব উৎপাদনে সময় লাগে মাত্র দেড় থেকে দুই মাস; সেখানে একটি নারকেল উৎপাদনে সময় লাগে কমপক্ষে ৬ মাস। তাই চাষিরা এখন ডাবই বিক্রি করছেন।
অন্যদিকে হায়দারগঞ্জ বাজারের নারকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানায়, বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক গাছ শূন্য করে ব্যাপক হারে ডাব বিক্রি করে ফেলছেন। এতে লক্ষ্মীপুরসহ সারা দেশে নারকেলকেন্দ্রিক অন্তত ৫টি শিল্পে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডাব বিক্রির কারণে নারকেলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রভাব পড়তে পারে তেলশিল্প, নারকেলজাত পণ্য-ছোবড়াশিল্প, মশার কয়েল ফ্যাক্টরি, কোকোডাস্ট এবং মালাশিল্পের ওপর।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলায় ২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারকেলবাগান রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারকেলগাছ রয়েছে। বাগান ও বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি শুকনো নারকেল আহরণ করা হয়। সে তুলনায়, প্রতি মাসে গড়ে ডাব বিক্রি হয় প্রায় দেড় কোটি।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণের উপপরিচালক জানান, ডাব ও নারকেল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চাষিদের বছরে আয় প্রায় সাড়ে তিন শ থেকে প্রায় চার শ কোটি টাকা। ডাব বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার অতি মূল্যবান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে।
শরীর ও ত্বকের যত্নে ডাব
কেবল আর্থিক ক্ষেত্রেই নয়, স্বাস্থ্যেও ডাবের পানির জুড়ি মেলা ভার। আমাদের দেশে সামাজিকভাবে ধারণা করা হয়, ডাবের পানি নিয়মিত খেলে রোগবালাই কমে।
এছাড়া ডাবের পানিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি; যা সানবার্ন বা রোদে পোড়া দাগ দূর করতে সাহায্য করে। অনেকে আবার ডাবের পানিকে ক্লিঞ্জার হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি যেমন ত্বকের ময়লা দূর করে, তেমনি ব্রণ কমাতেও সাহায্য করে। ডাবের পানি ত্বকে উজ্জ্বলতা এনে দেয়। পাশাপাশি ত্বকের শুষ্কতা দূর করে ও আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনে।
কথায় আছে, 'জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা।' না, এখানে আমরা তেলের কথা বলব না। চুলের যত্নে নারকেল তেলের যে কত উপকারিতা, সেটা তো আমরা সবাই কমবেশি জানিই। কিন্তু, নিস্তেজ প্রাণহীন চুলে প্রাণ ফেরাতে যে ডাবের পানি অব্যর্থ, সেটি অনেকের কাছেই অজানা। ডাবের পানি মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন করতে সাহায্য করে; যা চুল পড়ার সমস্যা সমাধান করে। এটি চুলের ঘনত্ব বাড়ায় এবং ভাঙন রোধ করে চুলকে শক্তিশালী করে।
আবার বসন্ত রোগ থেকে সেরে উঠলে অনেকেরই হাতে, মুখে দাগ হয়ে যায়। এই দাগের তীব্রতা কমাতেও ডাব সাহায্য করে।
স্বাদে আহ্লাদে ডাব
ডাব কিনতে গেলেই বিভিন্নজনের শুরু হয়ে যায় নানান রকম চাহিদা। কেউ বলেন কচি ডাব চাই, কারও চাহিদা থাকে শাঁসওয়ালা ডাবের। ডাব নিয়ে শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় 'উদরপুরাণ এবং অন্যান্য বৈঠকি গল্প'য় লিখেছেন, একবার হুগলিতে মোক্তার গুরুদাস বসুর বাড়িতে গিয়ে সুন্দর কচি ডাব দেখে তা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। একটি ডাব কেটে তাকে পরিবেশন করা হলে রামমোহন বলেছিলেন, 'ওতে আমার কী হবে? ওই কাঁদিসুদ্ধ ডাব পেড়ে ফেল।'
ডাব নিয়ে হেঁশেলে উঁকি দিলে পাওয়া যাবে ডাবের পুডিংয়ের দেখা। ডিমের পুডিং তো হরহামেশাই পাওয়া যায়; কিন্তু ডাবের পুডিং স্বাদে একেবারেই অনন্য। ডাবের পানি ও কচি শাঁসের সমন্বয়ে তৈরি হয় এই অমৃত খাবার।
আবার ধরা যাক, ডাব-চিংড়ির কথা। চিংড়ি মাছ যে ডাব দিয়ে রান্না করা যায়, তা বোধ হয় কস্মিনকালেও কেউ ভাবেনি। কিন্তু ডাব ও চিংড়ির অপূর্ব মেলবন্ধন জিহ্বায় যে মনোহর স্বাদের উন্মেষ ঘটাবে, তার রেশ মনে থেকে যাবে বহুদিন।
ডাব চিংড়ি তৈরির জন্য প্রথমে গলদা চিংড়িকে বিভিন্ন মসলা, ডাবের পানি ও নারকেলের দুধসমেত কারির মতো রান্না করতে হবে। পাশাপাশি প্রস্তুত করতে হবে ডাবকে; ডাবের মাথার অংশ কেটে ভেতর থেকে সব পানি আলাদা করে রাখতে হবে। এরপর চিংড়ির কারি ডাবের মধ্যে পুরে ডাবের মুখে আটা মাখা লাগিয়ে ডাবের কাটা টুকরো ঠেসে লাগিয়ে দিতে হবে। শেষে ডাবটিকে গরম পানির পাত্রের মধ্যে বসিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিতে হবে। এভাবে ৪৫ মিনিট মাঝারি আঁচে রেখে রান্না করলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার ডাব-চিংড়ি।
ডাবের উৎপত্তি নিয়ে কিংবদন্তি!
ডাবের উৎপত্তি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা লোককথা প্রচলিত আছে। ভারতের কেরালার উপকথা অনুযায়ী, ডাবের বা নারকেলের সৃষ্টি হয়েছে একজন জেলের কাটা মাথা থেকে। তাদের মতে, কেরালার একজন জেলে মাছ ধরার অনেক চেষ্টা করেও প্রতিবার ব্যর্থ হতেন। এই ব্যর্থতা তাকে সকলের কাছে হাসির পাত্র করে তুলেছিল। একসময় জেলেটি ঠিক করেন যে তিনি মাছ ধরার জন্য জাদু শিখবেন। একজন বিখ্যাত জাদুকরের কাছে যাওয়ার পর জেলে শেখেন একটি অদ্ভুত জাদু-তা হলো জীবিত অবস্থায় শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে মাছ ধরার জাদু।
জাদু শেখার পর জেলেটি পুনরায় সমুদ্র তীরে যান এবং ঝোপের আড়ালে থেকে অন্যান্য জেলের গতিবিধি লক্ষ করতে শুরু করেন। অন্যান্য জেলে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবার পর শুরু হয় জেলের কাজ।
জাদুবলে নিজের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে জেলেটি মৃত মানুষের মতো সমুদ্রতটে ভাসতে শুরু করেন। জেলের লক্ষ্য ছিল একটাই-সমুদ্রের মাছেরা যখন মস্তকবিহীন শরীর পড়ে থাকতে দেখে
কৌতূহলের বশে ঘাড় দিয়ে শরীরে প্রবেশ করবে, তখনই সে তীরে সাঁতার কেটে উঠে কাটা মাথা জোড়া লাগাবে। পরিকল্পনা অনুসারে জেলে সফল হলো এবং এভাবেই তার মাছ ধরার যাত্রা শুরু হলো।
মাছ ধরার জাল ছাড়াই জেলেকে প্রতিদিন এত এত মাছ ধরতে দেখে গ্রামবাসীর মনে সন্দেহ জাগে। কৌতূহলের বশে গ্রামের একটি ছোট ছেলে একদিন ঐ জেলেকে অনুসরণ করে। আড়াল থেকে দেখে তার কাজকর্ম। ছেলেটি যখন দেখে জেলে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে পানিতে ডুব দিয়েছে, তখনই সে কাটা মাথা নিয়ে এসে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। জেলেটি সমুদ্র থেকে উঠে এসে তন্ন তন্ন করে নিজের কাটা মাথা খুঁজতে শুরু করে; কিন্তু আর খুঁজে পায় না। ততক্ষণে তার জাদুর ক্ষমতাও ফুরিয়ে যায়। শোনা যায়, জেলেটি তার মস্তকহীন শরীরকে সমুদ্রের কাছে বিলিয়ে দেয় এবং মাছে রূপান্তরিত হয়।
পরবর্তী সময়ে ছোট ছেলেটি যখন আবার গ্রামবাসীকে জেলের কাটা মাথা দেখাতে যায়, তখন দেখে সেই মাথাটি একটি গাছের রূপ নিয়েছে এবং সেই গাছে জেলের মাথার ন্যায় ডাব ফলের জন্ম হয়েছে। কথিত আছে, ভারতের কেরালা বা কেরল প্রদেশের 'কের' নামও এসেছে নারকেলগাছ থেকে।
ডাব বা নারকেলের উৎপত্তি নিয়ে চীনেও লোককাহিনি প্রচলিত রয়েছে। নারকেল বা ডাবের চায়নিজ নাম এসেছে ইউ ওয়াং তু থেকে, যার অর্থ 'ইউ'-এর প্রধান রাজপুত্র। একটি চীনা কিংবদন্তি অনুসারে, একদা রাজপুত্র লিন ইর সাথে ইউ রাজ্যের রাজপুত্রের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে ইউয়ের রাজপুত্র পরাজিত হন এবং তাকে হত্যা করে তার মাথা একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কথিত আছে, এই কাটা মাথাই পরবর্তী সময়ে ডাব বা নারকেলে রূপ নেয়।
ডাবের উৎপত্তি নিয়ে মালয়েশিয়ারও নিজস্ব লোককাহিনি আছে। তাদের কিংবদন্তি অনুযায়ী, অনেক বছর আগে হাজার বছর বয়সী একজন জ্ঞানী ঋষি বাস করতেন। একদিন এক যুবক বর প্রার্থনা করতে সেই ঋষির কাছে আসেন। যুবকটি প্রার্থনা করেন, তিনি সারা জীবন ভালো কাজ করতে চান এবং মানুষের সেবা করতে চান। এটি শুনে ঋষিটি যুবকের হাতে একটি জাদুর বাক্স ধরিয়ে দেন এবং বলেন, বাড়ি ফিরে যদি যুবক বাক্সটি খোলে, তবেই তার ইচ্ছে পূরণ হবে।
যুবকটি বাক্স নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। কিন্তু পথে কৌতূহল সামলাতে না পেরে বাক্সটি খুলে দেখেন যুবক। আর তাতেই লাগে অভিশাপ, ঋষির কথা অমান্য করায় যুবকটি রূপান্তরিত হয় একটি ডাবগাছে। তবে মনে করা হয়, যুবকটির ইচ্ছেও পূরণ হয়েছিল। তিনি ডাব বা নারকেল হয়েই মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।
ভারতবর্ষে ডাব বা নারকেলকে প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। এমনকি হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ডাবগাছকে বলা হয় 'কল্পবৃক্ষ'। অর্থাৎ যে বৃক্ষ সব ধরনের ইচ্ছে পূরণ করে; আরেক অর্থে যে বৃক্ষ জীবনধারণের সকল প্রয়োজন মেটায়। মালয়েশিয়াতে ডাবগাছকে বলা হয় 'পকক সেরিবু বুনা'। অর্থাৎ যে বৃক্ষ হাজারো রকমের কাজ করে থাকে। ইন্দোনেশিয়াতে ডাবগাছকে মনে করা হয় 'প্রাচুর্যের উৎস'। অপর দিকে ফিলিপাইনে ডাবগাছকে বলা হয় 'জীবনের গাছ' বা 'স্বর্গের গাছ'।
সুমিষ্ট পানীয় জলের কারণে ডাবের চাহিদা আদতে কমার নয়, বরং দিন দিন তা বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এই কারণেই প্রতিবছর ২ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব ডাব দিবস। মূলত ডাব নিয়ে জনমানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাই এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।