গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তরের আগে দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্টের ব্যয় বাড়ল ৩৮৫ কোটি টাকা

দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় ৩৮৫ কোটি টাকা (১২.৭৭ শতাংশ) বেড়েছে।
এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড তাদের 'এস্টাবলিশমেন্ট অভ এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার অ্যাট মুন্সীগঞ্জ' প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে এর ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য আর্থিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, পণ্য আমদানির সময়সীমা বৃদ্ধি ও উন্নত প্রযুক্তিগত চাহিদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) প্রকল্পটির অনুমোদিত দেওয়া হয়। তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা।
সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তা ২৬৭.৫ কোটি টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৩৭.৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যয় মেটাতে, মূলত ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায়, প্রকল্পে বাড়তি ১.৭৬ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদেশি পণ্য পরিবহনের সময়সীমা বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত খরচ সমন্বয়ের জন্য ব্যাংক ও বিমা চার্জ খাতে সরকারের তহবিল থেকে অতিরিক্ত ২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এ খাত থেকে ১৭.২৫ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ মেশিন ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ইতিমধ্যেই ডিজাইন-বিল্ড টার্নকি প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত আছে।
প্রশিক্ষণ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমে ডিপিপিতে ১১টি কর্মসূচির (৫টি দেশীয় ও ৬টি বিদেশি) জন্য ১০.৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত প্রস্তাবে মুদ্রা বিনিময় হারের ওঠানামা সমন্বয় করতে অতিরিক্ত ১.৪১ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর বাইরে কাজের পরিধি বাড়াতে আরও ৭.৭১ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে, যার মধ্যে দুটি অতিরিক্ত দেশীয় প্রশিক্ষণের জন্য ৫২.৮৫ লাখ টাকা ও চারটি অতিরিক্ত বিদেশি প্রশিক্ষণের জন্য ৭.১৮ কোটি টাকা রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ এখন ১৯.৫০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
পরামর্শক সেবা খাতে বড় ধরনের ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে। মূল প্রস্তাবে ১৭.৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও টার্নকি পরামর্শক খাতের ৬০ কোটি টাকা ও টার্মস অভ রেফারেন্স (টিওআর) তৈরির জন্য পরামর্শক খাতের ১০ কোটি টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিনিয়র প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ প্যাকেজ থেকে ১.৮০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
এদিকে প্রকল্প অনুমোদনের প্রায় দুই বছর পরও এর বাস্তবায়ন এখনও শুরু হয়নি। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে বাড়িয়ে ২০৩২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পটি প্রথমে গোপালগঞ্জে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়েছিল, কিন্তু পরে একে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বিসিক শিল্প পার্কে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দেশের একমাত্র ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট প্রকল্প 'এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার'-এর কাজ ২০২০ সালে গোপালগঞ্জে শুরু হয়। গত বছর এসেনশিয়াল ড্রাগসের তৃতীয় উৎপাদন কেন্দ্রের পাশে জেলাটিতে ৬.৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার প্ল্যান্টটি গোপালগঞ্জে স্থাপনের পরিকল্পনা বাতিল করে।
গত মে মাসে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য) অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গোপালগঞ্জ ভৌগোলিকভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও যোগাযোগের জন্য বিচ্ছিন্ন একটি জায়গা।
তিনি বলেন, 'শুরুতে কেন গোপালগঞ্জকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, তা সবাই জানে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি মূলত ঢাকা ও এর আশেপাশেই কেন্দ্রীভূত।'
স্থানান্তরের কারণ
কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ যাতায়াত ও পরিচালনগত দিক থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক। মূলত এ কারণেই এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রকল্পটি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় স্থানান্তর করা হচ্ছে।
সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, নতুন স্থানটি রাজধানীতে অবস্থিত সরকারি সংস্থা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেন, এই স্থানান্তরের ফলে বিদেশি পরামর্শক, টার্নকি সলিউশন প্রোভাইডার, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিশেষজ্ঞদের যাতায়াতও সহজ হবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়াটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। দূরত্ব কম হওয়ায় কাঁচামাল আমদানি এবং ভ্যাকসিন ও থেরাপিউটিক ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে কোল্ড চেইন সরবরাহ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকবে।
প্রস্তাবিত ভ্যাকসিন প্ল্যান্টটি এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের নতুন ওষুধ প্ল্যান্টের পাশেই স্থাপন করা হবে। ফলে উভয় প্রতিষ্ঠান কারিগরি সহায়তা সেবা ভাগাভাগি করে নিতে পারবে।