দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে স্থানান্তরের পরিকল্পনা সরকারের

গোপালগঞ্জের পরিবর্তে ঢাকার পাশে মুন্সিগঞ্জে দেশের প্রথম ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এটি স্থানান্তরিত হবে।
জানা গেছে, ঢাকার কাছাকাছি গবেষণা ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগের সুবিধার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) ইতোমধ্যে বিসিকের কাছে ৪০ একর জমির জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
দেশের একমাত্র ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট প্রকল্প 'এসেনশিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার' স্থাপনের কাজ ২০২০ সালে গোপালগঞ্জে শুরু হয়। গত বছর জেলায় ইডিসিএলের তৃতীয় উৎপাদন কেন্দ্রের পাশে ৬.৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
৩,১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল, দেশের নিজস্ব ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা।
তবে গত বছর জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকার পতন পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গোপালগঞ্জে প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।
ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সামাদ মৃধা জানান, ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট পরিচালনার জন্য বিদেশি বিজ্ঞানী ও টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত যাতায়াত এবং কখনও কখনও তাদের ছয় মাস পর্যন্ত অবস্থান করতে হতে পারে—প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাববেক্ষণের জন্য।
তিনি বলেন, "তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানসম্পন্ন আবাসন ও খাবার সরবরাহের জন্য ফাইভ-স্টার মানের সুবিধা প্রয়োজন, যা গোপালগঞ্জে নেই।"
"এছাড়া, ঢাকায় অবস্থান করে গোপালগঞ্জে প্রতিদিন যাতায়াত করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এই বিশেষজ্ঞদের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্যই ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট রাজধানীর কাছাকাছি মুন্সিগঞ্জে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
ইডিসিএল সূত্রে জানা গেছে, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেকের সময় প্রতিষ্ঠানটি জরুরি ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে এর তেজগাঁও কারখানা মানিকগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকার সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।
বর্তমানে মুন্সিগঞ্জে ৪০ একর জমিতে ভ্যাকসিন এবং ওষুধ—উভয় প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। জেলার ৩১০ একর জমিতে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক থেকে জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছে ইডিসিএল।
সংস্থাটির সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জে ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণে ইতোমধ্যে ২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গোপালগঞ্জে যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেটি ইডিসিএলের বিদ্যমান প্ল্যান্টের আওতাভুক্ত থাকবে।
তিনি বলেন, "এ ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও সম্পৃক্ততার দিক থেকে গোপালগঞ্জ ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। সবাই জানে কেন শুরুতে গোপালগঞ্জকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। তবে বাস্তবতায় ভ্যাকসিন গবেষণায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল মূলত ঢাকা ও আশপাশেই আছে।"
এই প্ল্যান্টে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস), কোভিড-১৯, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইনঅ্যাকটিভেটেড পোলিও (আইপিভি) এবং ডেঙ্গুসহ মোট ১৪ ধরনের টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।
টিকা ছাড়াও এই প্ল্যান্টে বিভিন্ন থেরাপিউটিকস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে—যার মধ্যে রয়েছে এরিথ্রোপোয়েটিন (ইপিও) ২,০০০, ৩,০০০ ও ৫,০০০ আইইউ ডোস, ইন্টারফেরন (৪.৫ এমআইইউ), লং-এক্টিং পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন এবং ফিলগ্রাস্টিম/জি-সিএসএফ ইনজেকশন ইত্যাদি।
এছাড়াও অ্যান্টিজেন ও পিসিআর টেস্ট কিট, হিউম্যান ও ভেটেরিনারি র্যাপিড টেস্ট কিট এবং পশুচিকিৎসায় ব্যবহৃত ইলাইসা কিটসহ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। নতুন স্থান চূড়ান্ত হলে সংশোধিত প্রস্তাবনা জমা দেওয়া হবে। স্থানান্তরের সময় নকশা ও ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আনা হলেও যেসব টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেগুলোই তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন ডা. সায়েদুর রহমান।
তিনি বলেন, "আমরা যদি 'ওয়ান হেলথ' পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারি—যেখানে মানুষ ও প্রাণীর টিকা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত থাকবে—তাহলে এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা অঞ্চলই উপকৃত হবে।"
তিনি আরও বলেন, "এই ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট মহামারির জন্য প্রস্তুতির একটা অংশ। এটি ইডিসিএলের নামে অনুমোদিত হয়েছে। ভ্যাকসিন ও ওষুধ—দুটি প্ল্যান্ট চালু হলে ইডিসিএলের উৎপাদন ক্ষমতা দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে।"