সৌর প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমলো উন্মুক্ত দরপত্রে

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেশব্যাপী সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য পাওয়া সর্বশেষ দরপত্র প্রস্তাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচে নজিরবিহীন পতন ঘটেছে। এই ঘটনা শুধু দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের জন্য এক নতুন যুগের ইঙ্গিতই নয়, বরং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় অঙ্কের সাশ্রয়েরও বার্তা দিচ্ছে।
বিপিডিবি কর্মকর্তারা জানান, নতুন দরপত্রে গড়ে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা সৌরবিদ্যুতের দর দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৭ সেন্ট—যা বর্তমান গড় খরচ ১৩ দশমিক ২৯ সেন্টের তুলনায় ৩৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।
সাম্প্রতিক সময়ে বিপিডিবির উন্মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দরপত্র পদ্ধতি গ্রহণের ফলে এবং বিশ্ববাজারে সোলার প্যানেলের দামে ধারাবাহিক পতনের কারণে— এই প্রতিযোগিতামূলক দর সম্ভব হয়েছে।
নতুন গড় দর ৮.২৭ সেন্ট, যা আগের সরকারের অনুমোদিত অগ্রিম সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর চুক্তি মূল্যের তুলনায়ও ২১ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
অগ্রিম প্রকল্প থেকে উন্মুক্ত দরপত্রে
সরকার পরিবর্তনের পর গতবছর বিদ্যুৎখাতে নীতিগত পরিবর্তনের অংশ হিসেবে, বিপিডিবি আগের সরকারের অনুমোদিত ৩৪টি অগ্রিম সৌর প্রকল্পের লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) বাতিল করে। এসব কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ছিল ২,৩৪৪ মেগাওয়াট, যা আওয়ামী লীগ সরকার অনুমোদন করেছিল।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত বিপিডিবি চারটি প্যাকেজে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। এসবের আওতায়, মোট ৫,২৩৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৫৫টি গ্রিড-সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব আসে।
"চারটি প্যাকেজের মধ্যে এপর্যন্ত আমরা প্যাকেজ-১ ও প্যাকেজ-৪ এর আর্থিক ও কারিগরি মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছি। এর আগের সরকারের সময়ে নেওয়া আনসলিসেটেড (অগ্রিম) প্রকল্পগুলোর তুলনায় এসব প্রস্তাবে বিদ্যুতের দর অনেক কম," বলেন বিপিডিবির ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) সেল-১ এর পরিচালক গোলাম মর্তুজা। তিনি জানান, বাকি দুটি প্যাকেজের মূল্যায়নও শিগগিরই শুরু হবে।
বৈশ্বিক দরপতনে স্থানীয় সুবিধা
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বিপিডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, সৌরবিদ্যুতের দর কমার অন্যতম কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে সৌর প্যানেলের দামের পতন। গোলাম মর্তুজা জানান, "আগে যখন অগ্রিম চুক্তিগুলো করা হয়েছিল, তখন সোলার প্যানেলের দাম ছিল প্রতি ওয়াটে ২৭ সেন্ট। এখন তা নেমে এসেছে ৮ থেকে ৯ সেন্টে। এতে সোলার প্রজেক্টের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।"
তিনি আরও জানান, আগামী অক্টোবরের মধ্যে এসব প্রস্তাব বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে ক্রয় কমিটির পর্যালোচনা ও অনুমোদন শেষে পুরো প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।
অঞ্চলভেদে দরপতন
সৌরবিদ্যুতের নতুন ট্যারিফ বা দর প্রস্তাবগুলোয় অঞ্চলভেদে উল্লেখযোগ্য তারতম্য দেখা গেছে। এলওআই চুক্তিগুলোর তুলনায় যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া। নতুন প্রস্তাবিত এসব দর নিম্নরূপ—
- উত্তরবঙ্গ: প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার আগের ১০.৪২ সেন্ট থেকে কমে নতুন দর এসেছে ৭.৮৯ সেন্ট – অর্থাৎ কমেছে ২৪.৩১ শতাংশ।
- চট্টগ্রাম: নতুন দর ৭.৯৫ সেন্ট (আগে ছিল ১২.১০ সেন্ট) – কমেছে ৩৪.৩৩ শতাংশ।
- ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের জন্য কমেছে যথাক্রমে ১০.৫৮ এবং ৮.৩১ শতাংশ।
সবচেয়ে কম দর এসেছে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ১০ মেগাওয়াটের একটি প্ল্যান্ট থেকে – প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় ৭.৪৯ সেন্ট। এরপর রয়েছে মৌলভীবাজারের ২৫ মেগাওয়াট প্রকল্পের ৭.৬৭ সেন্ট দর। অন্যদিকে, সর্বোচ্চ দর প্রস্তাব এসেছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একটি ১৫০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে – ৯.২৯ সেন্ট।
বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থায়ন, বাস্তবায়ন চুক্তি না থাকা
সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রতিশ্রুতিশীল ট্যারিফ হার সত্ত্বেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে অর্থায়ন নিশ্চিত করা নিয়ে। কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুন প্রকল্পগুলোর জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকারীদের সঙ্গে ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ) বা বাস্তবায়ন চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণত আইএ কোনো প্রকল্পের জন্য সরকারি গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করে, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ঋণের জন্য প্রকল্পকে "ব্যাংকেবল" করে তোলে।
বাংলাদেশের জন্য ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর প্রধান জ্বালানি বিশ্লেষক শফিকুল আলম সতর্ক করে বলেছেন, শক্তিশালী সরকারি গ্যারান্টি না থাকলে অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হবে, কারণ বৈশ্বিক ও স্থানীয় ঋণদাতারা এ ধরনের নিশ্চয়তাই খোঁজেন।
তিনি উল্লেখ করেন, "গ্যারান্টি [যেমন আইএ] ছাড়া কোম্পানিগুলো তহবিল সংগ্রহে হিমশিম খেতে পারে, কারণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা এ ধরনের নিশ্চয়তা চান।"
তবে এসব আশঙ্কা নাকচ করে বিপিডিবির আইপিপি সেল–১ এর পরিচালক গোলাম মর্তুজা জোর দিয়ে বলেন, "আইএ বাতিল করা হয়েছে, তবে আমরা নিশ্চয়তা দেব যে বিপিডিবি অন্তত ১০ থেকে ২০ বছর বিদ্যুৎ কিনবে এবং কোনো চুক্তি প্রথম ১০ বছরের মধ্যে বাতিল করা হবে না। আগ্রহী কোম্পানিগুলোর প্রোফাইল ভালো হলে ব্যাংকগুলো অবশ্যই অর্থায়ন করবে।"
শফিকুল আলম মন্তব্য করেন, এসব অর্থায়ন চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করা গেলে বাংলাদেশের জন্য এটি হতে পারে এক রূপান্তরমূলক অগ্রগতি। তিনি বলেন, "সরকার যদি এসব সোলার প্রজেক্ট সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে দরপত্রে প্রস্তাবিত গড় ট্যারিফ ভবিষ্যতের জন্য একটি মানদণ্ড হয়ে উঠবে।"
তিনি আরও বলেন, ৮.২৭ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা হারে সফলভাবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎখাতে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে, যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক সুফল বয়ে আনবে।