সৌরবিদ্যুতের প্রথম রাইন্ডের দরপত্রে সাড়া দেয়নি কোনো বিদেশি কোম্পানি

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নেওয়া নতুন উদ্যোগে— জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। আকস্মিক চুক্তি বাতিল, নীতির অস্থিরতা এবং টেকসই আর্থিক মডেলের অভাবকে এ অবস্থার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ২ জুন পিডিবি ৩৫৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি গ্রিড-সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম প্যাকেজের দরপত্র খোলে। ছয়বার সময় বাড়ানোর পর অনুষ্ঠিত এ দরপত্রে কোনো বিদেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। মাত্র ২০টি দরপত্র জমা পড়েছে, যার সবগুলোই দেশীয় কোম্পানির পক্ষ থেকে।
বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সক্রিয় চীনা কোম্পানিগুলোও দরপত্রে অংশ নেয়নি। অথচ এর আগে বাতিল হওয়া চুক্তিতে অন্তত চারটি চীনা কোম্পানি লেটার অব ইনটেন্ট পেয়েছিল।
বিগত সরকার 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন,২০১০' এর আওতায় যে ৩১টি চুক্তি করেছিল, সেখানে চীন, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের অনেক বিদেশি যৌথ বিনিয়োগকারী কোম্পানি অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে চাওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা বিদেশিদের কাছ থেকে সাড়া পায়নি। বরং পিডিবির দরপত্রকে বিদেশি কোম্পানিগুলো একেবারেই এড়িয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)-এর প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম টিবিএস'কে বলেন, "এই বিডে (দরপত্রে) কোনো সভরেন (সরকারি) গ্যারান্টি ছিল না, যা আগের চুক্তিতে ছিল এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। হঠাৎ করে পুরো চুক্তির বাতিল ঘোষণা, বিদেশিদের মাঝে আস্থা সংকট তৈরি করেছে, যার প্রতিফলন আমরা পিডিবির সাম্প্রতিকতম বিডে দেখছি।"
তিনি আরও বলেন, জমির সংকট, আর্থিক মডেলের দুর্বলতা এবং প্রকল্পের ব্যাংকের অর্থায়ন লাভের সুযোগ না থাকায় সম্ভাব্য দরদাতারা পিছু হটেছে।
১২টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রথম প্যাকেজের দরপত্র জমার পরিস্থিতি
২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে পিডিবি চারটি আন্তর্জাতিক দরপত্র প্যাকেজ আহ্বান করে, যার আওতায় বাংলাদেশের ৫৫টি স্থানে মোট ৫,২৩৮ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রথম প্যাকেজে, পিডিবি ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বরে, ৩৫৩ মেগাওয়াট মোট সক্ষমতার ১২টি গ্রিড-সংযুক্ত সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। পিডিবির তথ্য বলছে, এরমধ্যে ৯৫টি দরপত্র ফর্ম বিক্রি হলেও—জমা পড়ে মাত্র ২০টি।
এই ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ১৮৮ মেগাওয়াট মোট সক্ষমতার মাত্র ৬টি কেন্দ্রের জন্য মাত্র একটি করে দরদাতা ছিল। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের ওপর আস্থা সংকটের কারণেই এমনটা হয়।
এই ৬ দরদাতার মধ্যেও আবার, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামে একটি দেশীয় অবকাঠামো কোম্পানি ৩০ মেগাওয়াট এবং ৪৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি প্রকল্পের একক দরদাতা।
পিডিবির তথ্য বলছে, টেক্সটাইল এবং সিরামিক শিল্প সংশ্লিষ্ট কিছু কোম্পানিও এই দরপত্রে অংশ নিয়েছে। ১০ মেগাওয়াটের প্রকল্পে সর্বোচ্চ চারটি দরপত্র জমা পড়ে এবং ২৫ মেগাওয়াটের প্রকল্পে জমা পড়ে তিনটি দরপত্র।
মৌলভীবাজারে প্রস্তাবিত ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্পে তিনটি দরপত্র জমা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, "আমরা দরপত্র কম জমা পড়ার আসল কারণ পর্যলোচনা করছি, এবং আগামী রাউন্ডে আরও বেশি দরদাতা আকৃষ্ট করতে একটি সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।"
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রচেষ্টায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর অনাগ্রহ কেন
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের পেছনে রয়েছে জমির সংকট, নীতিগত অস্থিরতা এবং আর্থিক প্রণোদনার ঘাটতি। বিশেষ করে প্রকল্পে সার্বভৌম গ্যারান্টি না থাকা ও ব্যাংক অর্থায়নের কোনো সুসংগঠিত কাঠামো না থাকায় বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০'-এর আওতায় স্বাক্ষরিত ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করে সরকার। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের হতাশা তৈরি হয়, কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জমি কেনা ও অফিস স্থাপনায় অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।
এ বিষয়ে গ্রিন সোলার এনার্জির সাবেক উপদেষ্টা ও এক্সইনডেক্স এনার্জি লিমিটেডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাকির আহমেদ বলেন, "চূড়ান্ত চুক্তি একতরফাভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত আমাদের বিনিয়োগ নীতির বিষয়ে খুবই ভুল বার্তা দিয়েছে। এর মূল কারণ নীতিনির্ধারকদের প্রতি আস্থার অভাব।"
বাতিল হওয়া এসব সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নকশা, স্থাপন, সরবরাহ, পরীক্ষা ও কমিশনিংসহ নানা পর্যায়ের কাজ সম্পাদনের চুক্তি ছিল। জমি অধিগ্রহণ এবং অর্থায়নের দায়িত্বও ছিল সংশ্লিষ্ট ডেভেলপারদের ওপর।