মোল্লা খিচুড়ির টানে পদ্মার পাড়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বিক্রমপুর' বাস শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে যায় মাওয়া ঘাটে। সেই বাসে চড়ে ঘুরতে যাওয়া অনেকেই পদ্মাসেতু পার হয়ে ওপারে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারেন না। শুধু পদ্মার সৌন্দর্য নয়, এর টানে কাজ করে আরেকটি কারণ—একটি বিশেষ খাবার। যে খাবারের জন্য ঢাকার শেষ প্রান্ত থেকেও পদ্মাপাড়ে ছুটে যান ভোজনরসিকরা।
সে খাবার হলো 'মোল্লার খিচুড়ি'। শরীয়তপুরের নাওডোবায় মোল্লা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায় এটি। গরুর মাংসের ভুনা খিচুড়ি, সঙ্গে সামান্য সালাদ—আয়োজন এতটুকুই। অথচ এই একটি খাবারই নাওডোবাকে বানিয়েছে হাজারো ভোজনরসিকের গন্তব্য। অনেকের মতে, মাওয়ার ইলিশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র এই পদই—'মোল্লার খিচুড়ি'।
খিচুড়ির গল্প
৩০ বছর আগের কথা। পদ্মার ওপর সেতু তখনও স্বপ্নের মতো। জমজমাট কাঠালবাড়ি ঘাট দিয়ে প্রতিদিনই যেত-আসত শত শত লঞ্চ, ফেরি আর স্পিডবোট। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব জেলার যাত্রী জমত সেখানে। এমন সময়ে মোহাম্মদ আলমগীর খাঁ ভাবলেন, একটি ভাতের হোটেল দেবেন ঘাটে। সেখানে থাকবে পদ্মার ইলিশও।
দেশজুড়ে আসা যাত্রীদের খাইয়ে দ্রুতই নাম কুড়ালেন তিনি। কিন্তু একটি সমস্যা ছিল—রাত বাড়লে ভাতের চাহিদা কমে যেত। তাই রান্না হতো ডিম-খিচুড়ি। তবে প্রায় এক দশক আগে আলমগীর খাঁ নিলেন এক সিদ্ধান্ত, যা তার হোটেলের ধরণই পাল্টে দিল। তিনি শুরু করলেন গরুর মাংস সহযোগে ভুনা খিচুড়ি বিক্রি।
অল্পদিনেই সেই খিচুড়ির নাম ছড়িয়ে পড়ল কাঠালবাড়ি ঘাট থেকে মাওয়া পর্যন্ত, সেখান থেকে রাজধানীতেও। তখন যারা ঘাটে নামতেন, সবাইকে একটাই পরামর্শ দেওয়া হতো—'একটু সামনে এগিয়ে মোল্লার খিচুড়ি খেয়ে নিন।' ধীরে ধীরে ভাত-ইলিশের হোটেল হয়ে উঠল খিচুড়ির রেস্টুরেন্ট।
ধার্মিক হওয়ায় আলমগীর খাঁকে সবাই ডাকতেন 'মোল্লা'। সেই থেকেই তার দোকানের নাম হলো 'মোল্লার হোটেল'। খিচুড়ির খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের নামও ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
আলমগীর খাঁর মৃত্যুর পর এখন হোটেলের দায়িত্ব সামলান ছেলে শাহজাহান খাঁ। তাদের হোটেলে এখন শুধু এই একটিই খাবার বিক্রি হয়। শাহজাহান জানালেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খ্যাতির কারণে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষ। বিকেল চারটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাই মোল্লার হোটেলে ভোজনরসিকের ভিড় লেগেই থাকে।
যতক্ষণ যাত্রী, ততক্ষণ খাবার
শাহজাহান জানালেন, ২০২২ সালের শুরুতে পদ্মাসেতুতে যান চলাচল শুরু হলে ঘাটগুলোর কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। তখন অন্য ব্যবসায়ীদের মতোই মোল্লা হোটেলকেও ঘাট ছেড়ে দিতে হয়। বর্তমানে হোটেলটির অবস্থান পদ্মাসেতুর গোড়ায়, নাওডোবা বাস-স্টেশনের অদূরে।
রান্না শুরু হয় দুপুরে। বিকেল চারটার দিকে কর্মচারীরা কাজে যোগ দেন। তখন থেকেই শুরু হয় ভোজনপর্ব। হোটেলের পেছনেই রান্নার আয়োজন। একটি ডেগ শেষ হওয়ার আগেই চড়ানো হয় আরেকটি ডেগ। এভাবেই চলে রাত গভীর পর্যন্ত।
স্বাভাবিক দিনে দোকানে রান্না হয় ১০–১২ ডেগ খিচুড়ি। প্রতিদিন ব্যবহার হয় ১০০ থেকে ১২০ কেজি গরুর মাংস। শাহজাহান বললেন, তাদের জনপ্রিয়তার মূল রহস্য খাঁটি উপকরণ ব্যবহার।
"আমাদের তেল, মশলা, চাল–ডাল সব উন্নতমানের। গরুর মাংসও কেনা হয় যাচাই-বাছাই করে, ভেজালমুক্তভাবে। রান্নার পরিবেশও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কাস্টমার এসে দেখতে পারে। শুধু এটুকু বলব, এখানে এসে কেউ হতাশ হয় না," বললেন শাহজাহান।
দোকানে কাজ করেন ১৫–১৬ জন কর্মচারী। তাদের একজন মোহাম্মদ রবিউল। তিনি জানালেন, প্রতিটি ডেগের খিচুড়ি খেতে পারেন প্রায় ১৩০ জন। "ঘাটে থাকলে আরও বেশি লোকে খাইতো। এখন একটু দূরে হলেও বিক্রি তেমন কমেনি। অনেক সময় রাতের বেলা বাস থামিয়েও লোকজন খিচুড়ি খেয়ে যায়।"
মান ভালো, দাম নাগালে
ভাঙ্গার মোহাম্মাদ হাকিম মাতুব্বর (৭০) এসেছেন নাতি-নাতনিদের আবদার মেটাতে—তাদের দাবি, মোল্লার খিচুড়ি খাওয়াতে হবে! দোকানের কর্মচারী আইয়ুব আলী বললেন, এখানে এসে খেয়ে পার্সেল না নেওয়ার ঘটনা খুব কমই ঘটে। প্রায় অর্ধেক খিচুড়িই বিক্রি হয় পার্সেল হিসেবে, কারণ পরিবারের সদস্যদের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে চান না কেউ।
এক প্লেট মাংস-খিচুড়ির দাম ১৪০ টাকা। সঙ্গে থাকে সালাদ আর মৌসুমি আচার—আম, জলপাই বা চালতা। এ বৈচিত্র্যও খিচুড়িকে করেছে আরও জনপ্রিয়। হাফ প্লেটের দাম ৭০ টাকা। আচার নিতে পারবেন ইচ্ছেমতো।
পার্সেলের দামও একই। তবে একটি স্পেশাল পার্সেল পাওয়া যায় ২১০ টাকায়। এক প্লেট ভুনা মাংসের দাম ২০০ টাকা। গরুর পায়াও পাওয়া যায়, তবে তার দাম আকারভেদে ভিন্ন, জানতে হয় সরাসরি।
অতিথিরা বলছেন, খিচুড়ির ভিন্ন স্বাদ, পর্যাপ্ত মাংস আর খাবারের মানই তাদের বারবার টেনে আনে এখানে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিদারুল ইসলাম বললেন, "আপনি একবার খাওয়ার পর আবার সুযোগ পেলে ফের আসবেন। এই স্বাদ ভুলে থাকা যায় না। ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে যাদের খিচুড়ি হয়তো এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে।"
একই অভিজ্ঞতা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মায়শা আমিনের। পরিবারের সঙ্গে এসেছেন তিনি। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। ঢাকায় যাওয়া-আসার পথে বহুবার খেয়েছেন মোল্লার খিচুড়ি। তার ভাষায়, "বাসায় অনেকবার ট্রাই করেছি, এমন স্বাদ হয় না। গরুর মাংসের খিচুড়ি খেতে হলে এখানেই আসা উচিত। মশলার ব্যবহার বেশি, কিন্তু স্বাদ অসাধারণ।"
সঙ্গে ফ্রি পদ্মা-দর্শন
ফেসবুক-ইউটিউবের কল্যাণে মোল্লার খিচুড়ির নাম এখন সবারই জানা। তবে অনেকেই জানেন না, এর সঙ্গে বাড়তি পাওয়া যায় পদ্মানদীর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
পদ্মাসেতু নিজেই এক দর্শনীয় স্থাপনা। দিনের আলোয় আকাশের নীলের নিচে জলে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল কাঠামো মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। সন্ধ্যা নামলেই ঝলমলে আলোর আভায় সেতুর চারপাশ যেন আলোকিত উৎসবমুখর। শুধু সেতুই নয়, পদ্মার বিস্তীর্ণ জলরাশি আর হাওয়ায় ভেসে চলা নৌকা-ট্রলারও মুগ্ধ করে সবাইকে।
হোটেল থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব অল্প। হেঁটে কিংবা ভ্যানে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। পরিবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার আদর্শ জায়গা নাওডোবা। আর যারা চান একটু বাড়তি রোমাঞ্চ, তাদের জন্য আছে নৌভ্রমণের সুযোগ। ছোট নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে ঘুরে দেখা যায় পদ্মার বুকজুড়ে বিস্তৃত সৌন্দর্য।
ছবি: জুনায়েত রাসেল/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড