বই সংগ্রহের নেশা: ঠিক কতগুলো বইকে অসংখ্য কিংবা অনেক বেশি বলা যেতে পারে?

কথায় আছে, একজনের কাছে যা শখের সংগ্রহ, অন্যের চোখে তা আগুনের ঝুঁকি নিয়ে জমানো জঞ্জাল। ফিলাডেলফিয়ার এক বিলাসবহুল বাড়িতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা পড়ার পর আমার মনেও এই প্রশ্নটা উঁকি দিয়েছে। বাড়িটির মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঠাসাঠাসি করে রাখা ছিল প্রায় এক লক্ষ বই! ভাবছিলাম, শখ এবং বাড়াবাড়ি এই দুইয়ের মাঝের সীমারেখাটা ঠিক কোথায়?
ফিলাডেলফিয়া ইনকোয়ারার-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, একটা মজার গল্প। প্রয়াত আইনজীবী বিল রবার্টসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিল আনুমানিক এক লক্ষেরও বেশি। তার রিটেনহাউস স্কয়ারের টাউনহাউসের প্রতিটি ঘর বইয়ে ঠাসা ছিল। কবিতা থেকে শুরু করে জীবাশ্ম-উদ্ভিদবিদ্যা পর্যন্ত—কী নেই সেই সংগ্রহে!
বইয়ের দোকানে কাজ করার সুবাদে এবং জীবনে বহুবার বই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানোর ফলে আমি হাড়ে হাড়ে জানি এক লক্ষ বই মানে ঠিক কতটা বই; তবে পাড়ার মোড়ের ছোট্ট বইয়ের দোকান, বা বিশাল কোনো চেইন স্টোর, কিংবা শহরের লাইব্রেরির তুলনায় এই সংখ্যাটা কেমন? আর বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরির সঙ্গে তুলনা করলে কী দাঁড়ায়?
এইসব জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি তাই করলাম, যা আমার মতো একজন বইপোকা ব্লগার করে থাকে—শরণাপন্ন হলাম ইন্টারনেটের। আর সেখানেই খুঁজে পেলাম ২০১৬ সালের দুর্দান্ত একটা টাম্বলার পোস্ট। ব্রুকলিনের গ্রিনলাইট বুকস্টোরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেবেকা ফিটিং সেখানে উত্তর দিয়েছেন, "একটা বইয়ের দোকান খুলতে ঠিক কতগুলো বই লাগে?" তাদের দ্বিতীয় একটি দোকান খোলার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান:
আলাদা শিরোনামের বই: ৭,২৪৮টি
মোট বইয়ের সংখ্যা: ১১,৩০৫টি
তুলনার জন্য বলি, তাদের পুরনো দোকানটিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ আলাদা শিরোনামের বই থাকে। একটা এলাকার বইয়ের দোকান বলতে আমাদের মনে যে আদর্শ ছবিটা ভেসে ওঠে, দোকানটা ঠিক সেরকমই। এটি যথেষ্ট বড়, তাই নতুন প্রকাশিত বই সহজেই পাওয়া যায়, আবার এমন বিশালও নয় যে এর মধ্যে থেকে যত্ন করে সাজানো গোছানো একটা আমেজ হারিয়ে যায়।

বার্নস অ্যান্ড নোবেলের মতো বড় চেইন স্টোরের অবস্থা কেমন? উত্তরটা তাদের ওয়েবসাইটে খুব সহজেই পাওয়া গেল: "আমাদের প্রতিটি দোকানে ১,০০,০০০-এর বেশি শিরোনামের বই থাকে এবং আমাদের মূল গুদামে ১০ লক্ষেরও বেশি শিরোনামের বই মজুত থাকে।"
এই তথ্যটা জানার পর, নিজের বাড়িতে এক লক্ষ বই জমানো সেই ভদ্রলোকের ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখতে বাধ্য হলাম। এবং তাকে সংগ্রাহকের চেয়ে 'জিনিস জমানো বাতিকগ্রস্ত' বলেই বেশি মনে হতে লাগল।
কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানগুলোর খবর কী? পোর্টল্যান্ডের পাওয়েল'স বুকস্টোর বছরের পর বছর ধরে নিজেদের "বিশ্বের বৃহত্তম নতুন ও ব্যবহৃত বইয়ের দোকান" বলে দাবি করে আসছে, যেখানে দশ লক্ষেরও বেশি বই রয়েছে। সংখ্যাটা অবশ্যই বিশাল। তবে কিছুদিন আগেই চীনে ৭,০০,০০০ বর্গফুটের একটি নতুন বইয়ের দোকান খুলেছে, যা আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম। যদিও শেনজেনের এই দোকানে বর্তমানে বই আছে মাত্র ৩,০০,০০০। তাই আপাতত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বইয়ের দোকানের অনানুষ্ঠানিক শিরোপাটা পাওয়েল'স-এর কাছেই থাকছে।
আর লাইব্রেরি? এর উত্তরটা আরও সহজ। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকার একটি সাধারণ লাইব্রেরিতে গড়ে ১,১৬,৪৮২টি বই থাকে (ই-বুক ও অডিওবুক সহ)। আর লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস-এ রয়েছে ৪ কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি বই, যা সত্যিই অনেক! আর এটাই এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম লাইব্রেরি বানিয়েছে।
এবার তাহলে মূল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। উপরের সব তথ্য বিবেচনা করে আমি বলতে পারি: একজন সাধারণ মানুষের জন্য এক লক্ষ বই নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আর যদি কেউ নিজেকে 'অনেক বইয়ের মালিক' হিসেবে দাবি করতে চান, তার জন্য একটা সীমারেখা হতে পারে ১,০০০ বই। এই সংখ্যা দিয়ে হয়তো বইয়ের দোকান খোলা যাবে না, কিন্তু বাড়ির দুটো ঘর সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা যাবে।
আর সত্যি বলতে কি, এত বইয়ের আসলে কোনো দরকারই নেই। তার চেয়ে বরং সোজা লাইব্রেরিতে চলে যাওয়াই ভালো।