পেপারব্যাক বিপ্লব ও প্রচ্ছদশিল্পে কাজী আনোয়ার হোসেন: রঙে আঁকা এক যুগ
মাসুদ রানার 'স্বর্ণমৃগ' বইটির প্রচ্ছদ দেখে আমি প্রথম থমকে গিয়েছিলাম। বইটি হাতে নিয়েই যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়েছিলাম। প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন হাশেম খান। মোটা কাগজে তৈরি মলাটের সামনের অংশটি তিনি খানিকটা কেটে দিয়েছেন, নিচে ফুটে উঠেছে এক নারীর মুখ। চোখেমুখে রহস্য, ঠিক যেন কোনো গুপ্ত দরজার আড়ালে লুকানো গল্প। সেই সামান্য কাটাই যেন বইটির প্রাণ খুলে দিয়েছে।
এমন অভিনব প্রচ্ছদ আমি আগে কখনো দেখিনি। বাংলা বইয়ের ইতিহাসে এটি ছিল এক নতুন বিস্ময়। কেটে গেছে বহু বছর। অসংখ্য প্রচ্ছদ দেখেছি, অনেক বইয়ের গন্ধে সময় কাটিয়েছি, তবু সেই প্রথম বিস্ময় আজও অমলিন। কিশোর বয়সের আমি তখন 'স্বর্ণমৃগ' হাতে বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে ছিলাম-সেই মুহূর্তটি এখনো মনে পড়ে, যেন আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি সেই দোকানের সামনে, ভেতরে আলোয় ঝলমল করছে প্রচ্ছদের সেই কাটা অংশটি। শেখ আবদুল হাকিমের 'অপরিণিত পাপ' বইয়ের প্রচ্ছদেও পরে দেখেছিলাম ঠিক তেমন চমকের ঝলকানি-রং, রহস্য, আর আকর্ষণের এক জাদু।
সেই সময়ে জানতাম, এই বইটি প্রকাশ করেছিল সেগুন বাগান প্রকাশনী। পরে সেই নামই রূপ নিল নতুন পরিচয়ে-প্রজাপতি লোগোতে লেখা সংক্ষিপ্ত নাম সেবা প্রকাশনী; যেন রেশমের গুটির ভেতর থেকে জন্ম নিল এক রঙিন প্রজাপতি, যা উড়ে গেল পাঠকের হৃদয়ে। সেই প্রজাপতির ডানা আজও উড়ছে, নতুন নতুন পাঠকের বুকের ভেতর গল্পের হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে।
শুধু গল্প নয়, প্রচ্ছদ দিয়েও পাঠককে মোহমুগ্ধ করার চল শুরু করেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সস্তা নিউজপ্রিন্টে অল্প দামে ছাপা বই হোক বা দামি কাগজের সংস্করণ-বাংলা বই এমন তাক লাগানো প্রচ্ছদ আগে কখনো দেখেনি। গল্পটা সত্যিই চমকপ্রদ। বাংলাদেশের বই প্রকাশনার ইতিহাসে যেন এক সিনেমার দৃশ্যের মতো ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন আর তাঁর সেবা প্রকাশনী।
ষাটের দশকের ঢাকায় তখন বই মানে ছিল মোটা মলাট, দামি কাগজ, আর একরকম গম্ভীর সাহিত্য। পাঠক ছিল সীমিত, বই ছিল শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য। কিন্তু তরুণ লেখক ও প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন ভেবেছিলেন উল্টোভাবে। তিনি চাইলেন এমন বই, যা পড়বে সাধারণ মানুষ, স্কুলছাত্র, কলেজপড়ুয়া-রাত জেগে শেষ করবে। বই হবে সস্তা, পাতলা, হাতে ধরা সহজ, আর দেখতেও হবে আকর্ষণীয়।
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিল সেগুন বাগান প্রকাশনী; যেন রেশমের গুটি। পরে প্রজাপতি লোগোতে রূপ নিয়ে হয়ে গেল সেবা প্রকাশনী। পেপারব্যাক ফরম্যাটে, অল্প দামে, দারুণ ছাপা ও মুগ্ধকর প্রচ্ছদসহ বই প্রকাশ শুরু হলো। কিন্তু আসল বিপ্লবটা ঘটেছিল প্রচ্ছদে। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে তখন প্রচ্ছদ ছিল অবহেলিত-একরঙা পটভূমি, মাঝখানে শিরোনাম, আর কিছু না।
সেবার বইগুলো হঠাৎই যেন সিনেমার পোস্টারের মতো তাক ভরে ফেলল। উজ্জ্বল রং, দৃষ্টিকাড়া মুখ, বন্দুকের ঝলক, রহস্যের আভাস, বিদেশি শহরের ছায়া, অন্ধকার গলির আতঙ্ক-সব মিলিয়ে এক চুম্বকীয় আকর্ষণ।
'মাসুদ রানা', 'কুয়াশা', 'তিন গোয়েন্দা'-প্রতিটি সিরিজের প্রচ্ছদ হয়ে উঠেছিল আলাদা ব্র্যান্ড। সেই প্রচ্ছদের পেছনে ছিলেন একদল তরুণ শিল্পী, হাশেম খান, ধ্রুব এষ, রুমী রহমান, রওশনুল হক, ইলিয়াস কচি, কামরুল হাসান, রকিব হাসানসহ আরও অনেকে। তাঁরা তুলির আঁচড়ে এমন দৃশ্য তৈরি করতেন, যা বইয়ের দোকানের ভিড়ে চোখে পড়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে।
কাজী আনোয়ার হোসেন প্রথম বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পেপারব্যাক বই প্রকাশ শুরু করেন। এর ফলে অল্প দামে বই সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যায়, পাঠাভ্যাস ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। তিনি প্রমাণ করেন, বই কেবল সাহিত্য বা সংস্কৃতির অংশ নয়, এটি একটি বাণিজ্যিক পণ্যও হতে পারে। বই প্রকাশনা ব্যবসাকে তিনি এক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
সেবা প্রকাশনীর বইয়ে প্রচ্ছদের এই বিপ্লব ছিল দ্বিমুখী। একদিকে দৃশ্যগত সৌন্দর্য, অন্যদিকে বাণিজ্যিক বুদ্ধিমত্তা। বই বিক্রির ক্ষেত্রে প্রচ্ছদকে প্রথমবারের মতো কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দোকানে সাজানো বইয়ের ভিড়ে সেবার প্রচ্ছদ পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নিত এক ঝলকেই।
'তিনটি উপন্যাসিকা (১৯৭৭)' বইয়ের ভূমিকায় কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই লিখেছিলেন, বাংলায় ভালো কাগজে ছেপে ভালো বাঁধাই করে প্রকাশ করলে হয়তো শোভন হতো, কিন্তু বইয়ের যা মূল্য দাঁড়াত, তাতে গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্যের চাপে ভারাক্রান্ত বাঙালি পাঠককে আনন্দের পরিবর্তে দুঃখই দেওয়া হতো বলে মনে করি। এই একটি বাক্যে তাঁর দর্শন স্পষ্ট। বই হবে পাঠকের নাগালে, গল্পের আনন্দ হবে সবার জন্য।
মাসুদ রানার লোগোসহ অলংকরণের বৃহৎ অংশে ভূমিকা রেখেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান। এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, তিনি সোজাসাপটা মানুষ, কোনো ভানভণিতা নেই। কাছাকাছি 'ললনা' নামে একটি পত্রিকায় পার্টটাইম কাজ করতেন।
১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি একদিন তিনি নিজেই এসে বলেন, সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে কাজ করতে চান। কাজী আনোয়ার বলেন, যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। শুরু হলো সেবা প্রচ্ছদের স্বর্ণযুগ। পরে রহস্য পত্রিকার প্রথম শিল্প সম্পাদকও ছিলেন তিনিই। সেবা প্রকাশনী, মাসুদ রানা, রহস্যপত্রিকা-সবকিছুর প্রথম লোগো তাঁরই হাতে তৈরি।
মাসুদ রানার কোলাজ প্রচ্ছদের গল্পটাও অনন্য। এর সূচনা হয়েছিল শাহাদত চৌধুরীর হাত ধরে। এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, হ্যাঁ, তিনিই সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক সেই শাহাদত চৌধুরী। স্বাধীনতার পর হাশেম খান যখন চিত্তরঞ্জন বাবুর প্রকাশনী মুক্তধারায় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন তাঁর পরামর্শেই ধরেন শাহাদতকে।
শাহাদত আর্ট কলেজ থেকে পাস করলেও ছবি আঁকার দিকে তেমন ঝোঁক ছিল না, তাঁর সমস্ত মনোযোগ ছিল সাময়িক পত্রিকার সাজসজ্জায়। প্রথমে রাজি হননি, বলেছিলেন সময় নেই। কিন্তু একদিন দেখা গেল বিচিত্রার জন্য দুর্দান্ত এক কোলাজ প্রচ্ছদ করেছেন।
কাজী আনোয়ার তাঁকে বলেন, ছবি আঁকতে হবে না, কোলাজ করলেই হবে। শাহাদত নিমরাজি হন। সেই শুরু সেবা থেকে কোলাজ প্রচ্ছদ। আজও সে ধারাই চলছে। পরে আসাদুজ্জামান, ধ্রুব এষ, আলীম আজিজ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র-শিল্পীর হাতে এই ধারা আরও বিকশিত হয়। বাংলাদেশে প্রচ্ছদে কোলাজের প্রবর্তন সম্ভবত সেবাই প্রথম করে।
সেবার প্রচ্ছদ ছিল সাহসী ও আধুনিক-তাতে ছিল রোমাঞ্চ, রহস্য, সৌন্দর্য এবং খানিকটা বিদেশি ঝাঁজ। এই কোলাজনির্ভর প্রচ্ছদই পরে বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রকাশনার পরিচিতি হয়ে ওঠে। মাসুদ রানার প্রচ্ছদ একদিকে যেমন তরুণ পাঠকের কল্পনাকে নাড়া দিয়েছিল, তেমনি তা হয়ে উঠেছিল একধরনের স্টাইল স্টেটমেন্ট।
সেবার বইয়ের মলাটে লেখা থাকত, বিদেশি ছবি অবলম্বনে। এই বাক্য প্রমাণ করত, আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদশিল্পের প্রভাব ইতিমধ্যে এসে গেছে বাংলাদেশে। সেই সময়ের প্রচ্ছদগুলো রহস্য ও থ্রিলার সাহিত্যের মেজাজকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলত। পাঠক বই হাতে নেওয়ার আগেই জানত, এ বইয়ে রোমাঞ্চ আছে।
প্রচ্ছদশিল্পের এই বিপ্লবের পেছনে ছিল এক নতুন সামাজিক ভাবনা। সেবা প্রকাশনীর বইয়ের প্রচ্ছদগুলো উচ্চবিত্ত রুচির গন্ডি ভেঙে জনপ্রিয় সংস্কৃতি তৈরি করে। সাহিত্যকে নিয়ে যায় সাধারণ মানুষের ঘরে। সস্তা হলেও বইগুলো আকর্ষণীয়, পাঠযোগ্য এবং সংগ্রহযোগ্য হয়ে ওঠে।
একসময় চায়ের দোকানে, বাসে বা পার্কে মানুষ বই নিয়ে আলোচনা করত-কাহিনি নয়, প্রচ্ছদ নিয়েও। কোন বইয়ের প্রচ্ছদে কে আছে, বন্দুকের ঝলক কেমন, মেয়েটির মুখ কার মতো-এসব নিয়েই কিশোর পাঠকের আগ্রহ বেড়ে যেত। বোঝা গেল, মলাটও গল্প বলে।
বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পের ইতিহাসও এই সময় থেকে এক নতুন অধ্যায় পায়। বিশ শতকের প্রথম ভাগে প্রচ্ছদ মানে ছিল কেবল অক্ষরবিন্যাস-রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের প্রথম দিকের বইগুলোও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিশের দশকে হাতে আঁকা প্রচ্ছদ দেখা গেলেও তা আকর্ষণীয় ছিল না। ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে দেশীয় প্রচ্ছদশিল্পের নিজস্ব জগৎ গড়ে উঠতে শুরু করে।
পঞ্চাশের দশকে কাজী আবুল কাশেম, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীরের মতো শিল্পীরা প্রচ্ছদে শৈল্পিকতার ছাপ রাখেন। ষাটের দশক থেকে কাইয়ুম চৌধুরী হয়ে ওঠেন প্রচ্ছদশিল্পের অনন্য নাম। টাইপোগ্রাফি ও বিষয়বস্তুর মেলবন্ধনে তিনি এনে দেন জাদু।
এরপরেই আসে কাজী আনোয়ার হোসেনের যুগ। তাঁর হাত ধরে প্রচ্ছদ শুধু শিল্প নয়, হয়ে ওঠে বাজারের চালিকাশক্তি। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বই প্রকাশনাকে একদম নতুন পথে নিয়ে যায়। সেবার প্রচ্ছদে উজ্জ্বল রং, গতি ও রোমাঞ্চের চিত্রায়ণ বই বিক্রিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে।
প্রযুক্তির উন্নতিতে আজ প্রচ্ছদশিল্পে এসেছে নতুন আঙ্গিক। কম্পিউটার গ্রাফিকস, ডিজিটাল পেইন্টিং, আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি, এআই-সব মিলিয়ে এখনকার প্রচ্ছদ অনেক নিখুঁত ও বৈচিত্র্যময়। তবু আজও কাজী আনোয়ার হোসেনের সময়ের সেই রঙিন, প্রাণবন্ত প্রচ্ছদগুলোর মতো আলোড়ন জাগাতে পারেনি কোনো ধারা।
তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন, বই কেবল শব্দের নয়, চিত্রেরও গল্প। তাঁর বই পাঠককে গল্পের ভেতরে ঢোকার আগেই মুগ্ধ করত প্রচ্ছদের রঙে। সেবা প্রকাশনীর সেই বইগুলো ছিল যেন সিনেমার ট্রেলারের মতো। একটা দৃশ্য, একটা মুখ, একটা ঝলক, যা পাঠককে গল্পে টেনে নিয়ে যেত।
বাংলাদেশে বইয়ের ইতিহাসে কাজী আনোয়ার হোসেন তাই কেবল একজন লেখক বা প্রকাশক নন, এক নীরব বিপ্লবী। তিনি বইকে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। পাঠকে বাণিজ্যিকভাবে টিকিয়ে রেখেছেন। আর প্রচ্ছদকে দিয়েছেন নতুন জীবন।
আজও পুরোনো বইয়ের বাজারে মাসুদ রানার প্রথম দিককার প্রচ্ছদ হাতে নিলে বোঝা যায়, কীভাবে একটি মুখ, একটি বন্দুকের ঝলক কিংবা অন্ধকার গলির ছায়া বদলে দিয়েছিল এক দেশের পাঠাভ্যাস।
সূর্যের আলোর যে জানালা একদিন খুলে দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন, সেই জানালা দিয়েই এখনো আলো পড়ে-বাংলাদেশের বই, প্রচ্ছদ আর পাঠকের মুগ্ধতায়।
