আদর্শ পৃথিবীর খোঁজে: অর্থনীতির চোখে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প
উনিশ শতকের ইউরোপ। এমন এক পৃথিবী, যেখানে আকাশ যেন প্রতিদিন আরও কালো হয়ে আসছিল। বিশাল কারখানার চিমনি থেকে উড়ে আসা ধোঁয়া কেবল শহরের বাতাসই নয়, মানুষের স্বপ্নকেও ঢেকে দিত ঘন ছায়ায়। রাস্তায় রাস্তায় ছুটে চলা শ্রমিকেরা ক্লান্ত দেহ নিয়ে ফিরে যেত নিরানন্দ বাসায়, আর নবজন্ম নেওয়া শিল্পসভ্যতার লৌহজাঁতা মানুষকে যন্ত্রের মতো কাজে নিযুক্ত করত সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। মনে হতো, সভ্যতার আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে, আর মানুষ হয়ে উঠছে নিজের জীবনের মধ্যেই বন্দী।
এমন সময়, এই অন্ধকারের গভীরে, যেন কোথাও একটি সূক্ষ্ম আলোর দাগ ফুটে উঠল। একটি আলো যা প্রথম দেখায় ক্ষীণ হলেও ভেতরে ছিল প্রশ্নের আগুন, কল্পনার দীপ্তি আর মানবিক স্বপ্নের অদম্য সাহস। সেই আলোই হলেন শার্ল ফুরিয়ে–নিঃসঙ্গ, নিরলস, কিন্তু আশ্চর্য উচ্ছ্বাসে ভরা এক ফরাসি কেরানি। দিনের বেলায় তিনি বসে থাকতেন হিসাবের কলামে ডুবে, সংখ্যার শুষ্কতায় হারিয়ে; কিন্তু রাত নামলেই তার ক্লান্ত শরীর যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। তখন তিনি হেঁটে বেড়াতেন কল্পনার এক বিশাল দেশে, যেখানে মানুষ যন্ত্রের দাস নয়, বরং নিজের আবেগ ও স্বপ্নের মালিক।
ফুরিয়ের জীবন ছিল উৎসবহীন, একঘেয়ে এবং প্রচণ্ড নিঃশব্দ। তবুও তার ভেতর জ্বলত এমন এক আগুন, যা কেউ নেভাতে পারেনি। সেই আগুনের তাপেই তিনি লিখলেন অদ্ভুত সব বই, যেমন 'দ্য থিওরি অব দ্য ফোর মুভমেন্টস অ্যান্ড জেনারেল ডেসটিনিস'–এর নাম শুনলেই মনে হয়, যেন কোনো দূর ভবিষ্যতের রহস্যপুঞ্জ খুলে ধরা হবে। তার প্রতিটি শব্দে ছিল মানবসভ্যতাকে নতুন করে ভাবার ডাক। একটা আহ্বান, যেন বলছে, অন্ধকারই শেষ নয়। আলো এখনো বিশ্বে জন্ম নিতে পারে।
ফুরিয়ে বিশ্বাস করতেন যে ইউরোপের গোটা সভ্যতাই নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বেদনাভরা কণ্ঠে বলতেন যে মানুষের শ্রমকে যে সমাজ কারখানার অমানবিক খাঁচায় বেঁধে দেয়, তাকে সভ্যতা বলা চলে না। তিনি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক গর্ব–অ্যাডাম স্মিথের পিন কারখানার উদাহরণ মনে করিয়ে দিতেন। অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন যে শ্রম ভাগ করে দিলে উৎপাদন বাড়ে, কারণ একজন সারা জীবন পিনের মাথা ঘষে। আরেকজন সারা জীবন তারের দেহ সোজা করে। এতে নাকি কাজ দ্রুত হয়।
কিন্তু ফুরিয়ে দেখলেন এর ভেতর লুকানো এক বিষণ্নতা। উৎপাদন বাড়ে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মন ভেঙে যায়। তার মন থেকে প্রাণশক্তি আর সৃজনশীলতা হারিয়ে যায়। জীবনের স্বাদ তখন একমুঠো মাটি হয়ে যায়।
এমনকি এই বাণিজ্যকেন্দ্রিক সমাজ মানুষকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে তোলে। কাচ বিক্রেতা চায় যেন শিলাবৃষ্টি হোক, যাতে সবার জানালা ভেঙে যায় আর সে বেশি কাচ বিক্রি করতে পারে। ব্যবসায়ী সমাজ তাই মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার বদলে শত্রুতা জন্মায়। আবার ধনী ও ক্ষমতাবানেরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে গরিবদের পিষে ফেলে। পৃথিবী তখন এমন এক মঞ্চ, যেখানে শক্তিশালী চরিত্ররা সব আলো কুড়িয়ে নেয়। অন্যদিকে দুর্বলরা অন্ধকারের গহ্বরে পড়ে থাকে।
ফুরিয়ে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজলেন। তিনি ভাবলেন নতুন সমাজ গড়তে হবে। একেবারেই নতুন করে। তাই তিনি প্রস্তাব দিলেন, ফ্যালানস্টেরি অদ্ভুত নামের এক ব্যবস্থার। এটি হবে ছোট ছোট সম্প্রদায়। যেখানে মানুষ বসবাস করবে। একটি লম্বাটে বড় ভবনের মধ্যে থাকবে কর্মশালা, গ্রন্থাগার, এমনকি অপেরা হাউসও। এই জায়গাগুলো হবে এমন, যেখানে মানুষ জোর করে নয়, নিজের ইচ্ছা আর আবেগের পথ ধরে কাজ করবে।
ফুরিয়ে বলতেন যে মানুষের ভেতরে নানা রকম আবেগ আছে। আছে বন্ধুত্ব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ভালো খাবার আর সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু তিনি আরও কিছু অদ্ভুত আবেগের কথা বললেন। যেমন বাটারফ্লাই আবেগ। এই আবেগের মানুষের এক কাজ থেকে আরেক কাজে উড়ে উড়ে যেতে ভালো লাগে। কিংবা ক্যাবালিস্ট আবেগ, যার মানে হচ্ছে মানুষের মধ্যে গুপ্তচক্র আর রহস্য রচনা করার একটা আনন্দ। এই সব আবেগ মিলিয়ে তিনি হিসাব করে বললেন যে পৃথিবীতে আছে মোট ৮১০ ধরনের মানব চরিত্র। আর তার ফ্যালানস্টেরিতে এই সব আবেগকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হবে।
প্রতিদিন মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বেরোবে কাজে। কেউ গোলাপগাছের দেখাশোনা করবে, কেউ মুরগির খামার সামলাবে, কেউ অপেরা তৈরি করবে। সবচেয়ে বড় কথা, একেকজন মানুষ বহু দলের সদস্য হতে পারবে। ফলে কখনোই তারা একঘেয়ে কাজের মধ্যে আটকে থাকবে না। কেউ আর সারা জীবন পিনের মাথা ঘষবে না। বরং যখন যেটাতে মন চাইবে, সেটাতেই ডুবে যাবে।
তাহলে মানুষ টাকা পাবে কীভাবে? ফুরিয়ে বললেন, কোনো বেতনের ব্যবস্থা নয়। সবাই মিলে যে লাভ করবে, সেই লাভের অংশীদার হবে প্রত্যেকে। এ যেন সহযোগিতা, নয় কোনো প্রতিযোগিতা।
কিন্তু এমন এক বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে অর্থ চাই। আর সেই অর্থের জন্য ফুরিয়ে প্রতিদিন দুপুরে অপেক্ষা করতেন। কেউ একজন যেন তার দরজায় এসে কড়া নাড়বেন। কিন্তু কোনো দিন কেউ এলেন না। তার স্বপ্ন কাগজেই রয়ে গেল।
আর স্বপ্ন সেই জায়গায় থামলেন না। তিনি বললেন, একদিন ফ্যালানস্টেরিগুলো প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষের লেজ গজাবে, যার ডগায় থাকবে চোখ। আকাশে থাকবে ছয়টা চাঁদ। আর সমুদ্রের পানি লেবুর শরবতের মতো মিষ্টি হয়ে যাবে। বন্য প্রাণীরা মানুষের বন্ধু হবে, আর অ্যান্টি টাইগার নামের বন্ধুভাবাপন্ন প্রাণী আমাদের তার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাবে দূরদূরান্তে। এমন কথা শুনে অনেকে তাকে পাগল বলেছিল। কিন্তু তার কথা একদিক থেকে সত্যিই নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। আমরা কি এমন কাজের খোঁজ করি, যেখানে আমাদের সমস্ত স্বভাব, দক্ষতা আর স্বপ্নগুলোর জায়গা হয়? আজকের যুগে ক্যারিয়ার পরামর্শদাতারা স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের আগ্রহ আর প্রতিভা অনুযায়ী পেশা বেছে নিতে সাহায্য করছেন–এ কি সেই প্রশ্নেরই উত্তর?
ফুরিয়ের মতো আরেকজন ছিলেন রবার্ট ওউয়ন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মানুষ। ওয়েলসের এই সন্তান ছিলেন বাস্তব জীবনে সফল এক শিল্পপতি। নতুন যুগের বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে কাজে লাগিয়ে তিনি তুলা সুতা কারখানায় বিপ্লব ঘটালেন। দোকানের কর্মচারী থেকে উঠে এলেন বিখ্যাত উদ্যোক্তা হিসেবে। তিনি একাধারে রাজা-রাজড়াদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শ্রমিকদের সাথে মিশেছেন। এই অভিজ্ঞতাই তাকে বিশ্বাস করায়, মানুষের চরিত্র গড়ে ওঠে তার পরিবেশ থেকে। খারাপ পরিবেশ খারাপ মানুষ তৈরি করে। আর ভালো পরিবেশ ভালো মানুষ।
তাই তিনি লিখলেন 'আ নিউ ভিউ অব সোসাইটি'। এখানে তিনি বললেন যে যেসব পরিবেশে প্রতিযোগিতা আর স্বার্থপরতা রাজত্ব করে, সেখানে ভালো মানুষ গড়ে ওঠা কঠিন। সেই কারণেই তিনি দৃঢ় সংকল্প করলেন–তিনি তৈরি করবেন এক মডেল আদর্শ গ্রাম। এমন এক গ্রাম, যা হবে শহরের নোংরা আর বিপজ্জনক কারখানার পুরোপুরি বিকল্প।
স্কটল্যান্ডের নিউ ল্যানার্কে তিনি কিনলেন একটি তুলা কারখানা এবং এই কারখানার চারপাশেই তিনি শুরু করলেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন শিশু বিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট ফর দ্য ফরমেশন অব ক্যারেক্টার। তখনকার ব্রিটেনে এটি যেন এক নতুন আলোর দিশা। তিনি শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমালেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে উৎসাহ দিলেন এবং মদ্যপান থেকে দূরে থাকতে বললেন। তার এই উদ্যোগে দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভিড় জমাতেন এই অনন্য পরীক্ষাটি দেখতে।
এবার তিনি চালু করলেন এক অদ্ভুত ব্যবস্থা–সাইলেন্ট মনিটর। প্রতিটি শ্রমিকের সামনে ঝুলত কাঠের একটি বাক্স। তার চার দিকে চার রং। সাদা মানে চমৎকার, হলুদ মানে ভালো, নীল মানে মাঝারি, আর কালো মানে খারাপ। প্রতিদিন সুপারভাইজার শ্রমিকের কাজ বিচার করে বাক্সকে ঘুরিয়ে দিতেন। কাউকে ধমক না দিয়ে শুধু রং বদলে দেখিয়ে দেওয়া হতো যে সে কেমন কাজ করছে। শুরুতে অধিকাংশ বাক্সই নীল আর কালো হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সাদা আর হলুদ বাড়তে লাগল। মানুষের চরিত্রও ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল।
এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় প্রতিষ্ঠা করলেন আরও বড় প্রকল্প। নাম দিলেন নিউ হারমনি। এটি ছিল কৃষি খামার, কর্মশালা, বিদ্যালয়। সব মিলিয়ে এক বিশাল স্বপ্ননগরী। যেখানে পুঁজিবাদকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে নতুন সমাজ গড়ার আশা ছিল। বিজ্ঞানী, শিক্ষক, শিল্পী–এমন সব মানুষ সেখানে ছুটে এলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে কয়েকজন দুষ্টু লোকও জমায়েত হলো। যারা কাজের চেয়ে গোলমাল পাকাতে বেশি পারদর্শী। লেখক আর চিন্তাবিদেরা মাথায় দুনিয়া বদলানোর ক্ষমতা রাখলেও মাটি খুঁড়তে আর কাঠ কাটার মতো কাজের বেলায় ছিলেন বেজায় দুর্বল। আর যারা দুর্বৃত্ত, তারা কাজ এড়িয়ে বেড়াল। ফলে ঝগড়া শুরু হলো কমিউনিটির ভেতর। আর শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি ব্যর্থ হলো।
বার্ধক্যে ওউয়ন ঝুঁকে পড়লেন স্পিরিচুয়ালিজমের দিকে। মৃতদের আত্মার সঙ্গে তথাকথিত কথা বলার প্রচলন তখন খুব জনপ্রিয় ছিল। তিনি ভাবতেন যে শেক্সপিয়ার কিংবা ডিউক অব ওয়েলিংটনের আত্মারা তাকে পরামর্শ দেবে। হয়তো তিনি ভাবতেন অতীতের মহাপুরুষদের আত্মার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। যদিও এ বিশ্বাস কতটা যুক্তিসংগত ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু এতে তার গভীর আকাঙ্ক্ষার সত্যিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি মরিয়া ছিলেন মানুষের দুঃখ ও অভাব থাকবে না, এমন এক সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা।
ফুরিয়ে আর ওউয়নের সেই অদ্ভুত অথচ মমতায় ভরা স্বপ্নগুলো দেখতে গেলে আজও মনে হয়, তারা যেন মানবসভ্যতার কানে কানে বলেছিলেন, জীবন শুধুই হিসাবের খাতা নয়, কারখানার চাকায় ঘুরে চলা কোনো বিবর্ণ দুঃখগীতি নয়। মানুষ এসেছে নিজের পূর্ণতাকে খুঁজতে, নিজের আবেগকে বিকশিত করতে, আর নিজের পরিবেশকে সুন্দর ও মানবিক করে তুলতে।
ফুরিয়ে কল্পনা করেছিলেন এমন এক সমাজ, যেখানে পিন ঘষার একঘেঁয়ে শ্রমের বদলে মানুষ নিজের ভেতরের সব রংকে ছড়িয়ে দিতে পারবে, আর ওউয়ন কীভাবে কারখানার কঠোরতায় আটকে থাকা বাস্তব জগতে দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন শিশু বিদ্যালয়, আদর্শ গ্রাম আর চরিত্র গড়ার বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করার। দুজনের দুটি পথ আলাদা হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক, মানুষ যেন কেবল বস্তুর উৎপাদনযন্ত্র হয়ে না বাঁচে। তারা চেয়েছিলেন এমন সমাজ, যেখানে মানুষের আত্মা যেমন সুরক্ষা পাবে, তেমনি প্রসারিতও হবে।
কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ফুরিয়ে, ওউয়ন ও সাঁ-সিমোঁ ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা–তারা নতুন পৃথিবীর কল্পনা করতে পারতেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পথ জানতেন না। মানুষের শুভবুদ্ধি বা সদিচ্ছার ওপর ভরসা রেখে ভালো সমাজ গড়া যাবে, এ ধারণা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। মার্ক্সসের মতে, শ্রমিক আর মালিকের দ্বন্দ্ব একসময় এতটাই তীব্র হবে যে পুঁজিবাদ নিজ শক্তিতেই ভেঙে পড়বে এক মহাবিপ্লবে। নতুন সমাজ জন্ম নেবে শান্তি ও সুরের মাঝ দিয়ে নয়, বরং প্রবল আলোড়ন ও উত্তাল অস্থিরতার মধ্য দিয়ে।
শেষ পর্যন্ত তাদের স্বপ্ন হয়তো পুরোটা বাস্তব হয়নি, কিন্তু তাদের প্রশ্ন আমাদের থামতে শেখায়। আমরা যে ভবিষ্যতের দিকে ছুটছি, তা কি সত্যিই মানবিক? মানুষ কি সেখানে নিজের সমস্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে পারবে? যদি সমাজ একদিন সত্যিই মানুষের আবেগ, দক্ষতা ও স্বপ্নের সমন্বয়ে গঠিত হয়, তাহলে হয়তো আমরা বুঝব, ফুরিয়ে আর ওউয়ন যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পাগলামি ছিল না, বরং মানুষের গভীরতর সত্যের সন্ধানের প্রথম আলো।
ফুরিয়ে আর ওউয়নের মতোই আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ফরাসি অভিজাত অঁরি দ্য সাঁ-সিমোঁ। ছোটবেলা থেকেই তার উচ্চাভিলাষ ছিল অসীম; এমনকি নিজেকে সক্রেটিসের পুনর্জন্মও ভাবতেন। প্রতিদিন সকালে তার ভৃত্য চিৎকার করে বলত, উঠুন, মসিয়ে ল্য কম্, আজ আপনাকে মহৎ কাজ করতে হবে। তার প্রথম রচনাই ছিল মানবজাতির উদ্দেশে। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে লড়েছেন, ফরাসি বিপ্লবের সময় এক বছর কারাগারে ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর গির্জার জমি কিনে ধনী হয়েছিলেন, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সব নষ্ট করে ফেলেন। পরে নিজের ভাবনার স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনায় আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন।
সাঁ-সিমোঁ বিশ্বাস করতেন, সমাজ পরিচালনা করবে প্রতিভাধর মানুষ। রাজপুত্র বা ডিউক নয়। জন্মগত পার্থক্য নয়, দক্ষতার পার্থক্যই হবে মানুষের ভিন্নতার একমাত্র কারণ। কেউ আর কাউকে শোষণ করবে না; বরং সবাই মিলে প্রকৃতিকে শোষণ করবে, বিজ্ঞান ও শিল্প ব্যবহার করে সমাজকে সমৃদ্ধ করবে। তার স্বপ্নে অর্থনীতি হয়ে উঠবে এক বিশাল জাতীয় কর্মশালা, যার নেতৃত্বে থাকবেন বিজ্ঞানী ও শিল্পপতিরা। তাদের নিচে শ্রমিকেরা কাজ করবে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে এক মানবিক শিল্পসমাজ–দারিদ্র্যহীন, শান্তিপূর্ণ।
জীবনের শেষ দিকে সাঁ-সিমোঁ লিখলেন 'দ্য নিউ খ্রিষ্টিয়ানিটি', যেখানে তার পুরো সমাজ-ভাবনাকে শিল্পযুগের এক নতুন ধর্মে রূপ দিলেন। মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা সত্যিই চার্চ গড়ে তোলে। তারা পরত সাদা প্যান্ট, লাল ভেস্ট আর নীল টিউনিক–সাদা প্রেমের, লাল শ্রমের, নীল বিশ্বাসের প্রতীক। এমনকি তারা এমন এক ওয়েস্টকোট বানায়, যা একা পরা যায় না। মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতাই ছিল তার প্রতীক। কৌতূহলী প্যারিসবাসীরা তাই ভিড় জমাত এই অদ্ভুত সাঁ-সিমোনিয়ানদের দেখতে।
ফুরিয়ে, ওউয়ন আর সাঁ-সিমোঁ তিনজনেই বিশ্বাস করতেন যে বাজার আর প্রতিযোগিতা ভালো সমাজ গড়তে পারে না। তাই তাদের অনেকে সমাজতন্ত্রের প্রবর্তক মনে করেন–যে ব্যবস্থায় সম্পদ ব্যক্তিগত মালিকানায় নয়, ভাগাভাগি করে রাখা হয়, যাতে সবাই একই মানের জীবন পায়। তবে তাদের ধারণা আজকের সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। অনেকেই যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পত্তি মানুষে মানুষে বড় বৈষম্য সৃষ্টি না করে, ততক্ষণ অবধি ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে মেনে নিয়েছিলেন।
এই ইউটোপিয়ান চিন্তাবিদদের এক বিশ্বাসে মিল ছিল–মানুষের যুক্তি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করলেই এক নিখুঁত সমাজ, এক ইউটোপিয়া, গড়ে তোলা সম্ভব। তাই তারা ধনী-গরিবের সংঘাত বা বিপ্লবের পথ চাননি; শান্তিপূর্ণ রূপান্তরেই আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপজুড়ে যখন একের পর এক বিপ্লব দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ল, তাদের সেই শান্ত স্বপ্ন ভেঙে গেল। শুধু তা-ই নয়, কার্ল মার্ক্সসের তীব্র বিপ্লববাদী লেখাগুলোর পর তাদের পরিকল্পনা আরও নিষ্পাপ, প্রায় শিশুসুলভ বলে মনে হলো।
কিন্তু স্বপ্নের এই আলো দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী পুঁজিবাদ সমালোচক কার্ল মার্ক্স, যিনি ফুরিয়ে, ওউয়ন ও সাঁ-সিমোঁ–এই তিনজনের চিন্তা থেকে কিছুটা প্রেরণা পেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাদের পথকে দেখলেন অসম্পূর্ণ। তার মতে, তারা ছিলেন অতিমাত্রায় সৌম্য স্বপ্নদ্রষ্টা–নতুন পৃথিবীর উজ্জ্বল মানচিত্র আঁকতে পারলেও সেখানে যাওয়ার সত্যিকারের পথ, সংগ্রাম আর কৌশল তারা চিনতেন না। শান্তি, সদিচ্ছা, পরস্পরের মায়া–এসব দিয়ে পৃথিবী বদলাবে, এই ধারণাকে মার্ক্স প্রত্যাখ্যান করলেন প্রবল দৃঢ়তায়।
মার্ক্স বললেন, শ্রমিক ও মালিকের অন্তর্নিহিত সংঘর্ষ একসময় এমনভাবে বিস্ফোরিত হবে, যা কোনো মানবিক আহ্বান বা যুক্তিপূর্ণ অনুরোধে থামানো যাবে না। পুঁজিবাদ তার নিজের স্ববিরোধ আর শোষণের দায়ে ভেঙে পড়বে এক ভয়াবহ বিপ্লবে।
যেমন শুরুতে অন্ধকারের মাঝে এক ক্ষীণ আলো জেগে উঠেছিল, তেমনি শেষে বুঝতে হয়–মানবসভ্যতার পথচলা আসলে আলো ও অন্ধকারের অন্তহীন দ্বন্দ্ব। স্বপ্নদ্রষ্টারা আলো জ্বালেন, বিপ্লবীরা পথ ভাঙেন। আর মানুষ সেই দুই শক্তির মাঝেই খুঁজে ফেরে তার ভবিষ্যৎ।
