বিদেশি অর্থায়নে গতি পাচ্ছে শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতু প্রকল্প

শরীয়তপুর–চাঁদপুর নদীপথে দেশের সবচেয়ে বড় ক্যাবল-স্টেইড সেতু নির্মাণে আরেক ধাপ এগিয়েছে সরকার। সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) শেষ হওয়ার পর প্রকল্পটিতে অর্থায়নের আগ্রহ জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান।
প্রস্তাবিত শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতুটি হবে বাংলাদেশের দীর্ঘতম ক্যাবল-স্টেইড সেতু, যার দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ০৪ কিলোমিটার নির্ধারিত হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এ প্রকল্পটি ২০৩৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেতুটি জাতীয় অর্থনীতিতে ০ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনটি ধাপে নির্মিতব্য সেতুতে থাকবে ২ হাজার ১০০ মিটার ক্যাবল-স্টেইড অংশ। নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে মাঝখানে ৭০০ মিটার এবং দুই পাশে যথাক্রমে ৪০০ ও ৩০০ মিটার স্প্যান ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ৩০ মিটার।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন (পিএন্ডডি) বিভাগের পরিচালক মো. ভিখারুদ্দৌলা চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এটি বাংলাদেশের সেতু নির্মাণে একটি নতুন মাইলফলক হতে যাচ্ছে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে দেখা গেছে, সেতুটি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কম জমি অধিগ্রহণ ও কম ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।"
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, "সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে টেকসই সংযোগ স্থাপন করা। শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতুটি বাস্তবায়িত হলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সেতুটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নয়; আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ এবং জাপানের সেভেন প্ল্যাটফর্ম মিটিংয়ের সহায়তায় অর্থায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।"
সংযোগ ও অর্থনৈতিক প্রভাব
শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব কমবে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। চারটি বিভাগের ৩২ জেলার মধ্যে তৈরি হবে সরাসরি সড়কসংযোগ, যা যোগাযোগে আনবে আমূল পরিবর্তন। এতে সরাসরি উপকৃত হবেন প্রায় ৫ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ।
নৌ, সমুদ্র ও স্থলবন্দরের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কমবে সময় ও পরিবহন ব্যয়, বন্দরের আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমে আসবে গতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের বাণিজ্য ও শিল্প খাতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।
সেতুটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ২০২২ সালে। মাটি পরীক্ষা, নদীর নাব্যতা, ভাঙন, জীববৈচিত্র্যসহ সব দিক বিবেচনা করে জরিপের ফলাফল পাওয়া যায় ইতিবাচক। এর পর থেকেই সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়।
বর্তমানে শরীয়তপুর–চাঁদপুর নৌপথে প্রতিদিন শত শত যানবাহন ফেরিতে পারাপার হয়। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের অন্যতম যোগাযোগ পথ। কিন্তু পুরোনো চারটি ছোট ফেরির ওপর নির্ভর করায় প্রতিদিনই দীর্ঘ অপেক্ষা ও ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও পরিবহন চালকরা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পারাপার আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, রোগী ও পণ্য পরিবহনেও দেখা দেয় বিঘ্ন।
মংলা বন্দর থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রাকচালক ইদ্রিস মিয়া টিবিএসকে বলেন, "এই সেতুর জন্য আমরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করছি। ফেরিতে পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগে, কখনো চাঁদাবাজির মুখেও পড়তে হয়। অনেক সময় শিপমেন্টও বাতিল হয়ে যায়। সেতু হলে এসব দুর্ভোগ কেটে যাবে।"
ব্যবসায়ী দেলোয়ার বেপারী বলেন, "সেতু নির্মিত হলে বন্দর–টু–বন্দর সরাসরি সংযোগ তৈরি হবে। ঢাকায় ঘুরে যাওয়ার প্রয়োজন থাকবে না। দূরত্ব কমবে, সময় বাঁচবে, ব্যবসায় গতি আসবে। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সত্যিকারের উন্নয়নের সুফল পাবে।"
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতু নির্মিত হলে ভ্রমণ দূরত্ব প্রায় ৬৭ কিলোমিটার কমে আসবে, ফলে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতে সময় আর খরচ—দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এর মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে আসবে নতুন গতি।
সাগরবন্দর, স্থলবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌপথের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ স্থাপিত হলে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রমে যোগ হবে নতুন মাত্রা। প্রকল্পের পরিপূরক হিসেবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সড়ক প্রশস্তকরণের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিদ্যমান সড়কগুলোকে চারলেন মহাসড়কে রূপান্তরের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে, যাতে সেতুটি দেশের প্রধান যোগাযোগ করিডরের সঙ্গে নির্বিঘ্নে যুক্ত হতে পারে।
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর মতে, প্রকল্পটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সহজ গতিশীলতা তৈরি হলে বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
যদিও সেতু নির্মাণ কাজ ২০৩৩ সালে শেষ হওয়ার কথা, তবু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রস্তুতিমূলক কাজ ইতোমধ্যেই দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্থায়ন নিয়ে আলোচনাও শেষ পর্যায়ে, এবং সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, শরীয়তপুর–চাঁদপুর সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম রূপান্তরমূলক অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হবে।