ক্রুজে ভেসে সমুদ্রবিলাস: ‘স্বপ্নতরী’তে চড়ে কক্সবাজার ভ্রমণের নতুন অভিজ্ঞতা
অফিসের ক্লান্তি, যানজটের ধোঁয়া, সংসারের নানা দায়িত্ব আর শহরের একঘেয়ে জীবনের ফাঁকে কে না চান একটু নিঃশ্বাস নিতে! ব্যস্ত জীবনের এই চক্র থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পেতে কতোই না পরিকল্পনা আমাদের। কিন্তু এতসব দায়-দায়িত্বের জটিলতায় অনেক সময়ই লম্বা ছুটিতে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই সুযোগ পেলেই সমুদ্রপ্রেমীরা দুদিনের ছুটিতে দৌড়ান কক্সবাজারে।
আর কক্সবাজার মানেই ওই সমুদ্রস্নান, বিচে হাঁটা, সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভোজন, ঝিনুক-মুক্তার মালা কেনা—এছাড়া আর কীই-বা আছে সেখানে? যারা একাধিকবার কক্সবাজারে গিয়েছেন, তাদের কাছে সমুদ্রস্নান আর বিচে হাঁটাহাটি ছাড়া হয়তো আর কিছুই তেমন আকর্ষণীয় লাগে না।
তবে এখন কক্সবাজার মানে শুধু বিচে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখা নয়—বরং ক্রুজে চড়ে সমুদ্র থেকে বিচ দেখা! অবাক লাগছে, তাই না?
এতদিন কেবল টেকনাফ বা কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সময়েই ট্রলার, স্পিডবোট বা জাহাজে করে সমুদ্র ভ্রমণের কথা আমরা জানতাম। তবে এবার শুধু সমুদ্র উপভোগের জন্যই কক্সবাজারে ফারহান এক্সপ্রেস ট্যুরিজম নিয়ে এসেছে 'স্বপ্নতরী'তে করে ক্রুজ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুই শিফটে যাত্রী নিয়ে সমুদ্রভ্রমণে যায় স্বপ্নতরী। সকালের ট্রিপ শুরু হয় ঠিক সকাল ৯টায়। টিকিট সংগ্রহ করা যায় অনলাইনে (বাসবিডি ডটকম), ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে, এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর সড়কের বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে। এখান থেকেই সকালে যাত্রা শুরু করে স্বপ্নতরী; প্রথম ট্রিপ শেষে ফিরে আসে বিকেল ৩টায়।
ভ্রমণের সময় স্বপ্নতরী আপনাকে নিয়ে যাবে বাঁকখালী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। পথে দেখা মিলবে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প, ম্যানগ্রোভ বন, মহেশখালী আদিনাথ জেটি, বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোনাদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার সৈকতের মনোমুগ্ধকর ল্যান্ড ভিউ—কলাতলী, লাবনী ও সুগন্ধা পয়েন্ট—শুঁটকি মহাল এবং সমুদ্রের মাঝে নির্মিত বিমানবন্দরের দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে।
সকালের ট্রিপটির নাম দেওয়া হয়েছে লাঞ্চ ক্রুজ। এই ক্রুজের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো—এটি যাত্রীদের মহেশখালী দ্বীপে নামিয়ে দেয় এবং প্রায় দুই ঘণ্টা সময় দেয় দ্বীপটি ঘুরে দেখার জন্য। সেখানে নেমে দেখা যায় বিখ্যাত আদীনাথ মন্দির ও পাহাড়, গোরকঘাটা বাজার, লবণ ও চিংড়ি ঘেরসহ আরও অনেক আকর্ষণীয় স্থান। চাইলে নিতে পারবেন মহেশখালীর বিখ্যাত পানের স্বাদও।
সকালে জাহাজে ওঠার পর যাত্রীদের পরিবেশন করা হয় ওয়েলকাম ড্রিংকস। এর মাধ্যমেই শুরু হয় সমুদ্রযাত্রা। নদী–সমুদ্রের মোহনা ঘুরে বেলা ১২টার দিকে স্বপ্নতরী পৌঁছে মহেশখালী দ্বীপে। সেখানে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রায় দুই ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় ঘোরাঘুরির জন্য। বেলা ২টার মধ্যে সবাইকে আবার ফিরে আসতে হয় জাহাজে। জাহাজে ফেরার পর পরিবেশন করা হয় দুপুরের খাবার।
খাবারের মেন্যুতে থাকে ভাত, মুরগি, চিংড়ি, ডিমের তরকারি, সবজি, ডাল, সালাদ ও মিনারেল পানি। সমুদ্রের বুকে ভেসে লাঞ্চ করতে করতে আবার ফিরে আসে জাহাজ, ঠিক যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল—বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে।
এই সময়ের মধ্যেই ক্রুরা একই জাহাজে বিকেলের সানসেট ক্রুজের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
জাহাজের ক্যাপটেন মো. আরাফাত জানান, স্বপ্নতরীতে মোট ১৪৬টি আসন রয়েছে। "প্রতিদিন একেক ট্রিপে অন্তত ১০০ থেকে ১২০ জন যাত্রী ভ্রমণ করেন। আর পিক সিজনে—ডিসেম্বর ও জানুয়ারিত—সব যাত্রীকে জায়গা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।"
জাহাজের লস্কর সেলিম জানালেন, পিক সিজনে টিকিট বুকিং শুরু হয়ে যায় ১৫–২০ দিন আগে থেকেই। সপ্তাহের সাত দিনই সার্ভিস দেয় স্বপ্নতরী।
ক্রু বা লস্কর, ইঞ্জিন ড্রাইভার, ক্যাপটেনসহ মোট ১০-১২ জন জাহাজটি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। প্রতি ট্রিপেই তারা জাহাজে উপস্থিত থাকেন।
বিকেলের সানসেট ক্রুজ শুরু হয় বিকেল সাড়ে ৩টায় এবং ঘোরাঘুরি শেষে ঘাটে ফিরে আসে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। সময় কম হওয়ায় এই ক্রুজে ভারী খাবার পরিবেশন করা হয় না; থাকে কেবল স্ন্যাকস ও পানি। এছাড়া মহেশখালীতে নামার বিরতিও দেওয়া হয় না, কারণ রাতের আধার নামার আগেই ঘাটে ফেরার তাড়া থাকে। ফলে লাঞ্চ ক্রুজের তুলনায় সানসেট ক্রুজের জনপ্রতি ভাড়াও কিছুটা কম।
তবে সানসেট ক্রুজে যেটা বাড়তি পাওয়া যায়, তা হলো—স্বপ্নতরীতে ভেসে সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত দেখার নান্দনিক দৃশ্য।
জাহাজটিতে রয়েছে একই ধরনের সুবিধাসম্পন্ন দুইটি লাউঞ্জ—ক্যামেলিয়া ও রয়েল। এছাড়া রয়েছে একটি ভিআইপি কেবিন।
সকালের লাঞ্চ ক্রুজে ক্যামেলিয়া ও রয়েল লাউঞ্জের প্রতি আসনের ভাড়া ১,২০০ টাকা; আর ভিআইপি কেবিনের ভাড়া ৫,২০০ টাকা। কেবিনটি দুজনের জন্য।
অন্যদিকে, সানসেট ক্রুজে ক্যামেলিয়া ও রয়েল লাউঞ্জের প্রতি আসনের ভাড়া পড়ে ৭০০ টাকা। তবে এই ট্রিপে ভিআইপি কেবিনটি সাধারণ যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত নয়।
টিকিটের মূল্যের মধ্যেই খাবারের খরচ অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ খাবারের জন্য আলাদা করে কোনো টাকা দিতে হয় না।
এছাড়া, কেউ চাইলে পুরো জাহাজটি বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়াও নিতে পারেন। কত সময়ের জন্য নেবেন এবং কোন পর্যন্ত ভ্রমণ করবেন সেটির ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ হয় ভাড়া।
বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে কথা হয় স্বপ্নতরীর মালিক হোসাইন ইসলাম বাহাদুরের সঙ্গে। ২০১৪ সাল থেকে ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বাহাদুর জানান, ক্রুজ সার্ভিস চালুর ধারণাটি প্রথম তার মাথায় আসে ২০১৮ সালে। সে সময় তিনি বিআইডব্লিউটিএ–এর একটি জাহাজ (সি-ট্রাক) নিয়ে এই রুটে ব্যবসা শুরু করেন। তবে তাতে লাভের মুখ দেখা যায়নি।
কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাহাদুর বললেন, "সি-ট্রাকটা ছিল লোহার তৈরি। ফলে এর পরিচালন ব্যয় ছিল অনেক বেশি, তেলও লাগত প্রচুর। আবার স্পিডও ছিল কম। তাই মানুষ খুব একটা আগ্রহী হত না উঠতে। ফলে লোকসান গুনে সে উদ্যোগ বন্ধ করতে হয়।"
তিনি আরও জানান, "এরপর ২০২২ সালে আবারও উদ্যোগ নিই, আর তখন কিছুটা সফলতা পাই। সে সময় আমার সি-ট্রাকের ক্যাপাসিটি ছিল ৬৫ জনের। মোটামুটি ভালোই লাভ হয়েছিল। এরপর বড় আকারে কাজ শুরু করার ইচ্ছা জাগে। তাই ২০২৪ সালে কাঠের এই জাহাজ বানিয়ে সার্ভিস চালু করি। এখন লাভও ভালোই হচ্ছে।"
২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন হয় স্বপ্নতরীর। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি নিয়মিত সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে যাত্রী তুলনামূলক কম থাকলেও নভেম্বরের দিকে কক্সবাজার ভ্রমণের পিক সিজন শুরু হয়, আর তখন থেকেই বেড়ে যায় যাত্রীসংখ্যা।
বাহাদুর বলেন, "প্রথম দিকে যাত্রী তেমন ছিল না, কিন্তু নভেম্বর থেকে সিজন শুরু হওয়ার পর সকাল-বিকাল দুই ট্রিপ করেও সবাইকে জায়গা দিতে পারি না।"
স্বপ্নতরীর মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে গর্জন ও শীল কাঠ দিয়ে। আসবাবপত্র, নকশা ও অন্যান্য অংশে ব্যবহার হয়েছে শেফালি ও মেহগনি। স্থানীয় শ্রমিকদের দক্ষতায় এবং সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ও উপাদানে নির্মিত হয়েছে এই জাহাজ।
বাহাদুর আরও জানান, তার এই জাহাজ নৌবাণিজ্য দপ্তরের জিএ প্ল্যান অনুমোদিত। অর্থাৎ, আসন সংখ্যা, আসনের অবস্থান, ইঞ্জিন স্থাপনসহ সব নকশা ও কারিগরি বিষয় আগেই নির্ধারণ করে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ফলে নদী ও সমুদ্রে চলাচলের জন্য জাহাজটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
এছাড়া, জাহাজটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন—লাইফ জ্যাকেট, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, লাইফ র্যাফট, জিপিএস, নেভিগেশন সরঞ্জাম ইত্যাদি রয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসব সরঞ্জাম সবসময় প্রস্তুত রাখা হয়।
ট্যুরিজম ব্যবসায় নিজের গভীর আগ্রহের কথা জানিয়ে বাহাদুর বলেন, "একটা ডিনার ক্রুজ চালুর পরিকল্পনা করছি। পাশাপাশি একটা ইয়ট বানানোরও ইচ্ছা আছে।"
ইয়টের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, "দেশের বাইরে থেকে একটা ইয়ট আমদানি করতে গেলে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা খরচ হবে। কিন্তু আমি আমদানি করছি না। ইয়ট বানানোর জন্য ইতোমধ্যে অকশন থেকে একটা বোট কিনেছি। সেটাকেই মডিফাই করে ইয়ট বানাবো। এতে খরচ অনেক কমে যাবে। এর জন্য কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছি।"
বাহাদুর মনে করেন, দেশের পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখনো তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তার মতে, এই খাতকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতে পারলে কক্সবাজার হতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত থাকা সত্ত্বেও এখানে পর্যাপ্ত আধুনিক বিনোদন ও উপভোগের সুযোগের অভাব রয়েছে। ফলে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
বিশ্বের উন্নত দেশের পর্যটন খাতের আদলে ক্রুজ, ইয়টের ব্যবসা করে বাংলাদেশের পর্যটনকেও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান বাহাদুর।
স্বপ্নতরীর অনুমোদন, নিবন্ধন ও রুট পারমিট নেওয়া হয়েছে নৌবাণিজ্য দপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ থেকে। তবে পর্যটন সেবার উদ্দেশ্যে এই জাহাজ পরিচালিত হলেও পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না বলে জানান তিনি।
বাহাদুরের মতে, এসব ক্ষেত্রে ট্যুরিজম বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা না থাকাই বাংলাদেশের পর্যটন খাত পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, "আসলে এ কারণেই আমাদের ট্যুরিজম খাত অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। ট্যুরিজম বোর্ড যদি এসব উদ্যোগের দায়িত্ব নিত, এগুলো পরিচালনা ও তদারকি করত, তাহলে আমাদের পর্যটন খাত এতদিনে আরও এগিয়ে যেত।"