‘পড়াশোনা করে লাভ নেই’ এমন পোস্ট দিলেই বিপদ, ইন্টারনেট থেকে ‘হতাশা’ দূর করতে চীনের বিশেষ অভিযান

দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইন্টারনেটজুড়ে ছড়িয়ে পড়া হতাশার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে চীন সরকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে 'মাত্রাতিরিক্ত নেতিবাচক ও হতাশামূলক' পোস্ট দমনের লক্ষ্যে দুই মাসব্যাপী এক বিশেষ অভিযান শুরু করেছে দেশটির সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, এই অভিযানের লক্ষ্য হলো 'নেতিবাচক আবেগ সংশোধন' এবং 'আরও সভ্য ও যৌক্তিক অনলাইন পরিবেশ' তৈরি করা। এই অভিযানের মূল লক্ষ্যবস্তু 'পড়াশোনা করে লাভ নেই' বা 'কঠোর পরিশ্রম বৃথা'—এ ধরনের ধারণা প্রচারকারী পোস্ট এবং 'জীবনবিমুখিতা' উসকে দেয় এমন সব অনলাইন কনটেন্ট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পত্তি সংকট, উচ্চ বেকারত্ব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চাকরির বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা চীনের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের মোহভঙ্গ তৈরি করেছে।
সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির সামাজিক বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সাইমন সিহাং লুও বিবিসিকে বলেন, 'চীনের তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তাদের জীবনযাত্রা যে সম্ভবত তাদের বাবা-মায়ের প্রজন্মের চেয়ে খারাপ হতে চলেছে, সেই কঠিন সত্যটির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।'
তরুণদের মধ্যে বাড়তে থাকা এই হতাশা নিয়ে বেইজিংয়ের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে প্রভাবশালী অনলাইন ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নেমে আসা নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে।
বৈষম্যের রসিকতাও ঝুঁকিপূর্ণ
সম্প্রতি পরিচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর হু চেনফেংয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে সব পোস্ট মুছে ফেলা হয়েছে। চীনা কর্মকর্তারা কোনো ব্যাখ্যা না দিলেও ধারণা করা হচ্ছে, তার একটি ভাইরাল মন্তব্যই এর কারণ।
এক লাইভস্ট্রিমে তিনি মানুষ ও বিভিন্ন জিনিসকে 'অ্যাপল' ও 'অ্যান্ড্রয়েড'—এই দুই ভাগে ভাগ করে অ্যান্ড্রয়েডকে নিম্নমানের বলে বর্ণনা করেন। বৈষম্য নিয়ে করা এই রসিকতা অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই তার বিরুদ্ধে সামাজিক বিভেদ তৈরির অভিযোগ তোলেন। চীনে এখন এ ধরনের রসিকতাও স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হয়েছে, কারণ এটি এমন বিভাজনকে তুলে ধরে, যা নিয়ে সাধারণ মানুষ ভাবুক, এমনটা চায় না চীনের কমিউনিস্ট পার্টি।
একইভাবে, শিক্ষা ও সামাজিক বিষয় নিয়ে সোজাসাপ্টা বক্তব্যের জন্য পরিচিত অনলাইন শিক্ষক ঝাং শুয়েফেংও সেন্সরের কবলে পড়েছেন। লাখ লাখ অনুসারী থাকা তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোতে নতুন অনুসারী যুক্ত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঝাং প্রায়ই তরুণদের স্বপ্ন না দেখে পরীক্ষার নম্বর ও আর্থিক চাপের মতো কঠিন বাস্তবতা মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। ধারণা করা হচ্ছে, তার প্ল্যাটফর্ম হতাশা ছড়ানোর আদর্শ মঞ্চ হয়ে ওঠায় এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অনলাইন জগৎ 'পরিষ্কারের' উদ্যোগ
শুধু ব্যক্তি নয়, চীন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোকেও এই 'পরিষ্কার' অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য করছে। 'নেতিবাচক' বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় শাওহংশু, কুয়াইশো এবং ওয়েবোর মতো জনপ্রিয় অ্যাপের বিরুদ্ধে 'কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা' নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। তাদের মতে, 'একটি স্বচ্ছ ও স্বাস্থ্যকর সাইবার জগৎ জনগণের স্বার্থেই প্রয়োজন।'
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাইবার জগৎকে কৃত্রিমভাবে ইতিবাচক রাখার এই চেষ্টার একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ড. লুও বলেন, 'হতাশা প্রকাশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলে তা তরুণদের সম্মিলিত মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আরও খারাপ হতে পারে।'
এদিকে, যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের কারণে চীনের তরুণরা প্রচলিত ইঁদুর দৌড় থেকে সরে এসে 'লাইয়িং ফ্ল্যাট' (কর্মবিমুখতা) ধারণার দিকে ঝুঁকছে এবং অনলাইনে হতাশা প্রকাশ করছে, সেই মূল সমস্যাগুলো কিন্তু রয়েই গেছে। চাকরি না পেয়ে বা ক্লান্তিকর কাজ থেকে বিরতি নিতে অনেক তরুণ-তরুণী এখন বাবা-মায়ের সংসারে ফিরে গিয়ে নিজেদের 'ফুল-টাইম সন্তান' হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আদর্শগত অভিযান দিয়ে সমস্যার সামাজিক শিকড় নির্মূল করা সম্ভব নয়। ড. লুও-এর মতে, 'অর্থনৈতিক মন্দা, চাকরির বাজার যখন নির্মম প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং জন্মহার যখন সর্বনিম্ন, তখন চীনের মতো শক্তিশালী সরকারের পক্ষেও বলপ্রয়োগ করে মানুষের হতাশা দূর করা কঠিন।'