বিদেশি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের টানতে নতুন ‘কে ভিসা’ চালু করলো চীন

্ন এই সপ্তাহে বিদেশি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের আকর্ষণ করতে নতুন ভিসা কর্মসূচি চালু করছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটে, এই পদক্ষেপকে বেইজিংয়ের কৌশলগত সাফল্যের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কারণে অনেক সম্ভাব্য আবেদনকারী বিকল্প খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
যদিও চীনে দক্ষ স্থানীয় প্রকৌশলীর অভাব নেই, তবুও এই কর্মসূচি বেইজিংয়ের প্রচেষ্টার অংশ, যেখানে তারা নিজেদের বিদেশি বিনিয়োগ ও মেধার জন্য উন্মুক্ত দেশ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এমন সময়ে এ সিদ্ধান্ত এলো যখন চীনের রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপ ঘিরে বাড়তে থাকা বাণিজ্য উত্তেজনা— চীনের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
চীন বিদেশি বিনিয়োগ ও ভ্রমণ বাড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন খাত উন্মুক্ত করা এবং ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের জন্য ভিসা ছাড় সুবিধা দেওয়া অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া-ভিত্তিক ইমিগ্রেশন আইনজীবী ম্যাট মাউনটেল-মেডিসি বলেন, "প্রতীকী দিক থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ: যুক্তরাষ্ট্র যখন বাধা তৈরি করছে, চীন তখন তা কমাচ্ছে।" বুধবার থেকে চালু হওয়া নতুন ভিসা ক্যাটাগরির নাম দেওয়া হয়েছে 'কে ভিসা'।
আগস্টে ঘোষিত 'কে ভিসা' তরুণ বিদেশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (স্টেম) স্নাতকদের লক্ষ্য করছে। এ ভিসা আগে থেকে কোনো চাকরির অফার ছাড়াই আবেদনকারীকে চীনে প্রবেশ, বসবাস ও কর্মসংস্থানের অনুমতি দেবে—যা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সুযোগ খুঁজতে থাকা কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে।
এরই মধ্যে চলতি মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে যে এইচ-১বি ভিসার জন্য কোম্পানিগুলোকে প্রতিবছর ১ লাখ ডলার ফি দিতে হবে। মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বহুল ব্যবহৃত এই ভিসার মাধ্যমে দক্ষ বিদেশি কর্মী নিয়োগ করে থাকে।
জিওপলিটিকাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান কৌশলবিদ মাইকেল ফেলর বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই এইচ-১বি নীতিতে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারল, আর 'কে ভিসার' জন্য চীনের সময়টা একেবারেই অসাধারণ।"
দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডও দক্ষ অভিবাসীদের আকর্ষণ করতে ভিসার শর্ত শিথিল করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, 'কে ভিসার' সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো—এতে কোনো স্পনসরিং নিয়োগকর্তার প্রয়োজন নেই, যা দীর্ঘদিন ধরে এইচ-১বি ভিসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করেছে।
এইচ-১বি ভিসার জন্য নিয়োগকর্তার স্পনসরশিপ বাধ্যতামূলক এবং তা লটারি পদ্ধতিতে দেওয়া হয়, যেখানে প্রতি বছর মাত্র ৮৫ হাজার ভিসা অনুমোদিত হয়। নতুন ১ লাখ ডলার ফি প্রথমবার আবেদনকারীদের আরও নিরুৎসাহিত করবে।
সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় শিক্ষার্থী বিকাশ কালী দাস বলেন, "এটি ভারতীয় স্টেম পেশাজীবীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প, যারা আরও নমনীয় ও সহজতর ভিসা ব্যবস্থা খুঁজছেন।" গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিল ভারত, যেখানে ৭১ শতাংশ অনুমোদিত আবেদনকারী ভারতীয় ছিলেন।
@ভাষাগত বাধা ও অনিশ্চয়তা
তবে প্রতিশ্রুতিশীল হলেও 'কে ভিসার' কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চীনা সরকারের নির্দেশিকায় অস্পষ্টভাবে বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম-অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে।
কোনো আর্থিক প্রণোদনা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্থায়ী বসবাস বা পরিবার স্পনসরশিপ নিয়ে এখনও বিস্তারিত তথ্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেয় না, বিরল কিছু ক্ষেত্র ছাড়া।
চীনের স্টেট কাউন্সিল 'কে ভিসার' কৌশল ও প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি।
ভাষা আরেকটি বড় বাধা। অধিকাংশ চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি ম্যান্ডারিনে কাজ করে, যা অ-চীনা ভাষাভাষীদের সুযোগ সীমিত করবে।
এছাড়া দিল্লি-বেইজিং রাজনৈতিক উত্তেজনাও ভারতীয় আবেদনকারীর সংখ্যা সীমিত করতে পারে, বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফেলর বলেন, "চীনের উচিত ভারতীয় নাগরিকদের স্বাগত জানানো এবং ম্যান্ডারিন ছাড়া অর্থবহ কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা।"
@কার জন্য 'কে ভিসা'?
চীনের প্রতিভা আকর্ষণের প্রচেষ্টা ঐতিহ্যগতভাবে বিদেশে থাকা চীনা বিজ্ঞানী ও প্রবাসী চীনাদের টানার দিকেই কেন্দ্রীভূত ছিল। এসব পেশাজীবীদের দেশে ফেরানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে তাদের বাড়ি কেনায় ভর্তুকি এবং সাইনিং বোনাস, যা ৫০ লাখ ইউয়ান (৭ লাখ ২ হাজার ডলার) পর্যন্ত হতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত চীনা স্টেম প্রতিভাদের অনেককেই দেশে ফেরানো সম্ভব হয়েছে, বিশেষত যখন ওয়াশিংটন এসব ব্যক্তির চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কঠোর নজরদারি করছে।
সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের দাস বলেন, "ভারতীয় প্রযুক্তি প্রতিভাদের লক্ষ্য করে চীনের নিয়োগ প্রচেষ্টা বেড়েছে, তবে এটি এখনো তুলনামূলকভাবে সীমিত। বরং চীনা স্টেম প্রতিভা ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক বেশি সুসংগঠিত ও অর্থায়নে সমৃদ্ধ।"
তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি-ভিত্তিক একটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে চাকরির প্রস্তাব পাওয়া এক চীনা স্নাতক 'কে ভিসার' কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, "চীনসহ এশীয় দেশগুলো অভিবাসনের ওপর নির্ভর করে না, আর স্থানীয় সরকারগুলোর হাতে দেশীয় প্রতিভা আকর্ষণের নানা উপায় রয়েছে।"
যুক্তরাষ্ট্রে ৫ কোটি ১০ লাখেরও বেশি অভিবাসী রয়েছে—যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। সে তুলনায় চীনে মাত্র ১০ লাখ বিদেশি আছে, যা তাদের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম।
যদিও চীন অভিবাসন নীতি বড় আকারে পরিবর্তন করে লাখ লাখ বিদেশি কর্মী নেওয়ার সম্ভাবনা কম, তবু বিশ্লেষকরা বলছেন 'কে ভিসা' বেইজিংকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় শক্তিশালী করতে পারে।
ফেলর বলেন, " চীন যদি বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিভার একটি ক্ষুদ্র অংশও আকর্ষণ করতে পারে, তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেক বাড়বে।"