অচলাবস্থা: ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল কেন চালু হচ্ছে না?

ঢাকা বিমানবন্দরের বহুলপ্রতীক্ষিত তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও জাপানি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে এখনও চুক্তি না হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে টার্মিনালটি উদ্বোধনের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।
দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চললেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আয় ও ব্যয়ের জন্য কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবিত মডেলে বাংলাদেশ সম্মতি দেয়নি।
গত ৭ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত শেষ ধাপের আলোচনাও কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়েছে। তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আলোচনা এখনও চলছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব নাসরিন জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এখনও জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা পর্যায়ে আছি। যেহেতু এটা একটা সরকার-টু-সরকার প্রক্রিয়া, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।'
জাপানি কনসোর্টিয়ামের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, কোনো সমঝোতা না হওয়ায় বিষয়টি সমাধানের জন্য এখন সরকার-টু-সরকার পর্যায়ে আলোচনা হবে।
এদিকে শেষ ধাপের আলোচনার আগে বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছিলেন, জাপানি কনসোর্টিয়াম যদি নতুন টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে রাজি না হয়, তবে সরকার অন্য আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। আমরা চাই দ্রুততম সময়ে টার্মিনাল চালু হোক। তবে আপনারা যে নির্দিষ্ট তারিখ জানতে চাচ্ছেন, সেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। কারণ, এখনও এমন কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি যে আমরা চালুর নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে পারি।'
তিনি আরও বলেন,'যখন আমাদের কাজ সম্পন্ন হবে, অপারেটর চূড়ান্ত হবে এবং হ্যান্ডওভার প্রক্রিয়া শেষ হবে, তখনই আমরা চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। এরপর অপারেশনাল প্রস্তুতির জন্যও কয়েক মাস সময় প্রয়োজন হবে।'
উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা যে অপারেটর নির্বাচন করব, তার সঙ্গে মিলে পূর্ণাঙ্গ অপারেশন টেস্ট এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন না হলে চালু করা সম্ভব নয়। এটা ধাপে ধাপে এগোনোর বিষয়।'

মূল সমস্যা কোথায়?
জাপান এয়ারপোর্ট টার্মিনাল কোম্পানি, সুমিতোমো, সোজিৎজ ও নরিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্পোরেশনকে নিয়ে গঠিত জাপানি কনসোর্টিয়ামকে বিগত সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেলে তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বাছাই করেছিল।
তবে সরকার পরিবর্তনের পর ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়গুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে মতৈক্য অর্জনে জটিলতা দেখা দেয়।
প্রস্তাবিত ব্যবস্থা অনুযায়ী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কনসোর্টিয়ামের তত্ত্বাবধানে দুই বছরের জন্য গ্রাউন্ড সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করবে এবং ডেটা সুরক্ষার দায়িত্ব থাকবে বেবিচকের কাছে।
কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্বে রয়েছে সুমিতোমো। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড তাদের ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করলে প্রতিনিধিরা কথা বলতে রাজি হননি।
তবে কনসোর্টিয়ামের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মূল মতবিরোধ আর্থিক মডেল নিয়ে। তিনি বলেন, 'মূলত আমরা আয়-ব্যয়ের যে কাঠামো প্রস্তাব করেছি, সেটাতে বেবিচক সায় দিচ্ছে না।'
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, টার্মিনালটিকে ঘিরে বাংলাদেশের যে পরিকল্পনা, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্বমানের পরিচালন ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্যই তাদের ব্যবসায়িক মডেলটি প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু বেবিচক এখনও এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।
সূত্র জানায়, 'বাংলাদেশের যে পরামর্শক, তারা মূলত ভারতের স্ট্যান্ডার্ডকে সামনে রেখে আয় ও ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। কিন্তু থার্ড টার্মিনাল যেহেতু সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ইকুইপমেন্ট ও ফিউচারিস্টিক ডিজাইন নিয়ে তৈরি হয়েছে, সেহেতু এর ব্যবস্থাপনাগত ব্যয় আঞ্চলিক মানদণ্ডে ধরলে ভারসাম্য থাকবে না।'
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে লাভজনক দুটি খাত—যাত্রী সুরক্ষা ফি ও বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি থেকে আয় ভাগাভাগি করতে বেবিচক আগ্রহী নয়।
'এই দুটি খাতের আয় ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বোর্ডিং ব্রিজ বা বাণিজ্যিক দোকান থেকে পাওয়া রয়্যালটির মতো দ্বিতীয় স্তরের আয়ের উৎস দিয়ে পরিচালন ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না,' বলেন তিনি।
কনসোর্টিয়ামের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাশার সাথে আমাদের আয়ের মার্জিনে খুব একটা পার্থক্য রয়েছে বলা যাবে না। এখনও সমঝোতা হতে পারে বলে আমরা আশাবাদী।'
২০২০ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের যাত্রীরা উভয় ফি দিচ্ছেন: অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য ১০০ টাকা ও ৭০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশগুলোর রুটে ৫ ডলার ও ৬ ডলার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গন্তব্যের জন্য ১০ ডলার করে।
কর্মকর্তারা বলেন, বিমানের সঙ্গে গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং চুক্তিটি কোনো বড় বাধা নয়। তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য কনসোর্টিয়াম বেবিচককে অতিরিক্ত একটি সেবাদাতা নিয়োগের কথা বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছে।
বেবিচকের একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, এখনও প্রকল্পের আর্থিক সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। 'ওদের দিক থেকে স্পষ্ট কোনো রেভিনিউ শেয়ারিং প্রস্তাব আসেনি। আমাদের পক্ষে লাভজনক না হলে তো প্রকল্পে যাওয়ার যুক্তি নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'এটা পিপিপি প্রকল্প। সেক্ষেত্রে রেভিনিউ শেয়ারিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওরা কী পরিমাণ লাভ চায়, সেটা নির্দিষ্ট করে বলেনি। কানেক্টিভিটি, ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন—সব মিলিয়েই ওদের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো মডেলটা এখনও লাভজনক মনে হচ্ছে না।'
এই অচলাবস্থা কি ভবিষ্যতে জাপানি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে?
এখন একটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে: জাপানি কনসোর্টিয়ামকে যদি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব না দেওয়া হয়, তবে সেই সিদ্ধান্ত কি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জাপানি ঋণ বা বিনিয়োগে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে?
উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সরাসরি কোনো উত্তর না দিলেও স্পষ্ট করেছেন যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই প্রকল্পের বিনিয়োগকারী নয়, শুধু ঋণদাতা।
তিনি বলেন, 'জাইকা এখানে ঋণদাতা সংস্থা। বিনিয়োগটি বাংলাদেশ সরকারের।'
২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়, যার বেশিরভাগ অর্থায়ন করেছে জাইকা। সংস্থাটি সহজ শর্তে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এসেছে।
উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন বলেন, 'এই বিনিয়োগের দায়ভার আমাদের ওপরও রয়েছে। শুধু যাত্রীসেবা উন্নত করাই নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক দায়িত্বও। সেদিক থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব টার্মিনালটি চালু করতে।'
জাইকার ঢাকা অফিসও পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তারা পরিচালনা-সংক্রান্ত আলোচনার অংশ নয়।
সংস্থাটি এক লিখিত জবাবে জানিয়েছে, জাইকা নির্মাণকাজে অর্থায়ন করলেও তারা সরাসরি পরিচালনা-সংক্রান্ত আলোচনায় জড়িত নয়। এই আলোচনা বাংলাদেশ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ এবং জাপানের ভূমি, অবকাঠামো, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সরকার-টু-সরকার কাঠামোর অধীনে বেবিচক ও জাপানি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে হচ্ছে।
বিলম্বের কারণে যন্ত্রপাতির ওপর প্রভাব
জাপানের সহায়তায় নির্মিত ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এই অত্যাধুনিক টার্মিনালটি বছরে ২ কোটি যাত্রীকে সেবা দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। টার্মিনালটিতে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যাগেজ সিস্টেম ও উন্নত যাত্রী সুবিধা রয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে এ টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন হয়েছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা ছিল। তবে সরঞ্জাম আমদানিতে বিলম্ব, নেতৃত্বে পরিবর্তন ও রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে সময়সীমা আবারও পিছিয়ে গেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মেয়াদ পার হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ তৃতীয় টার্মিনাল চালুর জন্য ২০২৫ সালের ডিসেম্বরকে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৯৯.৮৮ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে বেবিচক এখন এটি চালুর কোনো নির্দিষ্ট তারিখ জানাতে পারছে না।
এদিকে বেবিচকের একজন কর্মকর্তা জানান, কিছু সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে গেছে বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে, যা উদ্বেগ তৈরি করেছে। আর্থিক ক্ষতি এড়াতে টার্মিনালটি দ্রুত চালু করার চেষ্টা চলছে।
গত ৪ আগস্ট বিমানের একটি ফ্লাইট প্রথমবারের মতো এই টার্মিনালের প্যাসেঞ্জার বোর্ডিং ব্রিজ (পিবিবি) ও ভিজ্যুয়াল ডকিং গাইডেন্স সিস্টেম (ভিডিজিএস) ব্যবহার করে। এয়ারলাইনটি একে কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও সেবার মান উন্নয়নের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ঢাকা বিমানবন্দর সূত্র আরও জানিয়েছে, বোর্ডিং ব্রিজ পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ইতিমধ্যে চলছে। টার্মিনালটি সার্বক্ষণিক (২৪/৭) চালু রাখতে চারটি শিফটে ৪ হাজার নিরাপত্তা কর্মীসহ প্রায় ৬ হাজার জনবলের প্রয়োজন হবে।
পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে তৃতীয় টার্মিনাল বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা তিনগুণ এবং কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা দ্বিগুণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।