নিয়ন্ত্রকই যখন অপারেটর: এয়ারপোর্টের আগুনে উন্মোচিত জবাবদিহির সংকট
সর্বশেষ সরকারি তদন্তে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার—বিশেষ করে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক)—ব্যর্থতা উঠে আসার পর একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে এসেছে: যখন নিয়ন্ত্রকই অপারেটরের ভূমিকায় থাকে, তখন সেই নিয়ন্ত্রকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত কে করবে?
বর্তমানে বেবিচক একইসঙ্গে এয়ারপোর্ট অপারেটর এবং এভিয়েশন নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছে—যা আন্তর্জাতিকভাবে "খুবই অস্বাভাবিক" বলে বিবেচিত, এবং কাঠামোগতভাবে স্বার্থের সংঘাতপূর্ণ ভূমিকা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি ২৫ নভেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ ব্যবস্থার ঝুঁকি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনের অন্যতম প্রধান সুপারিশ হলো—বেবিচকের তত্ত্বাবধানে থাকা বিমানবন্দর পরিচালনার কাজ একটি যোগ্য, স্বাধীন অপারেটরের হাতে দেওয়া।
তদন্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনের পাশাপাশি কুরিয়ার কোম্পানিসমূহ ও ঢাকা কাস্টম হাউসের ব্যর্থতাও চিহ্নিত করা হয়। আগুনের সূত্রপাত হয় কুরিয়ার শেডের সম্প্রসারিত অংশে উত্তর–পশ্চিম কোণে ডিএইচএল, আরএস এবং এসআরকে-র যৌথ ব্যবহৃত একটি খাঁচায় "বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট" থেকে।
বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হুসেইন টিবিএস-কে বলেন, কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কখনোই পরিচালকের দায়িত্ব নিতে পারে না। "যে সংস্থা বিমানবন্দর পরিচালনাই করছে, তার পক্ষে একইসঙ্গে মনিটরিং ও অডিটের কাজ করা সম্ভব নয়। এতে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আইকাও মানদণ্ড অনুযায়ী, রেগুলেটরকে হতে হবে স্বাধীন, সক্ষম এবং পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন।"
"এয়ারপোর্ট অপারেশন একটি বিশেষায়িত কাজ। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞ অপারেটরদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। চাইলে সরকারও 'বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট অথরিটি' নামে আলাদা অপারেটর সংস্থা গঠন করতে পারে—এবং বেবিচক থাকবে কেবল রেগুলেটরি ভূমিকায়," যোগ করেন মাহমুদ হুসেইন, যিনি বর্তমানে অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ -এর এভিয়েশন স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, রেগুলেশন্স ও নিরাপত্তা বিভাগের শিক্ষক।
সাবধান করে তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রকদের অডিট বা লাইসেন্স বাতিলের মতো ক্ষমতা যদি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে জবাবদিহি দুর্বল হয়ে যায়। "রেগুলেটর যদি নিজেই দায়ী হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেবে কে? এজন্যই রেগুলেটরকে স্বাধীনভাবে শক্তিশালী করা জরুরি। রেগুলেশন, অডিট ও লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা যদি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তাহলে কার্যকর জবাবদিহি হয় না।"
নিরাপত্তা ব্যর্থতার দীর্ঘদিনের রেকর্ড
১৮ অক্টোবরের আগুন আমদানি কার্গো ভিলেজের কুরিয়ার শেড পুড়িয়ে দেয়, বিপুল পরিমাণ পণ্য ধ্বংস হয় এবং বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হয়।
বেবিচক ১৯৮২–৮৩ সালে ভবনটি নির্মাণ করে, যার অভ্যন্তরীণ এলাকা ১২,৪৫৫ বর্গফুট এবং ৯,১৫০ বর্গফুটের টিনশেড—যা কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর সংগঠন- আইএইইএবি অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করে। বিমানের একটি অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে দেখা যায়, ওই শেডে প্রাথমিক অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন প্রথমে এটি পরিকল্পিত নাশকতা মনে করলেও সরকারি অনুসন্ধান পরে নিশ্চিত করে, এতে কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ নেই।
তদন্তে কার্গো ভিলেজ ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা ধরা পড়ে: আমদানি কার্গোর যথাযথ তদারকি ছিল না; বিপজ্জনক পণ্যের সুরক্ষা ছিল না; বিমানবন্দরের কাঠামোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ফায়ার স্টেশন ছিল না; এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের একাধিক বিধান লঙ্ঘিত হয়। প্রায় ৪০০ টন পণ্য নিয়মিতভাবে এপ্রনে স্তূপ করে রাখা হতো, যা শেডে প্রবেশ পথও বাধাগ্রস্ত করত।
কুরিয়ার ও কার্গো স্থাপ্নার লিজদাতা হিসেবে বেবিচক ২০২০ সালের ইমারত র্নিমাণ বিধিমালা অনুযায়ী, কাঠামোগত নিরাপত্তা ও অগ্নি-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। কার্গো ভিলেজের যেখানে আগুন লাগে, সেই অংশের কোনো অনুমোদিত নকশা ছিল না।
এভিয়েশন বিশ্লেষক ও বিমানের সাবেক বোর্ড সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম টিবিএস-কে বলেন: "বেবিচক তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। যখন নিয়ন্ত্রকই অপারেটর, তখন তাকে জবাবদিহি করাবে কে?"
তিনি উল্লেখ করেন, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বাংলাদেশের নিউইয়র্ক ফ্লাইট পুনরায় চালু নিয়ে আপত্তি জানানোর যে কারণগুলো উল্লেখ করেছে—এর মধ্যে অন্যতম ছিল বেবিচক–এর এই দ্বৈত ভূমিকা।
অন্যান্য দেশ কীভাবে বিমানবন্দর পরিচালনা করে
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হুসেইন জানান, বহু দেশ স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপারেটর ও নিয়ন্ত্রকের মাঝে স্পষ্ট বিভাজন বজায় রাখে। কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুরে পৃথক ও স্বাধীন এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে, আর নিয়ন্ত্রকের কাজ করে আলাদা সংস্থা।
"কিন্তু, বাংলাদেশে বেবিচকের হাতেই নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা, লাইসেন্সিং, ব্যবস্থাপনার সব ক্ষমতা। অভিভাবক যখন অপারেটর, তখন সে-ই হয় লঙ্ঘনকারী। শাস্তির জায়গা তখন থাকে না," তিনি বলেন।
বর্তমান কাঠামোয় সিএএবিকে জবাবদিহির আওতায় আনার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহমুদ হুসেইন বলেন, কেবল বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ই তা করতে পারে। তিনি বলেন, এ বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখাতের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
শাস্তি ও সংস্কারের দাবি
প্রতিবেদনটি ২০১১ সালের পর থেকে বিমানবন্দরে সাতটি বড় অগ্নিকাণ্ডের রেকর্ড তুলে ধরে। এছাড়া আরও জানায়, বেবিচক ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নয় বছর ধরে স্বাক্ষরহীন পড়ে আছে। বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম স্থানান্তরের সুপারিশ—যা ২০২১ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথরিটি ফর দ্য কেমিক্যাল উইপনস কনভেনশন করেছিল—তাও উপেক্ষিত হয়।
বেবিচকের লিজভুক্ত সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ বিমান নিজস্ব স্থাপনার অগ্নি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে, বিমানকে কেবল ফ্লাইট অপারেশনে সীমিত রাখতে; গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষম অপারেটরকে নিয়োগ দিতে। কুরিয়ার কোম্পানিগুলোও, লিজদাতা হিসেবে বেবিচক-ও একইভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, "যারা দায়ী তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা প্রথম ঘটনা নয়—যাত্রী টার্মিনাল ও কার্গো টার্মিনাল, দুই জায়গাতেই আগুন লাগার উদাহরণ আছে। কিন্তু কখনও দায়ীদের শাস্তি হয়নি। এবারের সুপারিশগুলো যেন শুধুমাত্র কাগজেকলমেই সীমাবদ্ধ না থাকে।"
তদন্ত প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়, "সংশোধনী কার্যক্রম না হওয়া পর্যন্ত পুনরায় অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সার্বিক অব্যবস্থাপনা ও অগ্নিনির্বাপণে অক্ষমতার কারণে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।"
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক বলেন, কর্তৃপক্ষটি তদন্ত প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনে মন্তব্য দেবে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে আইএইইএবি সভাপতি কবির আহমেদ কুরিয়ার কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার দাবি, গুদাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেহেতু বেবিচকের, তাই দায়ও তাদের। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে গুদাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কুরিয়ার সংগঠন থেকে সরানোর পর বেবিচককে দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ও বৈদ্যুতিক ঝুঁকির বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ বিমানের মুখপাত্র বুশরা ইসলাম জানান, বিমান প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেছে, কিন্তু সংস্থাটি কোনো দায় স্বীকার করে কি না—সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
কার্যকর নিয়ন্ত্রকের জন্য যা প্রয়োজন
শিল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, বেবিচক-কে কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন—পর্যাপ্ত জনবল, আর্থিক স্বাধীনতা, এবং আন্তর্জাতিক মানের অডিট সক্ষমতা। বর্তমানে বেবিচকের নিয়মিত পরিদর্শন ও নিরাপত্তা অডিট পরিচালনার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই।
সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ হুসেইন বলেন, "যখন প্রয়োজনীয় লোক নেই, তখন সময়মতো তদারকি বা নিরাপত্তা অডিট হয় না। বিদেশি রেগুলেটররা যে মানদণ্ড অনুসরণ করে, আমাদের সে সক্ষমতা এখনো গড়ে ওঠেনি।"
জব্দ করা পণ্য নিলামে তোলার বিলম্ব, দায় নিয়ে কাস্টমসের আপত্তি
তদন্তে দেখা যায়, কুরিয়ার শেডে আগুনে পুড়ে যাওয়া মোট পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই নিলামযোগ্য ছিল, এবং যদি ঢাকা কাস্টমস হাউস দ্রুত এগুলো আগে সরানোর ব্যবস্থা নিত তাহলে ক্ষয়ক্ষতিও কমানো যেত।
তবে তদন্তের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কাস্টমসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কুরিয়ার পার্সেলে যেসব নিলামযোগ্য পণ্য থাকে, সেগুলোর বড় অংশই বিক্রি করা সম্ভব হয় না—কারণ বাজারে তেমন ক্রেতা থাকে না। ফলে এসব মাল স্বাভাবিকভাবেই জমে যায়। নিলাম বা ধ্বংস—দুটোই নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া ও অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দ্রুত অপসারণ সব সময় সম্ভব হয় না।"
