৩ বছর পর খুলল অন্যরকম নিসর্গ কেওক্রাডং; ট্রেকিং নয়, গাড়িতে চড়েই যাওয়া যাচ্ছে চূড়ায়
নিরাপত্তাজনিত কারণে দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ থাকার পর পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বান্দরবানের রুমা উপজেলার অন্যতম আকর্ষণ কেওক্রাডং পাহাড়। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে স্থানীয় প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য চূড়াটিতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যদিও বগালেক পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি ছিল।
দুর্গাপূজা ও বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসব ঘিরে টানা ছুটির আগে পর্যটন ব্যবসায়ী ও দর্শনার্থীদের পক্ষ থেকে এটি খুলে দেওয়ার দাবি ওঠে। অবশেষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর পহেলা অক্টোবর থেকে কেওক্রাডং পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। খোলার প্রথম দিন থেকেই পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে পাহাড়চূড়া। রুমা উপজেলার পর্যটক গাইডদের তথ্যমতে, প্রথম দিনেই ৮০০ জনের বেশি পর্যটক সেখানে ভ্রমণ করেছেন।
ভূ-স্বর্গ কেওক্রাডংয়ের পথে
রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নে কেওক্রাডংয়ের অবস্থান। বান্দরবান শহর থেকে এর দূরত্ব ৭৬ কিলোমিটার এবং রুমা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার। এর উচ্চতা নিয়ে ভিন্ন তথ্য প্রচলিত থাকলেও জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চূড়াটির উচ্চতা ৪ হাজার ৩৩০ ফুট। বর্তমানে এটি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে পরিচিত। সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে স্বীকৃত থানচি উপজেলার তাজিংডং পাহাড়।


শুক্রবার কেওক্রাডং এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই চূড়ার পথে পর্যটকদের ভিড়। কেউ নিবন্ধন ফরম পূরণ করছেন, কেউবা ঠিক করছেন গাইড। পর্যটকদের মধ্যে বাইকারদের সংখ্যাই ছিল বেশি—কোনো দলে দশজন, কোনো দলে বিশ, এমনকি পঞ্চাশ-ষাটেরও বাইকার দল দেখা গেছে। পরিবারসহ আসা পর্যটকেরা খোলা জিপ বা ল্যান্ড ক্রুজারে করে চূড়ার দিকে যাচ্ছেন।
রুমা থেকে কেওক্রাডং যাওয়ার পথের দুপাশের পাহাড়ের দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। চারপাশের চিরসবুজ প্রকৃতির মাঝে সোনালি ধানের জুমক্ষেত এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। পথের ধারে চোখে পড়ে বম সম্প্রদায়ের পরিচ্ছন্ন ও গোছানো পাড়াগুলো।

কেওক্রাডং চূড়া থেকে চারপাশের অপরূপ প্রকৃতিকে ভূ-স্বর্গ বলে মনে হয়। চূড়ার পাশেই থাকা অন্য পাহাড়গুলোকে সবুজঘেরা মাঠের মতো দেখায়। দূর থেকে চোখে পড়ে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের ত্রিসীমানা ও ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। আরেকপাশে ঘন মেঘের মিতালি। চূড়ায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না। মুর্হুমুর্হু বাতাস গা ভিজিয়ে দেয়। কাঁপুনি ধরে ঠান্ডায়। তবুও উচ্ছসিত পর্যটকদের কেউ সেলফি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়ার সুন্দর মূহুর্তকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন তারা।
পর্যটকদের চোখে কেওক্রাডং
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা রাফিদ খান জানান, তিনি এ পর্যন্ত তিনবার কেওক্রাডং এসেছেন। প্রথমবার ২০১৮ সাল এবং দ্বিতীয়বার ২০২২ সালে। তিনি বলেন, প্রতিবারেই এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য একইরকম ভাল লাগে। চারপাশে পরিবেশ সুন্দর। অন্যরকম ভাল লাগার কাজ করে। তবে ২০১৮ সালে প্রথমবার আসার সময় ট্রেকিং করে উঠতে হয়েছিল। এগুলো তার জীবনে বিশেষ মুর্হুত হয়ে থাকবে।

রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তৌসিফ খান মজলিশ জানান, তিনি প্রথমবার পাহাড়ে বেড়াতে এসেছেন। তাও বান্দরবানে কেওক্রাডয়ের মত দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একটা চূড়ায়। 'এরকম পাহাড় ও মেঘ এভাবে কখনও সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। অন্যরকম একটা ভাল লাগার অনুভূতি কাজ করে। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।'
নাসরিন খান মজলিশ নামে আরেক পর্যটক টিবিএসকে বলেন, '২০২০ সালে বন্ধুদের সঙ্গে কেওক্রাডংয়ে প্রথমবার আসা। এবার পরিবারকে নিয়ে নিয়ে এসেছি। বেশ ভালোলাগার মত জায়গা। একেবারে কেওক্রাডং চূড়ায় পর্যন্ত গাড়িতে করে আসতে পারায় ভ্রমণ আরামদায়ক হয়েছে। তবে এখানে থাকার সুযোগ হবে না। থাকার একুমোডেশন নেই। শহরে গিয়ে থাকব। পরিবেশ ভাল লেগেছে। আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। আশা করি আরও উন্নতি হবে। তবে প্রথমবার ট্রেকিং করে আসাটা ভোলার মতো নয়।

'যদিও কেওক্রাডং পাহাড় একেবারেই প্রাকৃতিক দৃশ্য এলাকা। এখানে কিছু রিসোর্ট বাড়ানো যেতে পারে। মানুষ এসে থাকতে পারবে। যেহেতু চাহিদা আছে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও কিছু বাড়ানো দরকার। বগালেকেও রিসোর্ট সংখ্যা বাড়ানো হোক। সেখানে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো করলে পর্যটকদের আরও সুবিধা হবে। আরও বেড়াতে আসবে। তবে পর্যটন মৌসুমে আসলে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। ঠিকমত গাড়ি পাওয়া যায় না', আরও বলেন তিনি।
আগে ভ্রমণ ও অভিযানপ্রিয় পর্যটকদের কাছে কেওক্রাডং অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল। তখন পর্যটকরা বগালেক থেকে তিন-চার ঘণ্টা হেঁটে চূড়ায় পৌঁছাতেন, সাথে উপভোগ করতেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। তবে এখন চূড়া পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় ট্রেকিংয়ের সুযোগ আর নেই। সকালে রওনা দিলে বান্দরবান শহর থেকে দিনে দিনেই ঘুরে আসা সম্ভব। যাদের পক্ষে সকাল সকাল যাওয়া সম্ভব না তারা কেওক্রাডং থেকে ফিরে বগালেক পাড়ায় রাত্রিযাপন করে থাকেন।
প্রকৃতিপ্রেমীদের উদ্বেগ
কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে আসা অনেক পর্যটক চূড়ায় একটি ভবন নির্মাণ করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, কেওক্রাডংয়ের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গায় ইট-কংক্রিটের নির্মাণকাজ বেমানান। এরকম অপার সৌন্দর্যের আধার দেশের আরও কোথাও পাওয়া যাবে না। এটা খুব সংবেদশীল জায়গা হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা দরকার।
এ বিষয়ে সৈয়দ রিজবান ও আব্দুল্লাহ আজিজ নামে দুই পর্যটক বলেন, 'কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায় স্থায়ী কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা উচিত নয়। এটা পাহাড়ে সৌন্দর্যকে নষ্ট করে। ইতিমধ্যে একটা চারতলা বিল্ডিং নির্মাণ করে ফেলা হয়েছে। এটা প্রকৃতিপ্রেমিদের আহত করেছে। আমরা চাই না এটা নগর হোক। মানুষ নগর ছেড়ে পাহাড় দেখতে আসে। পাহাড়ে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ সেটার সাথে এ ধরণের অবকাঠামো একেবারেই বেমানান।'
'পাহাড়কে পাহাড়ের মতো রাখতে হবে। কেওক্রাডং পাহাড় হলো খুব সংবেনশীল জায়গা। এখানকার একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ আছে সেটা বজায় থাকুক। দূর থেকে যারা বেড়াতে আসবেন তারা একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবে, অন্যদিকে এখানকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকেও জানবে। তাহলে ভ্রমণের সার্থকতা আসবে', যোগ করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে রুমা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আদনান চৌধুরীকে একাধিক ফোন করা হলেও কোন সাড়া দেয়নি।
বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর পহেলা অক্টোবর থেকে কেওক্রাডং পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে অসংখ্য পর্যটক আগমন ঘটছে। তবে একটা বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়েছে, সেখানে অসংখ্য বাইকার যাচ্ছে। ট্যুরিষ্ট পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন নিজেদের নিরাপত্তা বিষয়টা বিবেচনা রাখে। বিশেষ করে তারা যেন দ্রুত না চালায় এবং প্রত্যেকে যেন হেলমেট পড়েন। নিয়মনীতি মেনেই যেন পর্যটন কেন্দ্র ভ্রমণ করেন। তাছাড়া সরকারি অনুমোদিত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও যেন না যান।
ভ্রমণের যত নিয়ম
রুমা উপজেলার পর্যটক গাইড কল্যাণ সমিতির ব্যবস্থাপক লাল রও কোয়াল বমের তথ্যমতে, রুমা সদরে পৌঁছানোর আগে গ্যারিসন এলাকার সেনা চেকপোস্টে সব পর্যটককে নিবন্ধন করতে হয়। সেখানে নির্ধারিত ফরমে পর্যটকের নাম, ঠিকানা, বয়স, পেশা ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করতে হয়। ফরম পূরণের পর জনপ্রতি ৫০ টাকা জমা দিতে হয়। এরপর ফরমটির কয়েকটি ফটোকপি করে রুমা থানা, গাইড সমিতি, বগালেক ও কেওক্রাডং সেনা ক্যাম্পে একটি করে জমা দিতে হয়।
রুমা বাজার থেকে পর্যটক গাইড সমিতির মাধ্যমে গাইড নিতে হয়। প্রশাসনের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ৬ জন বাইকারের জন্য একজন এবং ১৪ জন সাধারণ পর্যটকের জন্য একজন গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত একজন গাইডের দৈনিক পারিশ্রমিক ৭০০ টাকা এবং কেওক্রাডং পর্যন্ত ১ হাজার টাকা। গাইডের থাকা-খাওয়ার খরচ পর্যটকদের বহন করতে হয়।
গাড়ি ভাড়া
উপজেলা জিপ মালিক সমবায় সমিতি ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দিয়েছে। রাস্তা উঁচু-নিচু ও খাড়া হওয়ায় অভিজ্ঞ চালকসহ ফিটনেস সম্পন্ন গাড়ি নেওয়া জরুরি। রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত খোলা জিপের (চাঁদের গাড়ি) একমুখী ভাড়া ২,৭০০ টাকা এবং আসা-যাওয়া ৩,৭০০ টাকা। অন্যদিকে, রুমা থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত একমুখী ভাড়া ৫,০০০ টাকা এবং আসা-যাওয়া ৭,০০০ টাকা। মোটরসাইকেলে রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত আসা-যাওয়ার ভাড়া ১,০০০ টাকা এবং কেওক্রাডং পর্যন্ত ২,০০০ টাকা।