বান্দরবান ঘুরে বেড়ানো: একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে উপকূলবর্তী সমুদ্র
কেউ এখন ঘরকুনো হয়ে থাকতে চায় না। সুযোগ পেলেই সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নতুন কিছু দেখার আশায়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়, অন্যদিকে উপকূলের সমুদ্র—এই দুই সৌন্দর্য একসঙ্গে উপভোগ করার সুযোগ মেলে এই অঞ্চলে ঘুরতে এলে। কারণ এক পাশে পাহাড়ি জেলা বান্দরবান, আর তার অপর পাশে উপকূলীয় কক্সবাজার—দুটি জেলা পাশাপাশি।
অনেকে বান্দরবান ঘুরে কক্সবাজার যান, আবার কেউ কক্সবাজার থেকে ফিরে আসেন বান্দরবানে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি বহু সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিগত বৈচিত্র্যের টানে অনেকেই পাহাড়মুখী হন।
পরিকল্পনায় বৈচিত্র্য আনুন
এখনও অধিকাংশ মানুষ পাহাড়ে ঘোরা মানেই প্রচলিত পর্যটনকেন্দ্রকেই বোঝেন। কেউ কেউ পরিবারের সঙ্গে ইট-কংক্রিটের সাজানো কেন্দ্রেই বেড়াতে পছন্দ করেন, যা শিশু ও পরিবারের জন্য উপযুক্তও বটে।

আবার অনেকে চার-পাঁচ দিনের সময় নিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্কবিহীন দুর্গম এলাকায় ঘুরতে যেতে চান, একটু ভিন্ন স্বাদ নিতে—নীরবতা খুঁজতে, একঘেয়ে জীবনে সতেজতা আনতে। কিন্তু পাহাড়ে ঘুরে এসেও অনেকে পড়ে যান সেই একই রুটিনে—পরিচিত কয়েকটি জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে ভ্রমণ। অথচ সামান্য খোঁজখবর নিয়ে, কিছুটা পরিকল্পনা করলে বান্দরবানে এক সফরেই দেখা যায় অনেক কিছু।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে বান্দরবানই একমাত্র জেলা, যেখানে ১১টি পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। প্রত্যেকের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন ও সংস্কৃতি একে অন্যের থেকে আলাদা। শহরের সাঙ্গু নদীর এক পাড়ে বাস করে মারমারা, অন্য পাড়ে কালাঘাটা এলাকায় থাকে ত্রিপুরা সম্প্রদায়। আরেকটু এগোলে দেখা মেলে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার।
বান্দরবান থেকে রুমা-থানচি সড়কে গেলে শৈলপ্রপাত এলাকার কয়েকটি গ্রামে বম সম্প্রদায়ের বসবাস। তাদের পাড়া গুছানো ও পরিচ্ছন্ন। চিম্বুক পাহাড়জুড়ে রয়েছে ম্রো জনগোষ্ঠীর বসতি, যারা বান্দরবানের পাহাড়িদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। আয়তনে ছোট এই শহরে এলাকা বদলালেই বদলে যায় জাতিগোষ্ঠী।

ভ্রমণের পথে হঠাৎ ক্ষুধা লাগলে চেখে দেখতে পারেন স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী মুন্ডি খাবার বা নানা রকম পিঠাপুলি। তবে স্থানীয় খাবারে অভ্যস্ত না হলে প্রায় সর্বত্রই পাবেন প্রচলিত বাংলা খাবারও।
শহর থেকে একটু দূরে
শহর ছেড়ে সাঙ্গু নদীতে নৌভ্রমণও হতে পারে দারুণ অভিজ্ঞতা। ক্যচিংঘাটা এলাকা থেকে নৌকা ভাড়া করে উজানের বেতছড়া পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। সেখানে নদী, পাহাড়, সবুজ প্রকৃতি ও ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম—সব একসঙ্গে দেখা যায়। নদীর দুই তীরে চোখে পড়বে সবজিক্ষেতের সবুজে ছাওয়া জমি, আর দূর থেকে দেখা যাবে মহিমান্বিত চিম্বুক পাহাড়।
ভ্রমণকারীর সংখ্যা অনুযায়ী ছোট নৌকা ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা (১০ জন ধারণক্ষমতা, সময় এক ঘণ্টা), আর বড় নৌকা ১ হাজার ৫০০ টাকা (২০ জন ধারণক্ষমতা, সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা)।

বেতছড়া এলাকায় গাড়িতেও যাওয়া যায়—ট্রাফিক মোড় থেকে সিএনজি বা মাহেন্দ্র ভাড়া ১,২০০–১,৫০০ টাকা, সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। চাইলে শহরের নৌকাঘাট থেকে সাঙ্গু নদীর ভাটির দিকেও যেতে পারেন। সেখানেও দেখতে পাবেন পাহাড়ি-বাঙালি গ্রাম, ধান ও সবজিক্ষেতের বিশাল বিস্তার। এখানে পর্যটক গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
টংকবতি ও চিম্বুকের পথে
শহর থেকে পর্যটকের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে ট্রাফিক মোড় থেকে সিএনজি, মাহেন্দ্র বা বাসস্টেশন থেকে জীপ (স্থানীয়ভাবে 'চাঁদের গাড়ি') কিংবা ল্যান্ডক্রুজার ভাড়া নিতে পারেন। সিএনজি ও মাহেন্দ্র ভাড়া ২,২০০–২,৫০০ টাকা, আর চাঁদের গাড়ি বা ল্যান্ডক্রুজারের ভাড়া ৩,৫০০–৪,০০০ টাকা।
টংকবতি যাওয়ার পথে প্রথমে সুয়ালক এলাকার মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া দেখা যাবে। পথে চোখে পড়বে ছোট খাল-ছড়া, আর শসা, তিতকরলা ও পেঁপের বিশাল সবজিক্ষেত। এখানকার বিশেষত্ব হলো একইসঙ্গে সমতল ভূমি ও পাহাড়ের মিলন।

ফটোগ্রাফিপ্রেমীদের জন্য এই পথ অসাধারণ। টংকবতি বাজারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হতে পারেন চিম্বুক পাহাড়ে। টংকবতি–চিম্বুক সড়কটি খাড়া ও উঁচুনিচু, দু'পাশে ঘন গাছপালা ও জুমক্ষেত। যেকোনো জায়গায় দাঁড়ালেই চারপাশের সবুজে হারিয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য।
চিম্বুক পর্যটনকেন্দ্রে পৌঁছে চাইলে দুপুরের খাবার খেতে পারেন। তবে খাবার অনেক সময় প্রস্তুত থাকে না, তাই অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। এ ফাঁকে আশপাশ ঘুরে বা পছন্দের দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে নিতে পারেন। এই ভ্রমণেও গাইড নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

গিরিখাদের দেবতাকুম
রোয়াংছড়ি উপজেলা বান্দরবান শহরের সবচেয়ে কাছের উপজেলা। এখানেই রয়েছে মনোমুগ্ধকর 'দেবতাকুম'—স্থানীয়দের ভাষায় 'নাইত অইং'। দুই পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত এই প্রাকৃতিক জলাশয়ে বাঁশের ভেলায় ভেসে ঘুরে বেড়ানো যায়।
এটি এমন এক ভ্রমণস্থল, যেখানে এখনো কোনো কৃত্রিম স্থাপনা তৈরি হয়নি—সবকিছুই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। তবে দেবতাকুম ভ্রমণে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরে পৌঁছেই গাইডরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে দেয়।

দেবতাকুম ভ্রমণের চেয়ে পথের যাত্রাটাই বরং বেশি আকর্ষণীয়। পথে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম, মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি চোখে পড়বে। কোথাও দেখা যাবে পাহাড়ে জুমচাষের দৃশ্য। দেবতাকুম এলাকায় কয়েকটি পাহাড়ি দোকান রয়েছে, যেখানে অগ্রিম বুকিং দিয়ে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। দামও তুলনামূলক কম। স্থানীয় খাবারে অভ্যস্ত না হলে পাওয়া যায় বাংলা খাবারও।
কিছু সতর্কতা
ভ্রমণের অন্যতম আনন্দ ছবি তোলা হলেও কোনো ব্যক্তির ছবি তোলার আগে অবশ্যই অনুমতি নেওয়া উচিত। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস ও রুচি আলাদা—তাদের খাবার নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য না করাই ভালো।

তাদের জীবনযাপনেও বৈচিত্র্য রয়েছে, তাই আচরণে সংবেদনশীল ও সহনশীল হওয়া জরুরি। এছাড়া যে কোনো ভ্রমণে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা উচিত।