'গ্র্যান্ডপা ফাইটার জেট': ১৯৬০-এর দশকে চীন তৈরি করেছিল, ২০১৩ সালে উৎপাদন বন্ধ এফ-৭ যুদ্ধবিমানের

সোমবার দিকে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। বিমানটি চালাচ্ছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম। দুর্ঘটনার কবলে পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে, দুর্ঘটনার মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ২৭ জনে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৭১ জন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বেলা ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটি স্কুল ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধবিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আছড়ে পড়ে ওই স্কুল ভবনে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানকে অনেক সময় 'গ্র্যান্ডপা ফাইটার জেট' বা 'দাদু যুদ্ধবিমান' নামে ডাকা হয়। এটি ১৯৬০-এর দশকে চীন তৈরি করেছিল। শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু হলেও, পরে যখন চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়, তখন বেইজিং সোভিয়েতদের তৈরি মিগ-২১ উল্টোভাবে নির্মাণ করে নিজেরা জে-৭ (রপ্তানি সংস্করণ এফ-৭) বানায়।
চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমান এখনো চালায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুদান, তানজানিয়া ও জিম্বাবুয়ে। এটি মূলত শক্তিশালী মিগ-২১এফ-১৩ মডেল থেকে নকশা করে তৈরি করা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে, যা জে-৭-এর রপ্তানি সংস্করণ। অন্যদিকে, পাকিস্তান অন্তত ১২০টি এফ-১৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে এটির সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী।
এফ-৭ একটি হালকা, এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট এবং সহজে চালানোর মতো যুদ্ধবিমান। এগুলো ব্যবহার করা হয় আকাশে লড়াই করতে, ভূমি আক্রমণ, প্রশিক্ষণ ও টহলের কাজে।
প্রাথমিকভাবে এটি তৈরি করা হয়েছিল চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্সের (পিএলএএএফ) চাহিদা পূরণের জন্য। যদিও এফ-৭ সিরিজের উৎপাদন ২০১৩ সালের মে মাসে বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মিসরের মতো দেশগুলো এখনো এই বিমান ব্যবহার করছে।
এফ-৭ সারাবছর যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করার সক্ষমতা সম্পন্ন ইন্টারসেপ্টর বিমান। এর ডেল্টা আকৃতির ডানা দ্রুত ওঠানামা করতে এবং শব্দের গতিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো গতি অর্জন করতে সাহায্য করে।
তবে সীমিত রেঞ্জের কারণে এফ-৭ মূলত নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিরক্ষার কাজে সবচেয়ে কার্যকর।
এফ-৭ বিএজিআই হলো চীনের এফ-৭ সিরিজের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ, যা বিশেষভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) জন্য উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই জেটগুলি অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কিনেছিল, যতক্ষণ না আধুনিক এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট মাল্টি-রোল যুদ্ধবিমান ফ্লিটে যুক্ত হয়।
এই সংস্করণটি জে-৭ সিরিজের শেষতম ইউনিট ছিল এবং এর শেষটি ২০১৩ সালে বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হয়। আগের সংস্করণগুলোর তুলনায়, এফ-৭ বিএজিআই-তে ককপিটে গুরুত্বপূর্ণ আপগ্রেড করা হয়েছে।
দুটি মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে (এমএফডি) যুক্ত হয়েছে। এতে 'হ্যান্ডস অন থ্রটল অ্যান্ড স্টিক' (এইচওটিএএস) প্রযুক্তি রয়েছে, যা পাইলটকে আরও নিয়ন্ত্রণের সুবিধা দেয়।
নতুন একটি হেডস-আপ ডিসপ্লে (এইচইউডি)ও বসানো হয়েছে। পাইলটদের জন্য হেলমেট-মাউন্টেড সাইটস (এইচএমএস) এবং নাইট ভিশন গিয়ারও সংযুক্ত করা হয়েছে। সাথে রয়েছে মোবাইল ম্যাপ জিপিএস, উন্নত ন্যাভিগেশন ও বোমাবর্ষণ ব্যবস্থা।
পাইলটের নিরাপত্তার জন্য মার্টিন-বেকার এমকে.১০ ইজেকশন সিট ব্যবহার করা হয়েছে।
বারবার দুর্ঘটনার কবলে এফ-৭
গত এক দশকে বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ ধরনের ঘটনাগুলোর জন্য সাধারণত প্রযুক্তিগত ত্রুটি, পুরোনো যন্ত্রাংশ, কিংবা জরুরি মুহূর্তে ইজেকশন সিট কাজ না করার মতো মারাত্মক সমস্যাকে দায়ী করা হয়েছে।