মায়ের হাতের শেষ টিফিন মুখে তুলতে পারেনি নুসরাত

বড় বোন সুমাইয়ার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাত মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান। খাটের পাশের ছোট্ট টেবিলে পড়ে আছে তার বই খাতা। নিজ হাতে লেখা নাম, রোল নম্বর নির্বাক হয়ে যেন খুঁজে ফিরছে নুসরাতকে।
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছোটবেলার মুচকি হাসির ছবিটি দেখে হু হু করে কাঁদছে বড় বোন সুমাইয়া। দুই বোন ছিল একে অপরের খেলার সঙ্গী।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নুসরাত বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। দিয়াবাড়ির রুপ মিয়া সিটিতে তার বাসায় গিয়ে আজ (২৩ জুলাই) দুপুরে এই দৃশ্য দেখা যায়।
দুপুর তখন ২টা। নুসরাতের বাসার ড্রয়িং রুমে বসে কাঁদতে কাঁদতে প্রলাপ বকছেন নুসরাতের মা পারুল বেগম। নিজ চোখেই নিজের মেয়েকে আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছেন তিনি।
পারুল বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানান, দুপুর ১টায় ক্লাস ছুটি হয়। এরপর চলে টিফিনের বিরতি, তারপর শুরু হয় কোচিং। ক্লাস ছুটির পর নুসরাতকে টিফিন খেতে দিয়েছিলেন তিনি। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মায়ের হাত থেকে টিফিন বক্সটি নেওয়ার সময় কেন যেন মায়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নুসরাত। হয়ত মৃত্যুর আগে শেষবার মায়ের মুখটা মন ভরে দেখে নিয়েছে সে।
মা টিফিন বক্স হাতে দিয়ে মূল গেটের দিকে আসামাত্রই বিকট শব্দে আছড়ে পড়ে বিমান।
পারুল বেগম বলেন, 'বিমান পড়ার শব্দ শুনেই আমি দৌড় দেই স্কুলের মাঠে। গিয়ে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়া আর আগুনে আমার মেয়ের ক্লাসরুমের কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আমি দৌড়ে ক্লাস রুমের আগুনের দিকে যেতে চাই। কিন্তু আমাকে অন্য লোকজন আটকে দেয়।'
তিনি বলেন, 'মেয়েটা পুড়ে মারা গেল চোখের সামনেই। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারলাম না আমি। আমার সোনা পাখিটা টিফিন বক্সের খাবারটাও মুখে দেওয়ার সময় পায় নাই।'
বলতে বলতে আবারও ডুকরে ডুকরে কাঁদেন নুসরাতের মা।
নিহত নুসরাতের বাবা মো.আবুল হোসেন একটু পর পর মা মা বলে চিৎকার করছেন পাশের রুমে বসে। সেদিন তিনিই সকাল ৮টায় মেয়ে নুসরাতকে স্কুলে দিয়ে এসেছিলেন।

মেয়ের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে তিনি টিবিএসকে বলেন, 'জোর করে কোচিং করতে বাধ্য করা হতো সব শিক্ষার্থীদের। স্কুল ছুটির পর আমার মেয়ে কোচিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল বলেই আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়েছে।'
তিনি বলেন, ''আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকব। আমার কলিজার টুকরাকে আমি নিজে স্কুলে দিয়ে এসেছিলাম। কেন আল্লাহ আমার কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিল। ওর লাশটা, ওর মুখটা ভুলতে পারছি না। ও মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সোনা মাকে আমি মাটির নিচে রেখে এসেছি। কেমনে বাচমু আমি।'
আবুল হোসেন বলেন, 'এই স্কুল আমার মেয়টারে মাইরা ফেলছে। ও যদি কোচিং না করত তাহলে তো আজ বাঁইচা থাকত।'
একই স্কুলে পড়াশোনা করে নুসরাতের বড় বোন সুমাইয়া। সেদিন পরীক্ষা শেষ করে স্কুল থেকে সে বের হতে পারলেও প্রাণ গেছে তার ছোট্ট বোন নুসরাতের। ছোট বোনের দুষ্টুমিষ্টি স্মৃতি তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।
নুসরাতের বড় বোন টিবিএসকে বলে, 'নুসরাত আর আমি এক খাটে ঘুমাতাম। ও সারাদিন আমার সঙ্গেই খেলধূলা করত, ঘোরাঘুরি করত। আমাকে আপু আপু বলে ডাকত। কিছু দরকার হলেই শুধু আমার কাছে বায়না করত। ও নাই, এটা মানতে পারছি না আমি। এই খাটে একলা আমি আর কোনোদিন ঘুমাতে পারব না। ঘুমানোর সময় ও হাত-পা ছুঁড়তো। ওর ঘুমানোর দৃশ্যগুলো বার বার মনে পড়বে।'
ছোট বোনের স্মৃতিচারণ করতে করতে এবার দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে সেও।
নুসরাতের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শুধু বাবা-মা কিংবা বোন না; আত্মীয়-স্বজনেরাও কেউ মেনে নিতে পারছেন না এমন অপমৃত্যু। সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।

নিহত নুসরাতের ফুফু পিয়ারা বেগম টিবিএসকে বলেন, 'স্কুলে বাচ্চাদের সকাল ৭টায় দিয়ে আসতে হয়। ১ টা পর্যন্ত ক্লাস করে, এরপর কোচিং শুরু হয়। ৪টার সময় কোচিং শেষ হয়। বাচ্চাগুলো খাওয়ারও সময় পায় না ঠিকমতো। আমার ভাইয়ের কলিজার টুকরা। আমার ভাই তো বাচতো না।'
তিনি বলেন, 'এতগুলো মানুষ কীভাবে মারা গেল, এতগুলো শিশুর মৃত্যুর বিচার হতে হবে। স্কুলেরও দোষ আছে, ঠিকঠাক মতো তদন্ত করতে হবে।'
এদিকে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে আজও ভীড় করেছিলেন অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ বহু সাধারণ মানুষ। কিন্তু মূল গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি কেউই। এমনকি সংবাদকর্মীদেরও মেলেনি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৬৫ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ দুপুর ১টা পর্যন্ত নিহতদের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করে সংস্থাটি।
নিজ ঘরের জানালা দিয়ে এক সময় বিমান উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আনন্দ পেত নুসরাত। সেই বিমানই কেড়ে নিল তার মতো বহু শিশুর জীবন প্রদীপ।
ঘরে থাকা নুসরাতের বই, খাতা, সোফায় পুরনো স্কুলব্যাগ দেখে মনে হচ্ছে নুসরাত হয়ত আশেপাশেই কোথাও আছে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো আর কোনোদিন মায়ের হাতের টিফিন জুটবে না নুসরাতের ভাগ্যে। স্কুলের বারান্দায় মাকে দেখে বলবে না মা আমার জন্য কি এনেছো টিফিনে?'