১২৫ বছরে কারও চোখে পড়েনি ভ্যান গখের চিত্রকর্মে লুকানো এই বৈজ্ঞানিক রহস্য

১২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অগণিত মানুষ ভিনসেন্ট ভ্যান গখের বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'স্টারি নাইট' দেখেছে। কিন্তু কেউই বুঝতে পারেনি, সেই চিত্রকর্মের গভীরে লুকিয়ে ছিল এক বৈজ্ঞানিক রহস্য। সম্প্রতি, হাবল টেলিস্কোপের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি সামনে আসে।
ভ্যান গখ নিজের জীবদ্দশায় তার শিল্পকর্মের জন্য কোনো স্বীকৃতি পাননি। ১৮৯০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ফ্রান্সের ওভের-সুর-ওয়াজে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন তিনি। মানসিক অস্থিরতা আর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মৃত্যুর কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে ভাই থিওকে লেখা এক চিঠিতে ভ্যান গখ লেখেন, 'আমার জীবন শিকড় থেকেই আক্রান্ত হয়েছে'। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন এবং নিজেকে একজন 'ব্যর্থ মানুষ ও শিল্পী' বলে মনে করতেন।
ভ্যান গখ ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের একটি মানসিক হাসপাতালে থাকাকালীন তার সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'স্টারি নাইট' আঁকেন। প্রচলিত মত অনুযায়ী, কানের একাংশ কেটে ফেলার ঘটনার পর তিনি সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন।
তবে ভ্যান গখ মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনার পেছনে ছিল তার সহশিল্পী পল গগাঁর সঙ্গে এক তীব্র বাকবিতণ্ডা। সেই উত্তেজনার জেরে এই সহিংসতা ঘটে।
উনিশ শতকের অন্যতম আলোচিত শিল্পী ভ্যান গখের মানসিক বৈকল্য এবং সেটি তার শিল্পকর্মে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তা নতুন কোনো তথ্য নয়। কিন্তু সম্প্রতি গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে তার চিত্রকর্মে লুকিয়ে থাকা 'টার্বুলেন্স' বা অস্থির তরল প্রবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা দর্শক কিংবা বিশেষজ্ঞদের চোখেই পড়েনি।
ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, টার্বুলেন্স বা ঘূর্ণন হলো এক ধরনের প্রবাহ—যেখানে গ্যাস বা তরল পদার্থে অনিয়মিত ঘূর্ণাবর্ত ও শক্তির প্রবাহ ঘটে। যেমন: রক্তপ্রবাহ, লাভার প্রবাহ, সমুদ্র-আবহাওয়া, নৌকার চলনে সৃষ্ট ঢেউ কিংবা বিমানের ডানার চারপাশে বাতাসের গতি। এ ধরনের প্রবাহের গাণিতিক ব্যাখ্যা জটিল হলেও ভ্যান গখ তার ক্যানভাসে তা ধারণ করতে সক্ষম হন।
এখানেই আসে বিস্ময়ের জায়গা—এক শতাব্দী আগে, একজন মানসিক রোগাক্রান্ত শিল্পী তার চিত্রকর্মে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন এই জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণা। স্টারি নাইট-এ ব্যবহৃত ঢেউ, ঘূর্ণাবর্ত এবং আকাশের আলো-ছায়ার খেলা পর্যালোচনা করে গবেষকরা বুঝতে পারেন, ভ্যান গখ যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও সেই অস্থির প্রবাহের প্যাটার্ন বা গতিপ্রকৃতি ধরতে পেরেছিলেন।
গবেষকরা আরও দেখেছেন, অন্য ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা তাদের চিত্রকর্মে 'লুমিন্যান্স' বা আলো-আঁধারির বাস্তব প্রতিফলন উপস্থাপন করতে পারলেও, টার্বুলেন্সের সূক্ষ্মতা তারা ধরতে পারেননি। এমনকি এডভার্ড মুনকের বিখ্যাত 'দ্য স্ক্রিম'-এও যে ঘূর্ণন ও গতির প্রকাশ দেখা যায়, তা ভ্যান গখের 'স্টারি নাইট'-এর তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন।
এ যেন শিল্প ও বিজ্ঞানের এক অনন্য সম্মিলন। নিজেকে ব্যর্থ মনে করা ভ্যান গখ তার চিত্রকর্মে এক শতাব্দী আগেই ধারণ করেছিলেন এমন এক বৈজ্ঞানিক সত্য, যা আজও গবেষকদের বিস্মিত করে যাচ্ছে।