জাহাঙ্গীরের টার্কির চিত্রকর্ম ও ভারতবর্ষে খাদ্যবস্তুর জটিল ইতিহাস

মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর একবার একটি টার্কি পাখি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার স্মৃতিকথা 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি'-তে তিনি লিখেছেন, 'এর মাথা, গলা এবং গলার নিচের অংশ প্রতি মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ধারণ করে। উত্তেজিত হলে পুরোটা টকটকে লাল হয়ে যায়, যেন প্রবালে মোড়া। আবার কিছুক্ষণ পরই সেটি তুলোর মতো ধবধবে সাদা হয়ে ওঠে।'
আসলে এটি উত্তর আমেরিকার পুরুষ টার্কির স্বাভাবিক আচরণ। তাদের মাথার চামড়ার রঙ কখনো টকটকে লাল, কখনো নীলচে ছোপযুক্ত বা ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যায়। এটি মূলত ত্বকের নিচে থাকা কোলাজেন তন্তুর মধ্যে রক্তপ্রবাহের পরিবর্তনের ফলে ঘটে। পুরুষ টার্কির মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে তার রক্তনালী সংকুচিত বা প্রসারিত হয়, ফলে আলো ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়ে গায়ের রঙ বদলে যায়।
জাহাঙ্গীর এ অদ্ভুত পাখিটির চিত্র আঁকার নির্দেশ দেন, যেন শুধু শোনার বদলে দেখেও এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তার দরবারের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী উস্তাদ মনসুর অসাধারণ দক্ষতায় এর ছবি আঁকেন। ছবিটিতে শুধু টার্কির নিখুঁত চিত্রায়নই নয়, বরং স্বর্ণখচিত ফুলেল সীমানার মধ্যে সেটিকে রহস্যময় ও মোহনীয়ভাবে উপস্থাপন করাও এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
তবে এ টার্কি শুধু একটি চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুই নয়, বরং এটি 'কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ'-এরও প্রতিচিত্র। ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের পর নতুন ও পুরোনো বিশ্বের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আদান-প্রদানের যে বৈশ্বিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেটিই 'কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ' নামে পরিচিত।
ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, কলম্বাসের আগেও কিছু নাবিক আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন। তবে তার অভিযানের তথ্যই প্রথম বিস্তারিতভাবে নথিবদ্ধ হয় এবং তার মাধ্যমেই আমেরিকার পণ্য ইউরোপে প্রবেশ করে। সে অর্থে এ বিশাল আদান-প্রদানের প্রক্রিয়ার নামকরণ তার নামে হওয়াটা যথার্থ। আমেরিকা থেকে যে প্রথমদিককার পণ্য ইউরোপে পৌঁছায়, তার মধ্যে টার্কি অন্যতম।
টার্কির পরিবর্তনশীল রঙ, দাপুটে চলাফেরা, অনন্য পালক ও লেজ, আর তুলনামূলক বড় আকারের হলেও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় একে নতুন বিশ্বের (আমেরিকা মহাদেশ) বিস্ময় ও বৈচিত্র্যের প্রতীকে পরিণত করে।
আমেরিকার আদিবাসীরা তার আগে থেকেই টার্কি পালন করতেন। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বিশুদ্ধ পানির অভাব ও স্থান সংকট থাকায় জাহাজে ছোট আকারের প্রাণী বহন করাই সুবিধাজনক ছিল। এ সুযোগটি দ্রুত কাজে লাগায় পর্তুগিজরা।
পর্তুগিজ রাজা দ্বিতীয় জন কলম্বাসকে সমর্থন না করে আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে এশিয়ার নতুন পথ খোঁজার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে প্রথম অভিযানের পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কলম্বাস ইউরোপ ফেরার পথে লিসবনে নামতে বাধ্য হন, ফলে পর্তুগিজরাই তার অভিযানের বিষয়ে প্রথম জানতে পারে।
প্রায় ১২০ বছর পর, জাহাঙ্গীর সে টার্কি পর্তুগিজদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেন। ১৬১২ সালে তিনি তার বিশ্বস্ত দরবারি মুকাররব খানকে গোয়ার বন্দরে পাঠান। সেখানে সরকারিভাবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য বস্তু সংগ্রহের নির্দেশ দেন তিনি।
মোগলদের বর্ণনায় গোয়ার উল্লেখ কম পাওয়া গেলেও, তখন এটি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমদানি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল, তা স্পষ্ট। বিশেষ করে নতুন বিশ্বের বহু দুর্লভ পণ্য এ পথেই ভারতে প্রবেশ করত। কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জের অন্যতম প্রধান সংযোগকারী হিসেবে পর্তুগিজদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মরিচ, টমেটো, আলু, কাজুবাদামের মতো পণ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব তাদেরই দেওয়া হয়।

ব্রায়ান আর. ডট তার বই 'দ্য চিলি পেপার ইন চায়না'-তে উল্লেখ করেছেন, মেক্সিকোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকার কারণে মরিচ পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় মরিচের নাম বিশ্লেষণ করে তিনটি বৃহৎ শ্রেণির ৫৭টি শব্দ শনাক্ত করেছেন। তার মতে, ফিলিপাইন থেকেই মরিচ দক্ষিণ-পূর্ব চীন, উত্তর-পূর্ব চীন ও তাইওয়ানে ছড়িয়ে পড়ে।
পেঁপেও একই পথে ভারতে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত স্বাদে হালকা এ ফলটির উৎপত্তি ও গুরুত্ব নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। ভারত তখন কেন পেঁপেকে গ্রহণ করেছিল, সেটি আজও রহস্য। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—পেঁপে ও মরিচ উভয়ই সহজেই বীজ থেকে দ্রুত জন্মায়, ফলে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে এসেও এগুলো সহজেই চাষযোগ্য হয়ে ওঠে।
কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জে পর্তুগিজদের ভূমিকা কখনো কখনো বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, তারাই ভারতে আলু এনেছিল। তবে এটি সম্ভবত সত্য নয়। কারণ আলু মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল, যার উৎপত্তি স্প্যানিশদের দখলে থাকা আন্দিজ পর্বতমালায়।
অন্যদিকে, পর্তুগিজরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় তাদের পক্ষে আলুর চাষ করা সম্ভব ছিল না। এমনকি যদি তারা স্প্যানিশদের কাছ থেকে আলু সংগ্রহ করেও থাকে, তবুও গোয়ার উষ্ণ জলবায়ুতে এটি টেকেনি। বরং ১৯ শতকে ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতে আলু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে পর্তুগিজরা সম্ভবত ভারতে মিষ্টি আলু এনেছিল। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ ফসল গোয়ার মতো উষ্ণ জলবায়ুতে সহজেই জন্মায়। তবে শেষ পর্যন্ত শীতপ্রধান অঞ্চলের আলু বেশি জনপ্রিয় হওয়ায় মিষ্টি আলুর গুরুত্ব কমে যায়।
ভারতে টার্কির বিস্তারও হয়েছে দীর্ঘ সময়ে। জাহাঙ্গীর টার্কি দেখে মুগ্ধ হলেও, তিনি এটি খেয়েছিলেন—এমন কোনো প্রমাণ নেই। টার্কির বড় আকৃতি ও রাজসিক চেহারা একে দ্রুতই ইউরোপীয়দের খাবার তালিকার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। যেমন, ইউরোপে বড়দিনের আয়োজনে হাঁসের বদলে টার্কি পরিবেশিত হতে শুরু করে।
কিন্তু ভারতের ইউরোপীয়রা বড়দিনে টার্কি খুঁজে পেত না বলে হতাশ হতো। সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ওলোফ তোরেন ১৭৫০ সালে ভারতে ভ্রমণের সময় মাত্র এক জায়গায় টার্কি পেয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, পাখিটিকে বিদেশ থেকে আনা হয়েছে।
উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশদের জন্য ভারতে টার্কি পালন শুরু হয়। ১৮৩৫ সালে কলকাতার বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন উল্লেখ করেন, হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত চিনসুরায় টার্কি পালন করা হচ্ছে। চিনসুরা প্রথমে পর্তুগিজদের দখলে থাকলেও পরে এটি ডাচদের নিয়ন্ত্রণে আসে। উইলসন লক্ষ্য করেন, মাঝিরা জীবিত টার্কি নদীপথে কলকাতায় আনতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তিনি এটিকে কুসংস্কার বলে মনে করেছিলেন। তবে বাস্তবে মাঝিরা হয়তো নিছকই আকারে বড় ও বদমেজাজি এ পাখিগুলো নৌকায় নিতে চাইছিলেন না।
বাংলার গরম ও আর্দ্র জলবায়ু টার্কির জন্য আদর্শ ছিল না। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত 'কমপ্লিট ইন্ডিয়ান হাউজকিপার অ্যান্ড কুক' বইতে বলা হয়, 'ভারতের উত্তরাঞ্চলের শুষ্ক আবহাওয়ায় টার্কি পালন তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে টার্কিকে দই ও প্রচুর পরিমাণে কাটা সবুজ শাক খাওয়ানো উচিত।'
ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সীমিত পরিসরে টার্কি পালন করা হতো। প্রধানত পুরনো ব্রিটিশ ক্লাবগুলোর বড়দিনের আয়োজনে এর চাহিদা ছিল। ভারতে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা সাধারণত মার্কিন দূতাবাসের সরবরাহ কেন্দ্র থেকে টার্কি সংগ্রহ করত।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর-পূর্ব ভারতে টার্কির বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের শেষ দেশটির লাইভস্টক সেন্সাস অনুযায়ী, ভারতে উৎপাদিত মোট টার্কির ৩৪ শতাংশ ছিল আসামে, যেখানে ২০১২ সালে এ হার ছিল মাত্র ৯.৯ শতাংশ।
যুগান্তকারী এ কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ আপাতদৃষ্টিতে মানব সভ্যতার জন্য উপকারী ছিল। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬২০ মিলিয়ন টার্কি পালিত হয়। তবে এর বেশিরভাগই বাণিজ্যিক খামারে লালন-পালন করা হয়, যেখানে দ্রুত ওজন বাড়াতে তাদের অস্বাভাবিক পরিবেশে বড় করা হয় এবং একসময় জবাই করা হয়।
চার শতাব্দী আগে জাহাঙ্গীরের চোখ ধাঁধানো, স্বাধীনচেতা টার্কি যদি আজকের খামারে চোখ বুলিয়ে তাকাত, তাহলে হয়তো এ বিনিময়ের প্রকৃত মূল্য নিয়েই প্রশ্ন তুলত।