নারী শিল্পীদের আঁকা ছবির দাম পুরুষ শিল্পীদের চেয়ে কম হয় কেন?
নিউইয়র্কের নিলামঘরে সাজানো রয়েছে মেক্সিকান কিংবদন্তি ফ্রিদা কাহলোর একটি আত্মপ্রতিকৃতি। শিল্পবোদ্ধাদের চোখ এখন সেদিকেই। ধারণা করা হচ্ছে, ২০ নভেম্বরের নিলামে এটি এখন পর্যন্ত নিলামে বিক্রি হওয়া কোনো নারী শিল্পীর সবচেয়ে দামি শিল্পকর্মের রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে। দাম উঠতে পারে ৪০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত!
১৯৫৪ সালে প্রয়াত ফ্রিদা কাহলো ইতোমধ্যে নারী শিল্পীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামে চিত্রকর্ম বিক্রির রেকর্ডের অধিকারী। ১৯৩২ সালের 'জিমসন উইড/হোয়াইট ফ্লাওয়ার নং ১' চিত্রকর্মটি ২০১৪ সালে ৪৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। ২০২১ সালে তার ১৯৪৯ সালে আঁকা 'ডিয়েগো অ্যান্ড আই' চিত্রকর্মটি ৩৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
চিত্রকর্মগুলোর দাম শুনে তা অনেক বেশি মনে হতে পারে, তবে পুরুষ শিল্পীদের চিত্রকর্মের দামের কাছে তা খুবই নগণ্য। ফ্রিদার চিত্রকর্মটি যদি সর্বোচ্চ দামেও বিক্রি হয়, তবুও তা পুরুষ শিল্পীর রেকর্ডের সামান্য একটি অংশ হবে।
২০১৭ সালে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'সালভাতর মুন্ডি' ক্রিস্টি'স-এর নিলামে বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে!
তবে একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারী শিল্পীর কাজের দাম পুরুষদের তুলনায় কম কেন?
এই আকাশ-পাতাল ব্যবধান শিল্পবাজারের এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। এই বৈষম্যের বিতর্ককে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে ফ্রিদার চিত্রকর্মের এই নিলাম।
শিল্পী নারী হলেই কি ছবির দাম কমে যায়?
শিল্পকর্মের মূল্যায়নে সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি ২০২১ সালের একটি গবেষণাতেও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। 'দ্য রিভিউ অব ফিন্যান্সিয়াল স্টাডিজ' জার্নালে প্রকাশিত 'জেন্ডারড প্রাইসেস' শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেনি বি অ্যাডামস।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দুটি দলে ভাগ করা হয়। তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে তৈরি একই ধরনের কয়েকটি শিল্পকর্ম দেখানো হয় এবং সেগুলোর মূল্যায়ন করতে বলা হয়।
তবে একটি দলকে বলা হয়, চিত্রকর্মগুলো একজন পুরুষ শিল্পীর আঁকা। অন্য দলটিকে জানানো হয়, এগুলো এঁকেছেন একজন নারী শিল্পী।
ফলাফলে দেখা যায়, যারা নিয়মিত আর্ট গ্যালারিতে যান, তারা নারী শিল্পীর আঁকা ছবির চেয়ে পুরুষ শিল্পীর নামে দেখানো ছবিগুলোকে উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন।
অধ্যাপক অ্যাডামসের মতে, শিল্পকলার বাজার অন্য সব খাতের লিঙ্গবৈষম্যের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে।
'শিল্পকর্মের দামের এই ব্যবধান যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না, বরং নারী সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এটি ঘটে। চিত্রকর্মটি ভালো না মন্দ, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই,' বলেন অ্যাডামস।
তিনি বলেন, 'নিলামে ক্রেতারা যদি পরিচয় অনুমান করতে না পারেন, তাহলে দামে কোনো লিঙ্গবৈষম্য দেখা যায় না। কিন্তু যখনই তারা মনে করেন যে শিল্পী কে, তা তারা জানেন, তখনই দামে লিঙ্গবৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।'
স্বাক্ষরই যখন দাম কমায়
নিলামে ওঠা ৫ হাজার চিত্রকর্ম বিশ্লেষণ করে শিল্প-ইতিহাসবিদ হেলেন গরিল দেখতে পান, স্বাক্ষরবিহীন ছবির তুলনায় পুরুষ শিল্পীর স্বাক্ষর থাকলে ছবির দাম বাড়ে। কিন্তু নারী শিল্পীর স্বাক্ষর থাকলে সেই ছবির দাম উল্টো কমে যায়!
হেলেন গরিলের মতে, ফ্রিদা কাহলো বা জেনি স্যাভিলের মতো কয়েকজন শিল্পীর সাফল্যকে সামনে এনে শিল্পজগৎ দেখাতে চায় যে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। 'কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা মোটেও এগোইনি। নব্বইয়ের দশকে আমরা অনেক বেশি নারী শিল্পীকে সফল হতে দেখেছি। এখন খুব কমসংখ্যক নারী সাফল্য পাচ্ছেন, যদিও তাদের সাফল্যের মাত্রা হয়তো আগের চেয়ে বেশি,' বলেন তিনি।
সন্তান জন্ম হওয়াই যেন 'অযোগ্যতা'
হেলেন গরিল এ বিষয়ে আরও দুটি বই নিয়ে কাজ করছেন। হেলেন এমন কয়েকজন নারী শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার পর শিল্প জগৎ থেকে একরকম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তাদের বলা হয়েছে, তাদের কাজ বিক্রি করা যাবে না, 'কারণ ক্রেতারা বিশ্বাস করেন না যে তাদের কাজ পুরুষ শিল্পীর কাজের মতো মূল্য পাবে।'
'অর্থাৎ, একজন নারী শিল্পীর কাজের মূল্য কমে যায় কেবল তার মাতৃত্বের মতো একটি স্বাভাবিক বিষয়ের কারণে,' বলেন হেনরি।
শিল্পের জগতে এই ধারণা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, তা অনেকের মধ্যেই গেঁথে গেছে। খোদ ব্রিটিশ শিল্পী ট্রেসি এমিন ২০১৪ সালে বলেছিলেন, সন্তান থাকলে তার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার সেই বিতর্কিত মন্তব্যটি ছিল, 'অনেক ভালো শিল্পী আছেন যাদের সন্তান আছে, অবশ্যই। তাদের বলা হয় 'পুরুষ'।
নারী শিল্পীদের ওপর আবার বয়সবাদ এবং সৌন্দর্যের মানদণ্ডও চাপিয়ে দেওয়া হয়। হেলেন গরিল জানান, তিনি এমন একজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন, যাকে একজন ডিলার বটক্স করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ, তাঁকে দেখতে 'বিবর্ণ' লাগছিল। 'কিন্তু পুরুষদের আবার বুড়ো এবং কুৎসিত হওয়ার অনুমতি আছে,' বলেন তিনি।
মূল দায় জাদুঘরের?
এই পরিস্থিতির জন্য অনেকেই জাদুঘর এবং বড় আর্ট গ্যালারিগুলোকে দায়ী করেন। হেলেন গরিলের মতে, 'জাদুঘরগুলো পুরুষদের তুলনায় নারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম কম সংগ্রহ করায় নিলামের বাজারে তাদের কাজের মূল্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এর ফলে সংগ্রাহকেরাও নারী শিল্পীদের কাজকে মূল্যবান হিসেবে দেখতে চান না।'
তবে এই স্রোতের বিপরীতেও চলছেন কেউ কেউ। ইতালীয় শিল্প সংগ্রাহক ভ্যালেরিয়া নেপোলিয়ন প্রায় তিন দশক ধরে শুধু নারী শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ করছেন। তিনি বলেন, 'শিল্পের ইতিহাস জুড়ে যেসব নারী কণ্ঠকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, আমি তাদের নিয়ে একটি ঐকতান তৈরি করতে চাই।'
তিনি বলেন, 'সমসাময়িক শিল্প জগৎকে যতটা প্রগতিশীল মনে করা হয়, শিল্পী, জাদুঘরের পরিচালক থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থাটাই পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।'
'আমার জন্য, শিল্পের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কিউরেটরদের চোখে নতুন করে দেখা অত্যন্ত জরুরি। আপনি চাইবেন না নারী শিল্পীরা পুরুষের স্যুটের ওপর সাজিয়ে রাখা কোনো অলংকারের মতো হোক। আপনি চাইবেন, শিল্পী সেই স্যুটের সুতোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠুক। এই ভারসাম্য আনতে কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে,' বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব উইমেন ইন দ্য আর্টস (এনএমডব্লিউএ) এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দ্য উইমেনস আর্ট কালেকশন'-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে কাজ করে যাচ্ছে।
জাদুঘরটির প্রধান কিউরেটর ও উপপরিচালক ক্যাথরিন ওয়াটের মতে, 'শিল্পের ইতিহাসজুড়ে নারীদের প্রতিনিধিত্বের অভাব দূর করার লক্ষ্য নিয়েই' এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
ক্যাথরিন বলেন, 'এখন নারী শিল্পীরা আগের চেয়ে বেশি স্বীকৃতি পেলেও গবেষণা, জাদুঘরের সংগ্রহ এবং বাজারমূল্যে বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারী শিল্পীরা এখনো বড় শিল্পবাজারের কাছে অবহেলিত এবং তাঁদের কাজের অবমূল্যায়ন করা হয়। এ কারণে তাদের পক্ষে কথা বলা এবং তাঁদের কাজ প্রদর্শন করা—এই দ্বৈত লক্ষ্য আমাদের জন্য এখনো অপরিহার্য।'
'লিঙ্গবৈষম্যের এই উত্তরাধিকার অর্থনৈতিক মূল্যায়নের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারী শিল্পীদের নিয়ে আরও গভীর গবেষণা, আরও প্রদর্শনী এবং তাঁদের কাজকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে শিল্পবাজারে তাদের কাজের মূল্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে,' বলেন তিনি।
