মাইকেলেঞ্জেলো থেকে ব্যাঙ্কসি: আইনী বিতর্কের জেরে যে শিল্পকর্মগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল

শিল্প যখন আইন ও ক্ষমতার চোখে অপরাধী হয়ে ওঠে, তখন তার পরিণতি কী হয়? কখনও তাকে ঢেকে দেওয়া হয়, কখনও ভেঙে ফেলা হয়, আবার কখনও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সম্প্রতি লন্ডনের রয়্যাল কোর্টস অফ জাস্টিসের দেয়ালে আঁকা ব্যাঙ্কসির একটি ছবিকে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক আবারও সামনে এসেছে। কিন্তু শিল্পকে দমনের এই ইতিহাস নতুন নয়, বরং শত শত বছর ধরে চলে আসা এক অঘোষিত লড়াই।
লন্ডনের এক আদালতের দেয়ালে হঠাৎই দেখা গেল এক অদ্ভুত ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে, এক বিচারক তাঁর হাতুড়ি (গ্যাভেল) দিয়ে এক আন্দোলনকারীকে নির্মমভাবে পেটাচ্ছেন। ছবিটি এঁকেছিলেন বিখ্যাত কিন্তু রহস্যময় শিল্পী ব্যাঙ্কসি। কিন্তু ছবিটি প্রকাশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ সেটিকে প্রায় মুছে ফেলে। কালো প্লাস্টিকে ঢেকে, ব্যারিকেড দিয়ে জায়গাটা ঘিরে ফেলা হয়। অভিযোগ, এটি নাকি "অপরাধমূলক ক্ষতি"।
ব্যাঙ্কসির এই ছবি আর তার পরিণতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিল্পের এক দীর্ঘ ইতিহাস, যেখানে বহু বিখ্যাত শিল্পকর্মকে আইন বা ক্ষমতার রোষানলে পড়তে হয়েছে।

আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগের কথা। ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলের দেয়ালে মাইকেলেঞ্জেলো এঁকেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ফ্রেস্কো "দ্য লাস্ট জাজমেন্ট"। ছবিতে ছিল যিশুর পুনরাগমন এবং স্বর্গ-নরকের দৃশ্য। কিন্তু গির্জার কর্তাদের চোখে ছবির নগ্ন মানব-মানবীর শরীরগুলো 'অশ্লীল' এবং 'অপবিত্র' বলে মনে হলো।
ফলাফল? মাইকেলেঞ্জেলোর আঁকা নগ্ন শরীরগুলোকে কাপড় পরানোর জন্য ড্যানিয়েল দা ভোলতেরা নামে আরেক শিল্পীকে ভাড়া করা হলো। তিনি ছবিতে থাকা নগ্ন মূর্তিগুলোকে নিপুণভাবে ছোট কাপড় বা লেংটি পরিয়ে দিলেন। এই কাজের জন্য ইতিহাসে তাঁর নামই হয়ে গেল "ইল ব্র্যাগেটোন" বা "লেংটি-নির্মাতা"। যদিও পরে ছবিটির কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু ভোলতেরার সেই "সংশোধন" আজও মাইকেলেঞ্জেলোর শিল্পের গায়ে লেগে আছে।
মাইকেলেঞ্জেলোর শিল্পকর্ম তো তাও টিকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৫৬৬ সালে নেদারল্যান্ডসে শিল্পী ফ্রান্স ফ্লরিসের আঁকা "দ্য ফল অফ দ্য রেবেল অ্যাঞ্জেলস" ছবিটি এতটা ভাগ্যবান ছিল না। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় সংস্কারকরা কুসংস্কার ও মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁদের চোখে এই ছবিটি ছিল আইনের পরিপন্থী। তাই তাঁরা গির্জায় ঢুকে ছবিটির দুটি অংশ ভেঙে ফেলেন। বহু বছর পর ছবিটির বেঁচে যাওয়া খণ্ডিত অংশটি আবারও গির্জায় ঝোলানো হয়, যা শিল্পের সহনশীলতার এক অসাধারণ প্রতীক হয়ে ওঠে।
ঊনবিংশ শতকে স্পেনের শিল্পী ফ্রান্সিসকো দে গোইয়া এঁকেছিলেন দুটি বিখ্যাত ছবি। একই মহিলার দুটি ছবি—একটি পোশাকে, অন্যটি নগ্ন। "দ্য টু মাজাস" নামে পরিচিত এই ছবিগুলো সেই সময়ে বৈপ্লবিক ছিল, কারণ এখানে কোনো পৌরাণিক বা ধর্মীয় চরিত্রের বদলে একজন সাধারণ নারী সরাসরি দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কিন্তু তৎকালীন ধর্মীয় পুলিশ বা ইনকুইজিশনের চোখে এটি ছিল অশালীনতার চূড়ান্ত। ছবিগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং কয়েক দশক ধরে লুকিয়ে রাখা হয়। শিল্পী গোইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করা হয়েছিল। যদিও ছবিগুলো নষ্ট করা হয়নি, কিন্তু বহু বছর সাধারণ মানুষ তা দেখার সুযোগ পায়নি।

একই সময়ে ফ্রান্সে অনোরে ডমিয়ের নামে এক শিল্পী তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি "গারগান্তুয়া" নামে একটি ছবিতে তৎকালীন রাজা লুই-ফিলিপকে এক পেটুক দৈত্য হিসেবে চিত্রিত করেন, যে গরিব প্রজাদের সম্পদ গোগ্রাসে গিলছে। ছবিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ক্ষুব্ধ সরকার শিল্পীকে জেলে পাঠায়। শুধু তাই নয়, যে পাথরের ছাঁচ থেকে ছবিটি ছাপা হতো, সেটিও ভেঙে ফেলা হয়, যাতে ছবিটি আর ছড়ানো না যায়।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এমন আরও বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে। শিল্পকে কখনও আইন দিয়ে, কখনও ধর্ম দিয়ে, আবার কখনও সরাসরি ক্ষমতা দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্যাঙ্কসির ভাগ্যে কী আছে? সরকার কি তাঁকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে? নাকি আংশিকভাবে মুছে ফেলা এই ছবিটিই মানুষের মনে আরও স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেবে?
কখনও কখনও যা চোখের সামনে নেই, তার শক্তি যা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আর দীর্ঘস্থায়ী হয়। মুছে ফেলা শিল্পকর্মগুলো হয়তো সেই কথাই বারবার প্রমাণ করে।